somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হার জিত (ছোট গল্প)

১৭ ই মে, ২০১৮ বিকাল ৪:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হার জিত
শুকনো মুখে উঠে দাড়াল অনিমা, তনুশ্রী কড়া দৃষ্টিতে তাকে বিদ্ধ করে বললেন
- এখন এস, এই তোমার শেষ সুযোগ, হয় দুদিনের মধ্যে টার্গেট পুরো কর, নয় তো রেজিগনেশান দিয়ে যেও। তোমায় ফায়ার করলে সেটা তোমার কেরিয়ারে কালো দাগ হয়ে থাকবে, তাই ঐ রেজিগনেশান দেওয়ার সুযোগটুকু আমি দিতে পারি। লাস্ট ছয়মাস ধরে তোমার পারফর্মেন্স নিয়ে উপরতলায় কৈফিয়ত দিতে দিতে আমি ক্লান্ত।
- কিন্ত ম্যাডাম
- প্লীজ অনিমা, নো আর্গুমেন্ট এনিমোর, লিভ নাউ
কেবিনের দরজা ঠেলে ক্লান্ত, পরাজিত পায়ে, অনিমাকে বেড়িয়ে যেতে দেখেন তনুশ্রী। মেজাজটা তেতো হয়ে যায় তাঁর। ডেস্কে রাখা অনুর ছবির দিকে চোখ চলে যায়। ঐ অনিমারই বয়সী, অনামিকা; কিন্তু আমেরিকাতে বড় আইটি প্রতিষ্ঠানে সুপ্রতিষ্ঠিত। কাজ-অন্ত প্রান, অনিমার সাথে তফাত সেখানেই। তনুশ্রী জানে যে অনিমা বড়সড় পারিবারিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, জানে যে ওর ঘাড়েই এখন প্রায় পুরো পরিবারের দায়িত্ব, অসুস্থ মা ও দাদার দেখভাল, সব একা হাতে। কিন্তু তার জন্য অফিস কি করবে? অফিসের পারফরমেন্স বরং আরো ভালো করা উচিৎ ছিল মেয়েটার,যাতে চাকরীটা বাঁচে। এই প্রফেশানালিজিমের যুগে, কেউ কোন এক্সকিউজ শুনতে রাজী নয়, এমনকি সত্যিকারের সমস্যা হলেও নয়। কাজেই অনিমাকে যেতে হবে, দুদিন কেন, আগামী দশ দিনেও ঐ টার্গেট পুরো করা কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়। তনুশ্রীর একটা অজুহাত দরকার ছিল, সেটা সহজেই পাওয়া গেছে। প্রাইভেট সেক্টরে এসব নতুন নয়। হায়ার এন্ড ফায়ারই তো পলিসি। মন থেকে অনিমাকে মুছে ফেললেন তনুশ্রী, এখন রেজিগনেশান ইত্যাদি তার সেক্রেটারিই দেখবে। সেই খুজবে নতুন মুখ অনিমার বদলে। অনিমার পারসোনাল ফাইলটা সেক্রেটারির জন্য নির্দিষ্ট ট্রেতে রেখে দিয়ে, তার রোজকার কর্মতালিকার থেকে 'তনিমার রেজিগনেশান' কথাটা কেটে দিলেন তিনি। সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরুনোর পথে চোখে পরে অনিমার সীট খালি। যদিও ৮টা বাজে, এখনো ছেলেমেয়েরা ঘাড় গুঁজে কাজ করছে, সকাল দশটার মতই। অনিমা সচরাচর ৭টার পরে থাকে না, আর আসতেও প্রায়ই লেট করে। যাক ওকে বিদায় করে একটা মাথা ব্যথা কমল।

বাইরে অপেক্ষমান ফোর্ডে উঠে, তনুশ্রী ড্রাইভারকে বললেন
-হরেন, টিভিটা চালাও।
হরেন জানে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে, টিভিতে দেশ বিদেশের খবর শোনা, ম্যাডামের অনেকদিনের অভ্যাস। টিভির পর্দায় 'সি এন, এন' চালিয়ে দিয়ে পিছনের সীটে গা এলিয়ে দেন তনুশ্রী। বাড়ি পৌঁছতে ৪৫ মিনিট, এই সময়টুকু ‘অনুর দেশের’ খবর সংগ্রহ করতে ভালো লাগে তাঁর। আজ টিভিতে কি এক বিশাল মিছিল দেখাচ্ছে, সিলিকন ভ্যালীর আই টি সেক্টরের কর্মীদের মিছিল, অনেকেই দক্ষিনএশীয়। না, আমেরিকাতে গিয়েও মিছিল আর ‘জবাব চাই, জবাব দাও’ এর অভ্যেস গেল না এদের। বিরক্তমুখে মাথা নাড়লেন তিনি। ওয়ার্ক কালচারের বড় অভাব। টিভিতে খবরে বলছে এক সহকর্মীর আত্মহত্যার প্রতিবাদে মিছিল। আত্মহত্যার কারন নাকি কাজের অতিরিক্ত চাপে মানসিক অবসাদ। এবার মৃদু হেসে, টিভি বন্ধ করে দেন তনুশ্রী, কি ননসেন্স, নেই কাজ তো...। কাজের চাপ কোথায় না থাকে? আজ যদি অনিমা আত্মহত্যা করে তাকে দোষী বলে লিখে রেখে যায়? চিন্তাটার অস্বাভাবিকতায় এবার একটু জোরেই হেসে ফেললেন তনুশ্রী। ব্যাক মিররে হরেন আড় চোখে দেখে, মনে হয় ম্যাডামের আজ মুড ভালো, আজই তাহলে ছুটির কথাটা বলে নেবে।

জানালা দিয়ে রাস্তার দুধারের দৃশ্য দেখছেন তনুশ্রী, ঘরে ফেরার মানুষের ঢল, ট্র্যাফিক, হই চই, গরম হাওয়া, সবই কাঁচের ওপাড়ে, তাকে স্পর্শ না করেও উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এই জনবহুল নগরীতে একেকদিন হঠাতই বড় একা লাগে তাঁর। কি কর্মক্ষেত্রে আর কি বাড়িতে, নিজের লোক কোথায়? একমাত্র মেয়ে বিদেশে, আর স্বামী তো বিয়ের চার বছরের মাথায় পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরলোকে? আচ্ছা পরলোক বলে কি সত্যি কিছু আছে? জীবনের ওধারে আবার কোন দিন কি তাঁর ও সৌম্যর দেখা হবে? তীক্ষ্ণ মোবাইলের রিং টোন তাঁর চিন্তার ঘোর কে ছিঁড়ে দেয়। ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে নির্দিষ্ট খাপ থেকে মোবাইল বের করে ফোন ধরেন তনুশ্রী, অচেনা বিদেশী নাম্বার, হয়ত কোন আমেরিকান ক্লায়েন্ট ফার্ম
-হ্যালো
-মে আই স্পীক টু মিসেস ডাটা, নাঁকি মার্কিন উচ্চারন
-স্পীকিং
- সান জোস পোলিশ হিয়ার ম্যাডাম, অনামিকা দত্ত আপনার কে হন?
বিস্মীত তনুশ্রী, কোন ঝামেলায় জড়াল নাকি অনু? কিন্তু সেই বিস্ময় গোপন করেই বলেন,
-আমার মেয়ে
-সরি ম্যডাম, আপনাকে এই দুঃসংবাদ দেবার জন্য। আজ ভোর রাতে আমরা আপনার মেয়ের বডি তাঁর নিজের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করেছি, আত্মহত্যার ঘটনা। সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে। এখানে ওনার অফিসে খবর দেওয়া হয়েছে, দে উইল গেট ইন টাচ উইথ ইউ। আমাদের কিছু ফর্মালিটি আছে, পোস্টমর্টেমের পরে বডি হ্যান্ডওভার, কিছু ফাইলে সই, আমরা এই শোকের সময় আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আপনি যদি কোন স্থানীয় কন্ট্যাক্টকে রেফার করেন, মানে আপনার রিলেটিভ, তাহলে আমরা তাঁর সাথে যোগাযোগ করে দ্রুত ফর্মালিটিজ সেরে ফেলতে পারি। উই নীড টু ক্লোজ দি ফাইল।

একটি কথারও মানে বুঝতে পারছেন না তনুশ্রী, হ্যাঁ বা না বলার ক্ষমতাও তাঁর নেই। এঁরা কারা, কি বলছে, কোন প্র্যাঙ্ক করছে অনু? কেন? তিনি আদি অন্ত ভেবে পাননা।
-হ্যালো মিসেস ডাটা আপনি শুনতে পাচ্ছেন?
প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে কানের পর্দায় আছড়ে পড়লেও, কিছুই শুনতে পাননা তনুশ্রী। অন্যমনে ফোন কেটে দেন।
পাথরের মত বসে থাকেন, হাতে ফোন, হঠাত মনে পড়ে টিভিতে দেখা কিছুক্ষন আগের দৃশ্য;
-হরেন টিভিটা চালাও আরেকবার, প্রায় ফিসফিস করে বলেন তিনি
পৃথিবীর ওপ্রান্তে টিভির পর্দায় বিজ্ঞাপন, পৃথিবীর এপ্রান্তে তনুশ্রীর সমস্ত স্নায়ু টান টান। ঐ তো আবার, আবার সেই মিছিল, টিভির পর্দায় রিপোর্টার অনেক কিছু বলছে, কিন্তু তনুশ্রী শুধু দেখছেন পর্দার এক কোনে বক্সের ভিতরে ফ্ল্যাশ হওয়া ছবিটা, হাসি হাসি মুখে তাকে দেখছে অনু। তাঁর হাতের মোবাইল বেজেই চলে।

তিন মাস কোথা দিয়ে কেটে গেছে। বাইরে প্রবল বৃষ্টি, সল্টলেকের নিজের বাড়ির বারান্দায় বসে তনুশ্রী। তিন মাসেই যেন তিরিশ বছর বয়েস বেড়ে গেছে তাঁর। দুর্গা কখন নিঃশব্দে চা রেখে গেছে, ফিরেও দেখেন নি। দিনের আলো নিভে আসছে। আপনমনে বসে আছেন তনুশ্রী, হাতে একটা চিঠি। তাকে লেখা অনুর শেষ চিঠি। এই নিয়ে কতবার পড়লেন কে জানে! আসলে চিঠি পড়ার মত আলোই নেই, তবু তিনি পড়ছেন, মন থেকে পড়ছেন। পুরো চিঠিই তাঁর মনে গাঁথা।

মা,
আমি চললাম, আমি হেরে গেছি। কেরিয়ারের কাছে হেরে গেছি, তাঁর মানে তো জীবনের কাছেই হেরে গেছি, তাই না মা? কি হয়েছে সে সব বলে চিঠি লম্বা করতে ইচ্ছে নেই, এই প্রফেশানালিজিমের যুগে এক্সকিউজের কোন মূল্য নেই, সমস্যাটা আমার কাছে চুড়ান্ত সত্যি হলেও না। মা তাই আমি জীবনের থেকে রিজাইন করছি। আমি জানি তুমি বুঝবে। আমি এবার ঘুমাব, লম্বা নিশ্চিন্ত ঘুম। কতদিন ঘুমাই না। আসি।
তোমার অনু
পুনঃ আমার মৃত্যুর জন্য শুধু মাত্র আমি দায়ী

তনুশ্রী ভাবেন আর ভাবেন – জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে তিনিও তো জীবন ও কেরিয়ার কে এক করে ফেলেছিলেন, প্রফেশানালিজম ছিল তাঁর ধ্যান, টার্গেট পুরন একমাত্র লক্ষ্য, সেটাই সারা জীবন দেখেছে মেয়েটা, তাহলে অনুর মৃত্যুর জন্য আসলে দায়ী কে? তিনি না এই প্রফেশানাল সমাজ? দুমাস আগে আমেরিকা থেকে ফিরে, কাজ থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন তনুশ্রী; বসে বসে এই ভাবনাই এখন তাঁর শেষ পাড়ানির কড়ি।

হঠাৎ একদিন মনে পরে অনিমার কথা, অনিমাও কি হেরে গেছে? নিজেরই ছেড়ে আসা অফিসে ফোন করেন তিনি। তিথিই এখনো সেক্রেটারি, সহজেই অনিমার নাম্বারটা পাওয়া গেছে। ডায়াল করেছেন, রিং হচ্ছে অন্য পাশে, আশা ও আশংকায় ভরা তনুশ্রীর মন, অনিমার কাছে সে শুধু একটাই মিনতি করবে, অনিমা যেন হেরে না যায়।

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৮ রাত ২:১৮
১৩টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×