somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রতিভা

১০ ই মে, ২০১৮ রাত ১২:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ বিকেলেও অভীক বাবু বাড়ি বয়ে তাগাদা দিতে এসেছেন, লেখাটা কিন্তু এই রোববারই চাই সুবীরদা, না হলে বড্ড অসুবিধায় পড়ে যাব। আজকাল প্রেসের উপর তো সেই কন্ট্রোল নেই, যে শেষ মুহূর্তেও খাতিরে কাজ নামিয়ে দেবে হাসিমুখেই। সব নতুন ডিজিটাল পাবলিশিং এর ছেলে ছোকরার দল, পুরনো ছাপাখানার ফেলে আসা সোনালী দিনগুলির উদ্দেশ্যে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, খানিকটা সত্যিই আক্ষেপ, বাকিটা লেখকদের উপর চাপ বাড়ানোর সনাতন কৌশল।
একটু নাম, দুচারটে সম্মানের পরে, লেখকরা নিজেদের বোধহয় ভগবান ভাবেন, সৃষ্টিকর্তা। এই তো দু বছর আগেও সুবীর সামন্ত কে তিনি তার চেম্বারের বাইরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে দেখেছেন। সাহিত্য আড্ডায় আমন্ত্রণ পেয়ে তার কৃতজ্ঞ মুখ দেখেছেন। আর এখন দুটো জাতীয় পুরস্কারের পরে চিত্রটা উল্টো। আবার তার একটা গল্প থেকে সিনেমা হচ্ছে, কাজেই...।অভীক বাবুর মনে হয় সুবীরদার নাম হয়েছে ঠিকই কিন্তু লেখা বড় গতে বাঁধা।
সুবীরদা অবশ্য লোক খারাপ নন এমনিতে, কথার খেলাপও তো বড় একটা করেন না। তবে এখন কানাঘুষোয় শুনছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকা ওনাকে ভাঙিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। অভীকবাবু অবশ্য আশাবাদী, সুবীরদা বিবেকহীন নন। যে পত্রিকা তাকে ব্রেক দিয়েছে, যার সুবাদে এত নাম ডাক, সামান্য কিছু বেশী টাকার জন্য উনি তাকে পরিত্যাগ করার মানুষ বলে মনে হয় না। আর বেশী টাকা তো উনিও অফার করতে পারেন, ইনফ্যাক্ট এবছর পুজো সংখ্যার পরেই সেটা করবেন ঠিক করেছেন। কিন্তু যে শ্রদ্ধা ও আন্তরিক ভালোবাসা তিলোত্তমা তাকে দেয়, আজকাল হেলফেশানের পত্রিকাতে, সেই পরিবেশটাই পাবেন না সুবীরদা। কাজেই অহেতুক দুশ্চিন্তা ছেড়ে, তার জন্য রেখে যাওয়া স্পেশাল লেবু চাতে চুমুক দিলেন অভীক বাবু। সুবীরদা ফোনে ব্যস্ত, ফোন শেষ হলেই বিদায় নেবেন তিনি।
অফিসে ফিরতে ছটা বাজলো, দেখলেন সুজাত আজো বসে আছে। কাঁধের ঝোলা ব্যাগে সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি। খারাপ লেখে না ছেলেটা, তাছাড়া অসামান্য ধৈর্য তার, সুতরাং একদিন হয়ত সে একটা ব্রেক পেয়ে যাবে, কিন্তু এখন তিলোত্তমাতে সত্যি তিল ধারনের জায়গা নেই, অনুগল্পও না।
সামান্য খারাপই লাগে অভীক বাবুর। আরে সুজাত কতক্ষণ বসে? একটা ফোন করে তো আসতে পার, বসে থাকতে হয় না। ফোন করে আসলে যে আদৌ আসাই যাবে না অভীকদা, হেসে ওঠেন দুজনেই; খাঁটি কথা, সুজাতকে তার এসিস্টেন্ট কোনদিনই এপয়েন্টমেন্ট দেবে না। চল চল চা হয়ে যাক, টাও কিছু বলি? অসম্মতি নেই সুজাতর। গরম শিঙাড়া তে কামড় দিয়ে অভীক বাবু বলেন, তারপর কি খবর বল? খবর তো আপনার হাতে অভীকদা, এ বার অন্তত একটা সুযোগ দিন।
একটু উদাস সুর অভীক বাবুর। আমার কি ইচ্ছে করে না কিংমেকার হতে সুজাত, কিন্তু সব ডিশিসান কি আর আমার হাতে? পাবলিক ডিম্যান্ডটাও ফ্যাক্টর। আজকাল সব বড় নাম সর্বস্ব, প্রতিভাকে অপেক্ষা করতেই হবে। তবে, তোমার ভিতরে জিনিস আছে, তোমার হবে। আর কিছুদিন অপেক্ষা কর, আরো দুচারটে লিটিল ম্যাগাজিনে লেখ টেখ, সুযোগ হলেই তোমায় সবার আগে ডাকবো, আমার এক কথা। গায়ে জ্বালা করে সুজাতর, এই ডায়লগ তিন বছরের পুরনো। উপরের সুপারিশে অনেক 'ফালতু' লেখাও এই তিন বছরে ছাপিয়েছেন অভীকদা, তার সেরকম খুঁটির জোর নেই তাই। তাছাড়া বিজ্ঞাপনের জন্য জান কুরবান অভীকদার; আর ভাবটা করেন যেন কত তরুন সাহিত্যিক দরদী। অন্যরা সরাসরি না বলে দেয়, অন্তত ভণ্ডামি নেই, অথচ এনাকে দেখ,  বস্তা পচা লেখক সুবীর সামন্তর বাড়িতে ঘন্টার পর ঘন্টা ধর্না দেন অপাঠ্য লেখার জন্য, আর সত্যিকারের ভালো লেখার কোন সম্মান ওনার কাছেও নেই। আসলে উনি চাটুকারিতা পছন্দ করেন। ওনাকে ঘিরে সারাক্ষণ 'উদীয়মান' সাহিত্যিকরা, একটা ব্রেকের আশায় জয়গান করে চলে, সেটা উনি বেশ উপভোগ করেন।

দাদা আমার এবারের বড় গল্পটা রেখে যাই, পড়ে দেখবেন, আপনার সময় নষ্ট হবে না,হাল্কা অভিমানী সুর সুজাতর গলায়। আরে তোমার লেখার শুধু আমি নয়, আমার গিন্নীও ভক্ত, অবশ্যই পড়ব, রেখে যাও। না দাদা আগে আপনি পড়বেন, এটা আমার অনুরোধ, ভালো লাগলে বৌদকে দেবেন পড়তে, সেটাই ঠিক হবে। সুজাতর শেষ কথাটা কেমন কানে লাগে অভীকবাবুর, ঠিক হবে মানে? আসলে বাতিল ম্যানুস্ক্রিপ্ট পড়া তার স্ত্রীর এক বেখাপ্পা হবি, নিজের সময় কোথায়?
চলি দাদা, আরেকটা উপন্যাসও শেষের পথে, এই দুএকদিনে শেষ করব, আপনার মতামত কিন্তু চাই। উঠে দাঁড়ায় সুজাত, মনে মনে হাঁফ ছাড়েন, হাল্কা হন অভীক বাবু। রাত প্রায় নটা, এই সময় এক পেগ না হলে শরীরটা ম্যাজমেজে করে, তা সুজাতর সামনে তো আর পেগ বানানো যায় না।

সুজাত বেড়িয়ে যেতেই, কলিং বেলে চাপ দিলেন তিনি। ১৮ বছরের পুরনো 'বয়' রঘু তার পানীয় এনে সামনে রাখল। স্যার বাইরে তো খুব জল জমেছে, জামিল বলছে জল না নামলে তো গাড়ি যাবে না। তাই তো! নিজের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে খেয়াল করেননি তিনি, কখন এক বিশাল অকালবৈশাখী শহরটাকে তছনছ করে গেছে। আচ্ছা দেখি কি করা যায়, তুই যা। রঘুকে বিদায় করে টিভি চালালেন তিনি, ঝড় বৃষ্টিতে সব ডিশ অকেজো। অগত্যা এফ এম। শহরে ৭০ কিমি বেগে বয়ে যাওয়া ঘূর্নি ঝড়ে জনজীবন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। বাড়িতে একটা ফোন করলেন অভীক বাবু। কাজের মেয়ে রমার গলা 'হেলো' - 'বৌদিকে দে', 'বৌদি এখনো ফেরেনিকো দাদাবাবু, ফুন করে বলেছে আজ রাতে মাসীমার কাছে থেকে যেতে পারে'। 'ও আচ্ছা, দরজা ভালো করে বন্ধ করে থাক, আমার ফিরতে দেরী হবে'। 'ঠিক আছে দাদাবাবু'। ফোন নামিয়ে আরেকবার গ্লাসে চুমুক দেন অভীক বাবু। উফ কি বিপদ, সারাদিন পরে বাড়ি ফেরারো উপায় নেই। উশখুশ করতে করতে হঠাৎ তার চোখ পড়ে সুজাতর রেখে যাওয়া কাগজের তাড়ায়, সাথে মনে পড়ে সেই অদ্ভুত কথা, আগে আপনি পড়বেন, ঠিক মনে হলে...। কৌতূহলবশত পাণ্ডুলিপিটা টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করেন। কোথা দিয়ে সময় কেটে যায় খেয়াল নেই অভীকবাবুর। কতগুলো পেগ হল তারো হিসেব থাকে না। এই লেখা শেষ পর্যন্ত তাকে পড়তেই হবে, এখনি, কেউ পড়ার আগেই। শেষ পাতা উলটে স্থানুর মত কিছুক্ষন বসে রইলেন তিনি। তারপরেই ড্রয়ার হাঁতড়ান সুজাতর ফোন নম্বরের জন্য। পাচ্ছেন না। উদ্বগে সব কাগজপত্র ঘেঁটে ফেলেন তিনি। তখনি চোখে পড়ে পাণ্ডুলিপির উপরেই নিজের মোবাইল নম্বর লাল কালিতে লিখে দিয়ে গেছে সুজাত, যেন নিশ্চিত ছিল সে অভীক বাবু ফোন করবেনই, আর কেনই বা নিশ্চিত থাকবে না? এরকম একটা লেখা! দ্রুত মোবাইলের স্ক্রিনে নাম্বার টাইপ করে ডায়াল করলেন অভীক বাবু। ওপাশে যেন তারই ফোনের প্রতীক্ষায় ছিল সুজাত; 'দাদা কেমন লাগলো? যদি ফার্স্ট ড্রাফটের মাল মশলা দেখতে চান, জেরক্স দিয়ে আসবো, আপনি বললে কালকেই'।
অভীক বাবুর নরম গলা, 'তোমার উপন্যাসটা কতদূর সুজাত? কত শব্দের? এই ছয় পাতা মত অভীকদা, আজকাল উপন্যাসের তো ওটাই স্ট্যান্ডার্ড সাইজ। কাল শেষ হয়ে যাবে'। 'ধীরেনের কাছে দিয়ে যেও, সাথে দুচার লাইনে নিজের পরিচয়, ধীরেনই এডিট করে নেবে'। 'আপনি একবার পড়ে দেখবেন না দাদা?' সামান্য কৌতুক সুজাতর গলায়, 'তার কি কোন প্রয়োজন আছে সুজাত?' ক্লান্ত গলা অভীক বাবুর, 'তোমার সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না; তবে এই গোয়েন্দাগিরির প্রতিভাটা জানতাম না; এর কি সত্যি দরকার ছিল?' 'তিন বছর তো আপনার ভরসার উপরেই ভরসা করে আছি অভীকদা, আর গোয়েন্দা গল্পও তো সাহিত্য, বাস্তব ঘটনা অবলম্বী হলে তো কোন কথাই নেই' সামান্য হাসল সুজাত। 'বাদ দাও ওসব সুজাত, আমাদের দুজনেরই এখন দুজনকে দরকার। কাল দিয়ে যেও লেখাটা, এই বারের পুজো সংখাতেই যাবে। কালই দিও না হলে বড্ড অসুবিধায় পড়ে যাব। আজকাল প্রেসের উপর তো সেই কন্ট্রোল নেই, যে শেষ মুহূর্তেও খাতিরে কাজ নামিয়ে দেবে, হাসিমুখেই, সব নতুন ডিজিটাল পাবলিশিং এর ছেলে ছোকরার দল, বাধা বুলি অভ্যাসবশে আউড়ে যান  তিনি; তারপরে নিজের অসহায়তার কথা ভেবেই বোধহয় ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ফোন রাখেন।
সুবীর বাবুকে মনে মনে ধন্যবাদ দেন অভীক বাবু, সঠিক সময়ে লেখা জমা না করার জন্য, তার লেখা বাদ দিতে  খুব শক্ত অজুহাত লাগতো না হলে।

সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৮ ভোর ৪:০০
১৩টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×