ছাব্বিশ মিনিট আটান্ন সেকেন্ড পার হয়ে গেল।
রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন হাটাহাটি করছে শ্রাবণ। কোথায় যাবে এখনো ঠিক করতে পারেনাই। পাতলা একটা পান্জাবী গায়ে বাসা থেকে বের হওয়ার পর বুঝতে পারলো জ্বরটা বেড়েছে। তবে ঠিক কতো ডিগ্রি বেড়েছে তা বুঝা যাচ্ছে না। এই মূহুর্তে মাসুদ পাশে থাকলে ভাল হতো। তার পিঠে সব সময় চে গুয়েভারার প্রিন্ট করা ছবি সহ একটা ঝোলা ব্যাগ থাকে। যদিও তাকে কখনোই চে সম্পর্কে পজেটিভ কিছু বলতে শোনা যায় নাই। তার ব্যাগে একটা থার্মোমিটার থাকে। ছোট বেলায় হয়তো তার কালা জ্বর হয়েছিল। তার বাবা নিশ্চয় তখন তাকে একটা থার্মোমিটার কিনে দিয়েছিলেন। সাথে বলে দিয়েছেন ওটা যেন সবসময় সাথে রাখে। তার ওই থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখা যেতো জ্বর সাহেব এখন কত ডিগ্রি উচ্চতায় আছেন।
: সামনে যাওয়া যাবে না। হুইসেল বাজিয়ে পুলিশের এক কনস্টেবল থামিয়ে দিল শ্রাবণ কে।
: কেন? সামনে কি চিড়িয়াখানার খাঁচা থেকে বড় বড় দাঁতওয়ালা কোন কুমির পালিয়ে এইদিকে আসতেছে নাকি?
কনস্টেবল এবার চোখ কুঁচকে শ্রাবণের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভাল করে দেখে দুইবার হুইসেল বাজালেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। আশেপাশের সবাইকেই রাস্তার পাশে আটকে দেয়া হয়েছে।
পাশ থেকে একজন অতি উৎসাহি নিজ দায়িত্বে সবাইকে বলছে- কেউ সামনে যাবেন না, মন্ত্রী সাহেব যাবেন। রাস্তা বন্ধ।
শ্রাবণ একবার ভাবলো ওই লোকটিকে গিয়ে জিজ্ঞেশ করবে- কোন মন্ত্রী যাবেন এই রাস্তা দিয়ে, উনার আসতে কত সময় লাগবে, কতক্ষন এভাবে রাস্তা বন্ধ করে যানবাহন-পথচারি সব আটকে রাখা হবে। আচ্ছা এই লোকটি কে হতে পারে মন্ত্রীর পরিচিত কেউ, তার আত্মীয় নাকি চেলা চামুন্ডা টাইপ কেউ। লোকটির রগচটা চেহারা দেখে তাকে কোন কিছু জিজ্ঞেশ করার আর সাহস হলো না। যদি আবার ক্ষেপে যায়, তার চেয়ে বরং ওই পুলিশ কনস্টেবল কে জিজ্ঞেশ করা ভাল।
কোন মন্ত্রী যাবেন এই পথ দিয়ে এ ব্যপারে শ্রাবণের আগ্রহ হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। গত কিছুদিন থেকে তার প্রায়ই এমন হচ্ছে। কোন কিছু নিয়ে প্রবল আগ্রহ জন্মায় এবং মাঝপথে হঠাৎ করেই সব আগ্রহ শেষ হয়ে যায়। হবে হয়তো পাট মন্ত্রী কিংবা পশু মন্ত্রী টাইপের কেউ। আজকাল তো মন্ত্রীর অভাব নেই। এই যেমন পাটেরও একজন মন্ত্রী লাগে। বিদেশে রপ্তানি হয় এমন সব পণ্যের জন্যই কি একটা করে মন্ত্রণালয় লাগে? তাহলে তো পাট মন্ত্রী, গার্মেন্টস মন্ত্রী, কাঁচা শাক-সবজি মন্ত্রী, চিংড়ী মন্ত্রী, ব্যাঙ মন্ত্রীরও পোস্ট লাগবে। ব্যাঙ ও নাকি এখন রপ্তানি হয়, বাউয়া ব্যাঙ।
"বাউয়া ব্যাঙ মন্ত্রী" পদবিটা শ্রাবণের পছন্দ হয়ে যায়। আচ্ছা মন্ত্রী হলেও কেউ কি বাউয়া ব্যাঙ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে চাইবে? শ্রাবণ কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে- বাউয়া ব্যাঙ মন্ত্রী যাবেন প্রত্যন্ত গ্রামের একটি স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। পাড়ায় মহল্লায় মাইকিং হচ্ছে- ভাইসব... ভাইসব... আগামী এত এত তারিখে অমুক স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উপলক্ষে এক ঐতিহাসিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হইয়াছে। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথীর আসন অলংকৃত করিবেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় বাউয়া ব্যাঙ মন্ত্রী জনাব......
নির্দিষ্ট দিনে রাস্তা ঘাট বন্ধ করে দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে বাউয়া ব্যাঙ মন্ত্রী যাবেন উক্ত স্কুলে। মন্ত্রী মহোদয়ের উপস্থিতিতে স্কুলে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা হইবে, "ব্যাঙ আমাদের জাতীয় সম্পদ" বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতা হইবে। বাচ্চাদের ব্যাঙ লাফ প্রতিযোগিতা হইবে, হারমোনিয়াম-তবলা দিয়ে গান হইবে। মন্ত্রী মহোদয় পুরস্কার প্রদান করিবেন। পুরস্কারপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকগণ পুরস্কার নেয়ার সেই ক্ষণটি তাদের মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে রাখবেন।
অবশেষে বাউয়া ব্যাঙ মন্ত্রী বক্তৃতা করবেন। ব্যাঙ মন্ত্রণালয়ের সাফল্যের বয়ান দিয়ে শুরু করবেন। ব্যাঙ রপ্তানি করে কি পরিমান বৈদেশিক মূদ্রা আয় হয়েছে তার বর্ণনার পাশাপাশি পূর্ববর্তী সরকারের ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরবেন। শিশুদের কে ব্যাঙ না মারার প্রতি উৎসাহ প্রদান করবেন। ব্যাঙের জিবন রহস্য নিয়ে ফ্রয়েডিয় তত্ব হাজির করিয়া নিজের জ্ঞান জাহির করিবেন। উপস্থিত সবার উদ্যেশ্যে বলিবেন- আপনারা তো জানেন ব্যাঙের কোন ফ্যামিলী প্লানিং নেই। তারা সবসময় হ্যালুসিনেশনে ভোগে, যার ফলে তারা অন্য সব ব্যাঙকেই তাদের স্ত্রী মনে করে। তারা একসাথে অনেকগুলো বাচ্চা ফুটায়। বাচ্চাদের বলা হয় ব্যাঙাচি। তাদের প্রথমে সামনের দুটো পা থাকে আর থাকে পেছনে একটা লেজ। সময়ের বিবর্তনে তাদের পেছনের লেজটি দুভাগ হয়ে দুই পায়ে পরিণত হয়। ডারউইন সাহেব বিবর্তনবাদ পর্বে ব্যাঙের উদাহরণ না এনে বানরের উদাহরণ এনে মস্তবড় ভুল করেছিলেন।
এ্যাই... এভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছো ক্যান? গাড়িতে ওঠ। তোমাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, সেলফোন অফ, কিছুক্ষণ আগে তোমার কাঁঠালবাগানের বাসায় গেলাম সেখানেও তালা মারা। আচ্ছা শ্রাবণ! তুমি কবে সব কিছু খেয়াল রাখবে? এটলিস্ট আমার জন্মদিনটার কথা তো মনে রাখবে।
শ্রাবণ তাকিয়ে দেখে গাড়ীর পেছনের দরজা খুলে নীল শাড়ী পরা রেইনি দাঁড়িয়ে আছে। কোটিপতি বাবার একমাত্র মেয়ে রেইনি। তিন বছর আগে বইমেলায় পরিচয়ের পর থেকেই হঠাৎ হঠাৎ ভুতের মতো উদয় হয় মেয়েটি।
রেইনির সাথে এখন আর তার বার্থডে পার্টিতে যেতে ইচ্ছে করছে না শ্রাবণের। জ্বর মনে হয় আরো বেড়েছে। তার মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি নামবে। খোলা মাঠে খালি পায়ে সে দাঁড়িয়ে থাকবে আকাশের দিকে তাকিয়ে। বৃষ্টিতে তার শরীর চুঁয়ে পানি ঝরবে। তার চারপাশে পুরো মাঠ জুড়ে বাউয়া ব্যাঙেরা এসে জড়ো হবে। সে যা করবে ব্যাঙেরাও তাকে ফলো করবে। ঠিক যেন হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা।