আজ ছুটির দিন। হাসনা বানু সকাল সকাল উঠে ঘরের কাজ শুরু করে দিয়েছে। ঘর ঝাড়পোছ দেয়া শেষ। রান্নার আয়োজন করছে। আজ ছুটির দিন উপলক্ষে বিশেষ খাবার দাবার হবে। মুরগী আর এক কেজি পোলাওর চাল আনা হয়েছে। মাসে একবার ওদের পোলাও মুরগীর ব্যবস্থা হয়। হাসনা হাঁক পাড়ে 'কইরে আমেনা মা। আয় একটু হাত লাগা। বিকালে আবার কামে যাইতে হইব।' আমেনা এসে মায়ের সাথে হাত লাগায়। হাসনার দুই ছেলেমেয়ে। আমেনা আর রাসেল। আমেনা এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। হাসনা শখ করে মেয়েকে বিজ্ঞান বিভাগে দিয়েছে। এই মেয়েকে নিয়েই তার যত স্বপ্ন। মেয়েকে অনেক বড় মানুষ বানাবে। ছেলেটার পড়াশোনায় মন নেই। টেনেটুনে ক্লাস ফাইভ পাস করে আর পড়েনি। এখন দিনমজুরের কাজ করে। তার স্বামী গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করে। সে নিজে একটা স্কুলে আয়ার কাজ করে। থাকে নারায়ণগঞ্জের এক বস্তিতে। স্বামী যে টাকা আয় করে তা দিয়ে ঘরভাড়া আর মাসের বড় বাজার হয়। তার নিজের টাকায় টুকিটাকি বাজার আর মেয়ের পড়ার খরচ চলে। মাসে কিছু টাকা পোস্ট অফিসে জমা করে ভবিষ্যতের জন্য। এভাবেই চলে তাদের সংসার।
মা মেয়ে কাজ করে আর কুটুর কুটুর গল্প করে।
'মরিয়ম মিসে বাসা বদলাইব। আমারে বিকালে যাইতে কইসে। দুই দিন কাম করলেই দেখবি ৫০০ টাকা হাতে ধরাই দিসে। মিসে এতো ভালা। তোরে এনাদের মতন বড় মানুষ বানামু। একটু ভালামতন পড়। দেখিস তুইও একদিন এই মিসেগো মতন বড় কোন স্কুলে চাকরি করবি।'
হাসনার স্বপ্নাতুর চোখ দুটো চকচক করে। আমেনা তরকারি কুটে আর মায়ের স্কুলের গল্প শোনে।
'ওইদিন তোর কি জ্বর আইসিলো মনে আসে? তোর তো কোন হুশ জ্ঞান আসিলনা। আমার তো পুরা মাতা খারাপের মত অবস্থা। তোরে হাসপাতালে নিতে অইব। হাতে একটা টাকাও নাই। মিসেরে যাইয়া কইতেই লগে লগে সব মিসের থে ২০০ টাকা কইরা নিয়া দিল। আমার ভাগ্য আসলেই ভালা রে। স্কুলের নিচের তালার রহিমার মিসেরা বোলে ঈদে চান্দেও ঠিকমত বকশিস দেয়না।'
আমেনা মায়ের ভালো ভাগ্যের নজির দেখে মুখে হাসি টেনে রাখে। মায়ের এই স্কুলের বদৌলতে তার পড়াশোনা এখনো চলছে। তারা মাসে একটা দিন অন্তত ভালো খানাপিনা করতে পারে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারে।
সেদিন স্কুলে গিয়ে কাজের ফাঁকে টিচার্স রুমে ঢুকে হাসনা সাবা মিসকে পোস্ট অফিসের জমার বই লিখে দিতে বলে। সে তো লিখতে পড়তে পারেনা। শুধু কোনমতে নিজের নাম লিখতে পারে। সাবা মিস লেখে আর নিজের মনে হাসে। তার স্বল্প বেতনের চাকরি। মাস শেষে এক টাকাও হাতে থাকেনা। কোনমতে হাত খরচ চলে যায়। টাকা জমানোর জো নেই। অথচ স্কুলের আয়া প্রতিমাসে পোস্ট অফিসে টাকা জমায়। দেশ তাহলে মনে হয় ভালোই এগুচ্ছে। এত নিম্ন আয়ের মানুষও ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে। পরিকল্পনা মাফিক জীবন যাপন করে। লিখতে দিয়ে হাসনা গল্প করে যায়।
'জানেন মিস আমার মেয়ে এবার ক্লাস নাইনে উঠসে। সাইন্সে দিসি। অরে আপনেগো মতন শিক্ষিত বানামু। সাইন্সের দীপা মিসে কইসে অরে প্রাইভেট পড়াইবো। টাকা নিব না। মিসের মাইয়াও তো নাইনে পড়ে।'
বলতে বলতে হাসনার চোখ কৃতজ্ঞতার জলে ভরে যায়।
রাসেল আর তার বাবা জুমার নামাজ পড়ে এলে সবাইকে খাবার বেড়ে দিয়ে হাসনা পাশে বসে। কারো কিছু লাগলে তুলে দিচ্ছে। আমেনার বাবা গপাগপ খাচ্ছে। হাসনা ভাবে 'আহা বেচারা! সবদিন তো ভালো খাবার পায়না। পেট পুরে খাক।' সে মুগ্ধ হয়ে সবার খাবার দেখে। মানুষগুলোকে বড় ভালোবাসে সে। সবার খাওয়া শেষে সে নিজে খেতে বসে। অল্পই খাবার বেঁচেছে তার জন্য। আমেনার বাবা বিব্রত হয়। বলে 'তোর জন্য তো কিছুই থাকল না আমেনার মা। খাইতে খাইতে খেয়ালই আসিল না তোর তো এখনো খাওয়া হয় নাই।' হাসনা মুচকি হেসে বলে 'আপনেরা খাইসেন তাতেই আমার পেট ভইরা গেসে। যা আসে আমার তাতেই চলবে।' এই বলে সে হাঁড়ির শেষ খাবারটুকু তুলে খেয়ে নেয়। ভাতঘুম না দিয়েই মরিয়ম মিসের বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। নাহয় কাজ শেষ করা যাবেনা। বেশী রাত করে ফিরলে পরেরদিন সকালে স্কুলে যেতে দেরী হয়ে যাবে। তখন আবার অর্ধদিনের বেতন কাটা যাবে।
কাজ শেষে বস্তিতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। ক্লান্ত শ্রান্ত হাসনা বাসায় ফিরে দেখে ঘরে এখনো আলো জ্বলেনি। আমেনা কি তাহলে এখনো ফেরেনি! বিকালে দীপা মিসের বাসায় প্রাইভেট পড়তে গিয়েছিল। কিন্তু এতক্ষণে তো ফিরে আসার কথা। আমেনার বাবা আর রাসেলের ফিরতে এমনিতেই রাত হয়। হাসনা আলো জ্বেলে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। কখন যে ঘুম এসে পড়েছে টেরই পায়নি। খারাপ স্বপ্ন দেখে আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। 'আমেনা, আমেনা' বলে ডাক দেয়। মেয়েটা এখনো আসেনি? রাত আটটা বেজে গেল। মায়ের মনে কু ডাক দিচ্ছে। কোন বিপদ আপদ হল না তো? নাহ আর বসে থাকা যায়না। হাসনা কাপড় বদলে বেরিয়ে পড়ে। দীপা মিসের বাসায় খবর নিতে হবে। তাদের বস্তি থেকে মিসের বাসা আধঘণ্টা হাঁটার পথ। সে যতটা দ্রুত সম্ভব হাঁটে। মনের মধ্যে যতসব উল্টাপাল্টা চিন্তা ভর করছে। অবশেষে পৌঁছে যায় গন্তব্যস্থলে। জিজ্ঞেস করতেই দীপা মিসের মেয়ে জানায় আমেনা তো সেই মাগরিবের আজানের আগেই বেরিয়ে গেছে। হাসনার মাথায় তো বাজ পড়ে। তবে কি তার দুশ্চিন্তাই ঠিক? মেয়েটা কোন বিপদে পড়ল। সে পাগলের মত বেরিয়ে পড়ল।
আশেপাশের বস্তিতে, আমেনার বান্ধবীদের বাড়িতে খোঁজ করল। নাহ, কোথাও নেই। হাঁটতে হাঁটতে সে বাজারের পাশে বড় রাস্তায় এসে পড়ল। উন্মাদের মত হাঁটছে। হঠাৎ চোখে পড়ল দূরে রাস্তার পাশে কিছু একটা পড়ে আছে। সে দুরুদুরু বুকে দৌড়ে কাছে চলে গেল। একটা মেয়ের ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে আছে। কোন গাড়ি চাপা দিয়ে চলে গেছে। রক্তগুলো প্রায় শুকিয়ে এসেছে। গায়ের জামাটা পরিচিত লাগছে না? হ্যাঁ, এটাই তো সে গত ঈদে আমেনাকে কিনে দিয়েছিল। মেয়েটা প্রথম দিন প্রাইভেট পড়তে যাবে তাই শখ করে পরেছিল। একপায়ে নিউ মার্কেট থেকে কেনা সেই জুতাজোড়ার একপাটি না? মেয়েটা পছন্দ করে কিনেছিল। হ্যাঁ, এটা তার আমেনাই। হাসনা ধীরপায়ে কাছে গিয়ে আমেনার রক্তাক্ত মাথা কোলে নেয়। কোন বেপরোয়া বাস, ট্রাক কিংবা কার তার স্বপ্নকে রক্তে মেখে দিয়েছে। আর তার আদরের দুলালী তার সাথে বসে গল্প করবেনা। আর বেণী দুলিয়ে স্কুলে যাবেনা। আর তার মেয়েকে স্কুলের মিসদের মত শিক্ষিত করা হবেনা। আর কিছু হবেনা। হাসনা মেয়েকে বুকে নিয়ে ধূসর চোখে দূরে, অনেক দূরে তাকিয়ে আছে। সে চোখে আজ আর স্বপ্নেরা খেলা করছে না। তার ভবিষ্যৎ, তার স্বপ্ন আজ রক্তে মাখামাখি।।
১০.০১.২০১৭
ছবি: মোবাইলোগ্রাফি