গভীর উদ্বেগের খবর যে- ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ পানির স-র নেমে যাওয়ার ফলে রাজধানী ঢাকায় ভূমিধসের আশঙ্কা ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজধানীতে অপরিকল্পিতভাবে মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে বড় ধরনের ভূমিধস ঘটতে পারে- এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরে করে আসলেও এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল থেকে কোনোই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। আর এই উদাসীনতাই আশঙ্কাকে আরো প্রকটভাবে বাড়িয়ে তুলছে। প্রায় দেড় কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ মেগাসিটি ভয়াবহ কোনো বিপর্যয়ের মুখে পড়ার আগেই কি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সচেতন হওয়া এবং এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত নয়?
প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রতি বছর ১ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার করে দেবে যাচ্ছে ঢাকা শহর। এর ফলে যে কোনো সময় মারাত্মক ভূমিধস হয়ে লাখ লাখ লোকের মৃত্যু হতে পারে। সম্ভাব্য ভূমিধসের প্রধান কারণ হিসেবেই বলা হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন। একদিকে নদী-জলাশয়ের অপমৃত্যু অন্যদিকে নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করার কারণে ঢাকা শহরের পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে গেছে। স্মর্তব্য, নগরের ভূগর্ভস্থ পানির স-র স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ৬১ দশমিক ১৮ মিটার বা ১৮৬ ফুট নিচে নেমে গেছে। নগরের বেশিরভাগ মাটি ইট-কংক্রিটে ঢেকে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি মাটি প্রয়োজন অনুযায়ী শোষণ করতে পারে না। আর এর ফলে পানির স-র ক্রমাগত নিম্নমুখী হচ্ছে। এটা সকলেরই বোধগম্য যে- ভূ-ত্বকের মধ্যে যে স্বাভাবিক চাপ থাকে অস্বাভাবিক হারে পানি তুলে নিলে তা ক্রমাগত ভারসাম্যহীনই হয়ে পড়বে। এতে ভূমিকম্প বা মারাত্মক ভূমিধসের আশঙ্কা বাড়বে বৈ কমবে না।
ভূতাত্ত্বিকদের মতে- রাজধানী ঢাকার ভূতাত্ত্বিক গঠন এমনিতেই ভালো নয়। তার উপর কোনো ধরনের আইন না মেনেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ভবন। বহুতল এসব ভবন ৭ মাত্রার ভূমিকম্প প্রতিরোধক বলে প্রচার করা হলেও কার্যত তা সত্য নয়। নির্মাণাধীন অবস্থায়ই অনেক ভবন ধসে পড়ার খবর সংবাদ মাধ্যমে মাঝে মধ্যেই প্রকাশিত হয়। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা অনুযায়ী ভূমিধস হলে ক্ষয়ক্ষতি যে মারাত্মক আকার ধারণ করবে তা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে নগরীর কিছু কিছু এলাকায় দেখা যায় সেখানে ১৬ তলার নিচে কোনো ভবনই নেই। বিশেষজ্ঞরা প্রমাণ পেয়েছেন এসব আবাসিক এলাকার মাটির পুরুত্ব ২৫ ফুটের বেশি নয়। ফলে স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প বা ভূমিধসেও দেবে যাবে এ সমস- এলাকা এবং দেখা দেবে মারাত্মক বিপর্যয়কর পরিসি'তি।
যেহেতু ভূমিধসের প্রধান কারণই অপরিকল্পিত পানি উত্তোলন। তাই এর বিকল্প ব্যবস্থা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। দেখা যায়- রাজধানীর নিকটবর্তী বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যাসহ এর চারপাশের ছোট-বড় নদীগুলোর পানি প্রতিনিয়তই অতিমাত্রায় দূষিত হচ্ছে। তাছাড়া ক্রমাগত নদী দখল হতে হতে নদীগুলোও শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সেমিনারে আলোচনা ও সংবাদ মাধ্যমে বিস-র লেখালেখি হলেও সমস্যা তো কমছেই না বরং দিন দিন তা আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। এখনই যদি রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোর পানি দখল ও দূষণমুক্ত না করা যায় এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী ভূগর্ভ থেকে অন-ত বছরে ছয় মাস পানি উত্তোলন বন্ধ না রাখা যায়, তাহলে অবস্থা হবে ভয়াবহ। উল্লেখ্য, নগরবাসীর জন্য প্রতিদিন প্রয়োজন হয় ২২০ কোটি লিটার পানি- যার বৃহৎ অংশটাই নেয়া হয় ভূগর্ভ থেকে।
বলার অপেক্ষা রাখে না- বিশ্বের অন্যান্য মেগাসিটির চেয়ে ঢাকার পানির উৎস খুবই সুলভ। বিশ্বে খুব কম নগরীই আছে যার চারপাশে ঘিরে আছে অনেকগুলো নদী। প্রশাসনের নির্বিকারত্বে এসব নদীর পানি দূষিতই হতে থাকবে আর দেশের প্রধান শহর হয়ে পড়বে ভূমিধসে ঝুঁকিপূর্ণ- এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। অবিলম্বে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সচেতনতা প্রয়োজন, কার্যকরভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে ভূগর্ভস্থ পানির বিকল্প হিসেবে নদ-নদীর পানি পরিশোধন করে তা সরবরাহে ওয়াসার বেশি মনোযোগী হতে হবে। বলাবাহুল্য, রাজধানীকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রেখে দেশে কোনো কিছুই করা সম্ভব নয়।
সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) একটি জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রিখটার স্কেলে ৭.৫ থেকে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট নগরীর প্রায় আড়াই লাখ ভবন ধসে পড়তে পারে। জরিপে ঢাকার ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবনের মধ্যে ৭৮ হাজার, চট্টগ্রাম নগরীর ১ লাখ ৮০ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার এবং সিলেটের ৫২ হাজার ভবনের মধ্যে ২৪ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার ৭৮ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করার কারণ হিসেবে ভূগর্ভস্থ নরম মাটি, বিল্ডিং কোড না মানা ও অপরিকল্পিত নগরায়নের কথা বলা হয়েছে।
রাজধানীর এতো বেশি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগজনক। বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ এবং নকশা ও নির্মাণ ত্রুটির কারণে এসব ভবন এখন ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঢাকা নগরীতে এমন অসংখ্য বিল্ডিং রয়েছে যেগুলোর যথাযথ ফাউন্ডেশন নেই। তাছাড়া অধিকাংশ অ্যাপার্টমেন্ট ও উঁচু তলার বিল্ডিংয়ের নিচে গ্যারেজের জন্য ফাঁকা জায়গা রাখা হচ্ছে, যা ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষজ্ঞের মতে, ঢাকার ৬৫ ভাগ এলাকার মাটিই নরম এবং এ মাটি কম্পনকে দীর্ঘস্থায়ী করে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, বালু আর তুরাগ নদীর আশপাশের জনবসতি গড়ে উঠেছে এ রকম নরম মাটির উপরেই। এ রকম নরম মাটিতে বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া মোটেও ঠিক হয়নি।
ঝুঁকিপূর্ণ এ ভবনগুলো অন্য ভবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। কেননা ঢাকা শহরের ভবনগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে এমনভাবে লাগোয়া যে, একটি ভেঙে পড়লে তা আরেকটি ভবনের উপর গিয়ে পড়বে। তাই বিপর্যয় এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলার পাশাপাশি বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করতে নগরবাসীকে বাধ্য করতে হবে। নরম মাটির উপর যাতে বহুতল ভবন নির্মিত না হয় সেদিকটি লক্ষ্য রাখতে হবে। বিল্ডিং নির্মাণের এ দিকগুলো দেখার দায়িত্ব রাজউকের। পরিকল্পিত নগর নির্মাণে তারা যদি মনোযোগী না হয় তাহলে ঢাকা শহরে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা আরো বাড়তে থাকবে।
খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী বড় ধরনের ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনায় আমাদের প্রস্থতিহীনতার কথা স্বীকার করেছেন। বহুতল ভবনের আগুন নেভাতেই যেখানে আমাদের দমকল বাহিনী ও উদ্ধারকর্মীদের হিমশিম খেতে হয় সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পর ধ্বংসস্তূপ সরাতে তাদের অপারগতার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকৃতপক্ষে ভূমিকম্প-পরবর্তী ধ্বংসস্তূপ সরানোর আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই আমাদের দেশে। ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজ চালানোর জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি আনা প্রয়োজন। দুর্যোগের সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, দমকল বাহিনী ও উদ্ধারকর্মী এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কীভাবে সমন্বিতভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দরকার। ভূমিকম্পের পর বিকল্প ব্যবস্থায় জরুরি সেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পানি, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, হাসপাতাল ও যোগাযোগ কর্তৃপক্ষকে প্রস্থত রাখতে হবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




