somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ড্রাইভ টু নাজরান (আরব ডায়েরি-৮১)

১৭ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গত বছর আমরা কয়েকজন মিলে নাজরান ভ্রমণে গিয়েছিলাম। দারূণ একটি ভ্রমণ ছিল। নাজরান বাঁধ, আল-উখদুদ ও বির-হিমা দেখতে গিয়েছিলাম। ‘বির হিমা’ সংলগ্ন পাহাড়ে প্রায় ৫-৯ হাজার বছর পুরনো বিভিন্ন সময়ের ছবি ও লিপি পাওয়া গেছে। সেখানে ৬ টি প্রাচীন কুয়াও আছে।

আমাদের ঐ ভ্রমণে হাবিব স্যার, উসামা ও কচি ভাই ছিলেন না। যদিও উসামা ও হাবিব স্যার নাজরান গিয়েছিলেন কিন্তু ওনারা ‘বির হিমা’ যাননি। ওনাদের ভ্রমণ নাজরান শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই তাঁরা সবাই চাচ্ছিলেন আবার নাজরান যাবেন, ‘বির হিমা’ ঘুরে আসবেন। আমাকে গাইড করতে বললেন। আমিও স্বানন্দে রাজী হয়ে গেলাম। উসামা’র বাচ্চা রাফসানের তখন মাত্র ৩ মাস বয়স। উসামা’র ওয়াইফ অরণীকে বললাম, ‘একটু পাহাড়ের নিচে যাওয়া দরকার, রাফসানকে ফ্রেশ অক্সিজেন খাইয়ে আনি।’ কিন্তু একটু ধাক্কা পেলাম যখন উসামা বলল, যার যার গাড়ী নিয়ে যেতে হবে। আমি মোটে নতুন ড্রাইভ করছি, আমার দৌড় বড়জোড় বাসা থেকে সর্বোচ্চ শাকিলা’র ক্যাম্পাস পর্যন্ত। এই আমাকে নাকি ১ দিনে নাজরান গিয়ে ফিরে আসতে হবে- ৯০০ কিমি ভ্রমণের দুঃস্বপ্ন।

আমারও মন চাচ্ছিল- একটা লং ট্যুরে বের হই। অনেক দিন থেকেই বাসায় বসে বসে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। কাহাতক আর বাসার পাশের পার্কে ঘুরাঘুরি ভালো লাগে? কিন্তু সহস পাচ্ছিলাম না। উসামা ও শাকিলা’র সাহসে নাজরান ড্রাইভ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। কচি ভাইও আমারই মতো, নতুন গাড়ী চালাচ্ছেন। শুধুমাত্র এক্সপেরিয়েন্স ও আনন্দের জন্য আমাদের সাথে যোগ দিলেন।

আমি উসামাকে খুব ভালোভাবে জানিয়ে দিলাম- কোনমতেই ড্রাইভিং স্পিড ১০০’র বেশী উঠানো যাবেনা। যদি তা হয় আমি মাঝ পথ থেকে আবহা ব্যাক করব। উসামা হাসল। এক শুক্রবার সকালে আমরা নাজরান রওনা দিলাম।

আমরা ৩ টি গাড়ী নিয়ে নাজরানের পথে চলছি। আমার গাড়ীতে আমি, শাকিলা, দীবা ও মোশতাক ভাই। কচি ভাইয়ের গাড়ীতে কচি ভাইয়ের ফ্যামিলি (রেশমা আপা ও বাচ্চারা) ও মামুন। ওদিকে উসামা’র গাড়ীতে উসামার ফ্যামিলি (অরণী ও বাচ্চা) ও হাবিব স্যার উঠেছে।

উসামাকে সামনে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম। আমার গাড়ী মাঝখানে, পেছনে কচি ভাই। শুক্রবার, তাই রাস্তাঘাট ফাঁকা। আবহা থেকে বের হতেই পাহাড়ী রাস্তার কারনে সূর্য একেবারে চোখের সামনে চলে আসল। তাকাতে পারিনা, সানগ্লাসেও কাজ হয় না, এতটাই তীব্রতা। কোনভাবে জায়গাটুকো পার হয়ে গেলাম। আমাদের আশেপাশে তখন পাহাড়ের রং পাল্টাচ্ছে। পাহাড়ের লালচে রং কেমন যেন ভেংচি কাটছে।

উসামার সাথে কথা ছিল ১০০’র বেশী স্পিড উঠানো যাবেনা। দেখলাম সে হঠাৎ করেই ১০০’র বেশী উঠিয়ে ফেলল। আমিও একটু গতি বাড়ালাম। আমার গতি বাড়ানো দেখে সে আরেকটু বাড়াল। একটা চক্রের মতো- “পাঠক বই কিনেনা বিধায় প্রকাশক বইয়ের দাম কমাতে পারে না, আবার প্রকাশক বইয়ের দাম কমায় না বলে পাঠক বই কিনতে পারে না।” এভাবে করতে করতে দেখা গেল আমরা দু’জনেই ১৫০ এ চালাচ্ছি। পেছনে দেখি কচি ভাইয়ের কোন খোঁজ নেই। মিনিট পাঁচেক পরে কচি ভাইয়ের গাড়ী ১৬০ গতিতে আমাকে অতিক্রম করল। ওভারটেক করার সময় আমাকে টাটা জানিয়ে গেল। কচি ভাইয়ের গাড়ীতে স্পোর্টস অপশন আছে, তাই সাময়িকভাবে পিছিয়ে পড়লেও আমাদেরকে ধরে ফেলতে সময় লাগেনি। আমাদের এই বন্য রেস দেখে শাকিলা চেচামেচি শুরু করল। আমরা নাকি উড়ে উড়ে যাচ্ছি, ড্রাইভিং সিটে বসে আমি অবশ্য তা বুঝতেই পারিনি। ঘন্টা দেড়েকের মাথায় আমরা “দাহরান আল জুনুব” পৌছে গেলাম। সবাই একটা গ্যাস স্টেশনে থামলাম সকালের নাস্তা খাবার জন্য।

“দাহরান আল জুনুব” ঐতিহাসিক কারনে বিখ্যাত। আবিসিনিয়ার রাজা আবরাহা এখানকার একটি পথ দিয়ে তার হস্তী বাহিনী মক্কার দিকে পরিচালিত করেন। উদ্দেশ্য ছিল পবিত্র কাবা শরীফ ধ্বংস করা। আল্লাহ সামান্য আবাবিল পাখির মাধ্যমে পুরো বাহিনীকে ধ্বংস করে দেন। এই পথটি “দাহরান আল জুনুব” এ চিহ্নিত করা আছে যা তরিক ফিল বা Elephant Road নামে সুপরিচিত। পবিত্র কোরআনের “সুরা ফিল” এ ঘটনাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। বেশ কিছুদিন আগে হাবীব স্যার, সাইফুল আসপিয়া ভাই ও উসামা জায়গাটি ঘুরে গেছে। আমার খুব ইচ্ছে হল Elephant Road টি দেখার। কিন্তু সময় স্বল্পতা ও সেখানে যাবার রাস্তাটি দূর্গম হবার কারনে আপাতত ইচ্ছেটি বাদ দিতে হল। পরে সময় সুযোগ বুঝে সেখানে যাওয়া যাবে।

চিকেন স্যান্ডউইচ ও চা দিয়ে নাস্তা শেষে আমরা আবার নাজরানের পথ ধরলাম। গাড়ীর গতি ১২০/১৩০ এর মাঝেই থাকল। গতি নিয়ে আমার ভয়টা কেটে গেছে, ড্রাইভিং উপভোগ করতে থাকলাম। ২ ঘন্টা পরে আমরা নাজরান শহরে পৌছে যাই। শহরে না থেমে আমরা ১৫০ কি.মি. দূরের বির হিমা’র দিকে রওনা হলাম। বিখ্যাত রুব-আল-খালি’র মাঝ দিয়ে বির হিমা’র রোড টি চলে গেছে। দু’পাশে ধু ধু মরুভুমি। রাস্তায় গাড়ী নেই বললেই চলে। আমরা জিপিএস এর সাহায্যে এগিয়ে চলছি। কখন যে স্পিডের কাটা ১৬০ হয়ে গেল, বলতেই পারব না। কচি ভাই আমাদের এই ছেলেমানুষি বরদাশত করলেন না, উনি ১৮০ গতিতে ছুটলেন।

বির হিমা’র কিছুটা আগে আমরা মরুভুমিতে গোল বাঙ্গি টাইপ ফল দেখতে পেলাম। আমরাও গাড়ী থামিয়ে হুড়মুড় করে বালিতে নেমে যাই। সবাই যেন কতদিন পর মুক্তির আনন্দে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পরে জানতে পারি ফলটির নাম ছিল “হানজাল”, বেজায় তেতো। গতবারের মত এবার বির হিমা’র রাস্তা চিনে নিতে কষ্ট হল না। আমার একটি ভালো দিক হচ্ছে কোন রাস্তা দিয়ে একবার গেলে তা সহজে ভুলি না।


বির হিমা’র পথে (ছবিঃ হাবিব স্যার)


“হানজাল” এর খোঁজে আমরা (ছবিঃ হাবিব স্যার)


“হানজাল” ও রাফসান

বির হিমা’র ৬ টি কুয়া আগের মতোই আছে। আমার তেমন তাড়াহুড়া নেই। বাকী সবাই কুয়াগুলো দেখতে লাগল, ছবি তুলল। হাবীব স্যার ও মামুন পাশেই একটি পাহাড়ের উপর উঠে গেল। ওখান থেকে নাকি মরুদ্যানটির দারূণ এক ভিউ দেখা গিয়েছিল। অন্যদের কথা জানিনা- এটাই ছিল আমার ও শাকিলা দেখা প্রথম মরুদ্যান। এখন কিছুটা বিবর্ণ হয়ে গেলেও একসময় যে এটা প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। এই মরুদ্যানকে কেন্দ্র করে যে সুপ্রাচীনকালে সভ্য মানব বসতি গড়ে উঠেছিল তার প্রমাণ আশেপাশের পাহাড়ে খোদিত আছে। সবাইকে নিয়ে পাহাড়ে অংকিত লিপি ও ছবি দেখতে গেলাম । জায়গাটা ঘেরাও করা। তারপরও ফাঁকফোকড় গলে সবাই পাহাড়ের কাছে চলে গেল। বীর হিমা’য় ঘন্টা খানেকের মতো থেকে নাজরান শহরের দিকে রওনা দেই। এখানে বির হিমা নিয়ে বিস্তারিত লিখলাম না। আপনারা আমার আগের লেখাটি পড়ে নিতে পারেন।




বির হিমা

আমাদের সবারই ক্ষুধা লেগে গিয়েছিল। নাজরান শহরে থেমে খাবার কিনে নিলাম। আসরের সময়, নামাজের কারনে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে তাই খাবার কিনে সাথে নিয়ে নিতে হল। গাড়ী নিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। খাবার খাওয়ার জন্য কোন পার্ক বা পছন্দসই জায়গা পাচ্ছি না। এদিকে পেট চো চো করছে। অনেক পরে মরুভুমির মাঝে কিছু গাছ দেখতে পেয়ে সেখানেই গাড়ী থেকে নেমে পড়লাম। গাছগুলোর কাছে যেতেই মন জুড়িয়ে গেল। চারদিকে গাছ ঘিরে মাঝখানে একাটা বৃত্তের মতো তৈরি হয়েছে, ছায়াময় একটা জায়গা। মরুভুমিতে এধরনের গাছের ঝোপ অনেক দেখা যায়। এর আগে কখনো কাছে গিয়ে দেখিনি। আমরা সেখানে মাদুর বিছিয়ে বসলাম। খাবারের বিপুল সমারোহ। চিকেন ও মাছের আল-ফাহাম। ক্ষুধা পেটে সবাই গোগ্রাসে খেলাম। মনে হল কতদিন এমন মজার খাবার খাইনি। তখন পড়ন্ত বিকেল, ঠান্ডা বাতাস বইছিল। রাফসানকে বেশী করে ফ্রেশ অক্সিজেন খাওয়ালাম। যাও ব্যাটা, আগামী ৬ মাস তুমি নিশ্চিন্ত।


এখানেই খেলাম (ছবিঃ হাবিব স্যার)

ভেবেছিলাম রাতে ড্রাইভ করে ফেরাটা হয়তো আমার জন্য কষ্টের হবে। কিন্তু তা হয়নি। বেশ ভালোভাবেই আবহা পৌছে যাই। একদম নতুম অবস্থায় ৯০০ কিলো ড্রাইভের স্মৃতি এখনো আমাকে আপ্লুত করে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ২:১১
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×