somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আরবে রমাদান (আরব ডায়েরি-১১২)

১৪ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



হিজরি হচ্ছে চন্দ্রবর্ষ অপরদিকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার সৌরবর্ষ। প্রতিবছর জুন মাসে সৌদি আরবের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়। আমরা ২ মাসের গ্রীষ্মকালীন ছুটি পাই যা ঈদসহ আড়াই থেকে তিন মাস হত। চন্দ্রবর্ষ আর সৌরবর্ষের মাঝে ১০ দিনের গ্যাপ আছে। তাই ক্রমেক্রমে রমাদান মাস এগিয়ে এসে জুন মাসে ঠেকেছে। এর আগে ছুটিতে দেশে গিয়ে রমাদান মাস পেতাম। এখন গত বছর হতে রমাদান মাসের অনেকটা সময় সৌদি আরবেই থাকতে হচ্ছে।

এই দুই বছরে আরবে এই ধর্মীয় মাসকে খুব কাছ হতে দেখেছি। সবার লেখাই থাকে একপাক্ষিক। হয় সব ভালো, নয় সব খারাপ। কিন্তু আমি যেমনটা পেয়েছি, আজ তারই কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করব।

আরবরা রমাদান মাসে হুট করেই রোজা রাখা শুরু করে না। তারা এর পূর্ববর্তী মাস শাবান হতেই এর প্রস্তুতি নিতে থাকে। আরবরা সপ্তাহের সোমবার এবং বৃহঃবার, পাশাপাশি মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোজা রেখে নিজেকে ঝালিয়ে নেয়। হাদীসে এই সময়গুলোতে রোজা রাখার নির্দেশনা রয়েছে। ফলে রমাদান মাসে সুদীর্ঘ ৩০ দিন একটানা রোজা রাখায় অভ্যস্ত হতে সময় লাগে না।

রমাদান মাস শুরু হবার সাথে সাথেই সুপার শপগুলোতে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্যে ডিসকাউন্ট থাকে। সেহরির সময়ের পূর্ব পর্যন্ত মার্কেটে লোকজনের সমাগম চোখে পড়ার মত। আরবরা এত পরিমাণ খাবার কেনে যা নিতান্তই অপচয়। যাদের ছুটি থাকে, বেশীরভাগ মানুষই সারারাত ঘুরে বেড়িয়ে দিনের বেলায় নামাজের সময়টুকো বাদে ঘুমিয়ে কাটায়। রমাদান মাস সংযমের নির্দেশনা দিলেও সত্যিকার অর্থে সংযম দেখতে পাওয়া যায় না। আলো ঝলমলে নগরীতে আরব মেয়েদের কোলাহলে শপিং সেন্টারে গভীর রাত হয়েছে কিনা, তা আর বুঝার উপায় নাই।


ছবিঃ ইন্টারনেট

আরবরা এই সময়টাকে দান খয়রাত ও সদাকার জন্য বেছে নেয়। এ প্রসঙ্গে একটি হাদীস বলতেই হচ্ছে-
ইবনে আব্বাস বলেন, আদম সন্তানের দেহে তিনশত ষাটটি সংযোগ অস্থি বা গ্রন্থি আছে। প্রতিদিন সেগুলোর প্রতিটির জন্য একটি সদাকা ধার্য আছে। প্রতিটি উত্তম কথা একটি সদাকা। কোন ব্যক্তির তার ভাইকে সাহায্য করাও একটি সদাকা। কেউ কাউকে পানি পান করালে তাও একটি সদাকা এবং রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানোও একটি সদাকা।

মানুষকে পানি পান করানো অন্যতম বড় সদাকা। মসজিদগুলোতে নামাজীদের জন্য পানির স্তুপ দেখা যায়, অথবা ট্রাফিক স্যিগনালগুলোতে ছোট এক প্যাকেট খেজুড় ও এক বোতল পানি সব গাড়িতে দেয়া হয়। মানুষ খুশী মনে তা গ্রহণ করে। অনেক সৌদি রাস্তার পরিচ্ছন্নকর্মীদেরকে গাড়ী হতে মুঠো ভর্তি রিয়াল গছিয়ে দেয়। আর এই সদাকার জন্য অনেক বিদেশি অপকর্ম করে থাকে। ট্রাফিক স্যিগনালে গাড়ী থামলে সৌদিরা সদাকা দেয়ার জন্য পরিচ্ছন্নকর্মীদেরকে ডেকে নেয়। তাই ট্রাফিক স্যিগনালগুলো রমাদান মাসে হয়ে উঠে আয়ের অন্যতম উৎস। বিদেশিরা তার ম্যানেজারকে অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে ট্রাফিক স্যিগনালগুলোতে কাজ নেয়। একেকজন এই সময়ে ৩/৪ লাখ টাকা আয় করে।


ছবিঃ ইন্টারনেট

ইফতারের আগে আগে সৌদিরা যেন পাগল হয়ে যায়। সবাই এক সাথে খাবার কিনতে রাস্তায় বের হয়। ফলে রাস্তায় লেগে যায় দীর্ঘ জ্যাম। দ্রুত ও রং পার্কিংয়ের কারনে অনেক এক্সিডেন্টও হয়। আরবদের খাবার তালিকায় অনেক পানীয় থাকে যা মূলতঃ অনেক স্বাস্থ্যকর। অথচ আমাদের দেশের খাবার তালিকায় ভাজাপোড়া না থাকলে চলেই না। আরবরা ইফতারে খেজুর এবং ‘সুরবা’ বা একধরণের স্যুপ খাবেই। এছাড়া বিভিন্ন রকম ফল, জ্যুস, লাবান থাকে। ভাজা খাবারের মাঝে তারা মাংসের সমুচা খায়। কখনো কখনো মাংসের ঝোল দিয়ে রুটি খেয়ে থাকে।

বড় বড় মসজিদের পাশে তাবু টানিয়ে তাতে সবার জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। এলাকার সৌদিরা বা কোন প্রতিষ্ঠান সারা মাস জুড়ে এই ইফতারের খরচ বহন করে থাকে। তবে একটা বিষয় লক্ষনীয়, কিছু ব্যতিক্রম বাদে এসব তাবুতে শুধুমাত্র খেটে খাওয়া বিদেশীরা অংশগ্রহণ করে থাকে, এসব তাবুতে সৌদিদের দেখা যায় না। হয়তো এখানেও রয়েছে অদৃশ্য বৈষম্য।


মসজিদে ইফতার

কয়েকদিন আগে আমরা কয়েকজন আবহা হতে ৩০ কিমি দূরের একটি গ্রামে গিয়েছিলাম পিকনিক করতে। পাহাড়ঘেরা নির্জন জায়গায় সুদৃশ্য মসজিদ দেখে অবাকই হলাম। ইফতারের সময় হতেই মসজিদে গ্রামের বিভিন্ন বাসা হতে খাবার আসতে থাকল- নানারকম আইটেম। আমরাও এলাকার অন্যান্য বিদেশীদের সাথে সেখানে যোগদান করলাম। সৌদিরা নিজ হাতে সবাইকে খাবার তুলে দিল, নিজেরা খেল। এটাই হচ্ছে প্রকৃত ভাতৃত্ববোধ। দারূণ মজাদার ও লোভনীয় ইফতার খেয়ে আমাদের নিজেদের রান্না করা খাবার শেষ করতে কষ্ট হয়েছিল।


গ্রামের মসজিদে বাহারি ইফতার

আমাদের আবহায় আমরা দেখতে পাই, সৌদিরা ইফতারের আগে আগে খাবার নিয়ে ফ্যামিলি বা বন্ধু সহ কোন পাহাড়ের চূড়ায় চলে যায়। সেখানে সবাই মিলে সময়টা উপভোগ করে, একসাথে খাওয়াদাওয়া শেষে বাড়ী ফিরে। কখনো কখনো রান্নাও করে থাকে।
আমরা বন্ধুরাও বেশ কয়েকদিন পাহাড়ের গহীনে এবং পাহাড় চূড়ায় একসাথে ইফতার করলাম। ইফতারে ফল ও আমাদের দেশী আইটেমগুলো ছিল। এখানে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে দেশের সব আইটেমই পাওয়া যায়। দুইদিন বাহিরে রান্নাও করলাম। সবাই একসাথে, নিজ হাতে তৈরি করা খাবার দিয়ে ইফতারের আনন্দ বুঝানো যাবেনা।




আমাদের ইফতার


আমাদের রান্না

রমাদান মাসের কথা আসলেই তারাবি’র প্রসঙ্গ আসে। সমগ্র সৌদি আরব জুড়ে ৮ রাকাত তারাবি’র নামাজ পড়া হয় এবং এটাই সুন্নাহ। প্রশ্ন আসতে পারে মক্কা, মদীনার মসজিদুল হারাম এবং কয়েকটি মসজিদে কেন ৮ রাকাতের অধিক তারাবি পরানো হচ্ছে? প্রকৃত কারণ হচ্ছে-মক্কা ও মদীনা ছিল ৭০০/৮০০ বছরের তুর্কি শাসনের পাওয়ার হাউজ। তুর্কি আমলে এমন কিছু ধর্মীয় আচার চালু হয়েছিল যা সহজেই পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। এক সময় কাবা প্রাঙ্গনে ৪ টি প্রধান মাযহাব আলাদা আলাদাভাবে নামাজ পড়ত। তারাবি’র নামাজও মক্কা/মদীনায় ২০ বা তারো অধিক রাকাত পড়া হচ্ছে যা বন্ধ করলে অধিক ফিতনা সৃষ্টি হবে এই আশংকায় সহসাই বন্ধ করা যাচ্ছে না। তবে এটা ঠিক যে ৮ রাকাত পর্যন্ত সুন্নাহ হলেও এর বেশী নামাজ পড়া যেতে পারে, এটা নিয়ে কোন মতবিরোধ নেই। তাই মসজিদুল হারামাইনে অধিক নামাজ পড়া নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই।

সৌদি আরবে রমাদান মাসে কেউ না খেয়ে আছে তা ভাবাই যায় না। রাস্তায় ফলের গাড়ী, কিংবা ইফতারের আইটেম দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। কেউ ইফতার করছে, আপনি পাশ দিয়ে দৌড়ে বাসায় ফিরছেন অথচ আপনাকে ইফতারের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, এ দৃশ্য কখনোই ঘটবে না।

এখানে রয়েছে বিশেষ রহমত। তারা যতটুকোই আমল করে বিশুদ্ধভাবে শিরকমুক্ত ঈবাদত করে।


সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৮
২১টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×