১.
শামসুল আলম স্যারের কক্ষে কী একটা স্বাক্ষর নিতে গিয়েছিলাম একবার৷ আপনারা খেয়াল করবেন, আমি সিগনেচার না বলে স্বাক্ষর বলেছি, রুমে না বলে কক্ষে বলেছি! কারণ এই শব্দচয়ন বিপত্তি! তো স্বাক্ষর নেবার সময় উনি আরেকজন শিক্ষক সম্পর্কে জানতে চাইলেন, ওই শিক্ষক তখন অসুস্থ ছিলেন৷ আমি জানালাম, উনি এখন শয্যাশায়ী!
ব্যস, স্যার মাইন্ড করলেন, চোখ সরু করে চশমার ফাঁক দিয়ে বললেন, তুমি শয্যাশায়ী কেন বললে? এভাবে অবজ্ঞা করে তো একজন শিক্ষক সম্বন্ধে তুমি কথা বলতে পার না!
আমি ততক্ষণে তব্দা খেয়ে গেছি, মিনমিন করে বললাম, দুঃখিত স্যার, সবাই এভাবেই বলে তো, আমিও তাই.….
স্যার ধমক দিয়ে বললেন, সবাই তো বাংলা নিয়ে পড়ছে না, তুমি তো আর সবার মত যা তা শব্দ চয়ন করতে পারো না!
আমি তখন মনে মনে মাইল্লেফিরে বলছি, ভুলটা কোথায় হল তখনও ধরতে পারছি না! তখন স্যার বললেন, শয্যাশায়ী শব্দটা ধরাশায়ী ভূপাতিত এমন ইঙ্গিত করে, তুমি শয্যাসীন বলতে পারতে!
২.
শোরুম পরিলচালনা করতাম যখন, তখন একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এলেন একটি প্রোডাক্ট কিনতে৷ উনি সিভিল ড্রেসে এসেছেন, তাই প্রথমেই পরিচয় দিয়ে নিলেন এবং উনি যে প্রোডাক্ট সম্পর্কে আগেই স্টাডি করে এসেছেন, সেটা উনার প্রোডাক্ট খোঁজার ভঙ্গিতেই বোঝা গেল৷ উনি শুধু প্রোডাক্টটা সিলেক্ট করে বললেন, এটা নেব৷ আমার সেলসম্যান বলল, ঠিক আছে, স্যার, প্যাক করে দিচ্ছি!
উনি বললেন, তার আগে আমাকে একটু প্যাকেটটা খুলে দেখান!
আমার সেলসম্যান বলল, অরিজিনাল শোরুমে এসেছেন স্যার, কনফিউজড হলে হবে!
এইবার দেখে কে! লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাহেব তো চেঁচিয়ে ফেটে পড়লেন, হাউ ডেয়ার ইউ! ঝুলিয়ে পিটাবো একদম, আমি তোমাকে আগেই বলেছি আমি একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল!
আমি ক্যাশে টাকা গুণছিলাম, দ্রুত উঠে এসে ওকে সরিয়ে দিলাম৷ হাসিমুখে কথা বলে বিক্রি শেষ করলাম৷
উনি যাবার পর আমার সেলসম্যান ফ্যালফ্যালে চোখে আমাকে প্রশ্ন করল, স্যার, আমি কী ভুল করলাম যে এত রেগে গেল??
বললাম, আরে বলদ, তুই তারে কনফিউজড শব্দটা কেন বলতে গেলি! কোন হুঁশজ্ঞানওয়ালা মানুষ কনফিউজড হয় না, কনফিউজড হয় বলদে!
৩.
একবার এক ডিলারকে কোনভাবেই পাচ্ছি না, না ফোনে, না সাক্ষাতে৷ পরে ম্যানেজারকে বলে রেখেছিলাম, এলে একটু আমার সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দিতে! তো ফোনে কথা বলিয়ে দেবার সময় আমি ডিলারকে বলতে চাইলাম, আপনাকে তো কোনভাবেই রীচ করা যায় না... এই রীচ করা শব্দটা না বলে যেহেতু আমার শুদ্ধ বাংলা বলার বাতিক আছে, আমি তাৎক্ষণিক তর্জমায় বলে বসলাম, আপনাকে তো কোনভাবেই ধরা যাচ্ছে না...
এটুকু বলে আমিও থমকালাম, উনিও থমকালেন! অবশ্য সাথে সাথেই অন্য কথা দিয়ে পরিস্থিতি অনুকূল করেছিলাম, কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুবই লজ্জা পাচ্ছিলাম, যে কী বলতে কী বলে ফেললাম!
যদি এখনও কেউ না বুঝে থাকেন, তাহলে বলি, উনি তো কোন চোর নন, বা লুকিয়ে থাকার নন যে আমার উনাকে ধরতে যেতে হবে! আমি সঠিক বাংলায় উনাকে বলতে পারতাম, কোনভাবেই আপনার নাগাল বা সাক্ষাৎ পাচ্ছি না....
৪.
একসময় শিক্ষকতায় ছিলাম, তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চিন্তার প্যাটার্ন অনুকরণ করতে গিয়ে এই শব্দ প্রয়োগের ব্যাপারটা আমার মাথাতেও প্রবলভাবে গেঁথে গেছে! আমাকেও কেউ কিছু বলার ক্ষেত্রে কোন শব্দ দিয়ে বলছে আমি সচেতনভাবে খেয়াল করি! কোন বলদ জুনিয়র যদি তার বসকে কমেন্ট করে, গুডজব, তাহলে অবস্থাটা কেমন হতে পারে নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন! আরো অনেক উদাহরণ আছে বলার মত, থাক নাহয়৷
শব্দের মানদণ্ড অবশ্যই আছে৷ সব শব্দ সবখানে বলা যায় না৷ ম্যাজিস্ট্রেটকে হোল্ড অন বলাতে উনি রাগ করেছেন, কাহিনি হল, যে ইংরেজির আশ্রয় ওই প্রবীণ ব্যবসায়ী নিয়েছেন, সেই ইংরেজিতে একজন ইংরেজ পথচারী তার প্রেসিডেন্টকেও হোল্ড অন বলতে পারেন, ওখানে এসব কোন বিষয়ই না৷ কিন্তু যষ্মিনদেশে যদাচরণ, আমাদের অঞ্চলে এটা অনেকক্ষেত্রেই যুতসই হয় না!
অনেক বাস কন্ডাকটরকেই দেখা যায় নির্বিচারে সবাইকে তুমি সম্বোধন করে বসছে! এই জিনিস আমার গায়ে লাগে! যদিও ওর কাছ থেকে অনেক শিষ্টাচারই আশা করা যায় না, কিন্তু ওকে না থামালে ও এটাকেই রেওয়াজে পরিণত করে ফেলবে! সুতরাং প্রতিবাদ বা প্রয়োজনীয় সময়ে টুঁটি চেপে ধরাও জরুরি হয়, নইলে চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয়৷
একদল মানুষ আছে যারা সম্মান পাবার জন্য টনটন করতে থাকে, সেটাও সমস্যা৷ আমার স্টাফরা বা জুনিয়ররা আমাকে স্যার বলবে, অবশ্যই বলবে, বলতে হবে৷ আমি আমার প্রক্তন সিনিয়রদেরও স্যার সম্বোধন করি, অনেকেই দেখা যায়, প্রাক্তন বসদের ভাই বানিয়ে ফেলেন! আমি এই কাজটা করি না! দুইদিন স্যারের সম্মান দিয়ে পরের দিন ভাই বানানোটা আমার কাছে মাখায় তুলে আছাড় দেবার মতন লাগে!
যাহোক, সম্মান অর্জন করে নিতে হয়, যারা সম্মান পাবার জন্য টনটন করে তাদের অতীত ঘাঁটলে দেখা যাবে, তারা কখনই ওই অবস্থানে ছিল না যে মানুষ তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবে! তো, সম্মান পাবার জন্য যদি কেউ চেঁচায় তখন মানুষ তাকে নিয়ে ঠিক এই প্রচ্ছন্ন কারণেই পরিহাস শুরু করে! যখন কেউ আপনাকে সম্মান দেবে না তখন চেঁচামেচি না করে এমন কিছু করুন, যাতে ওই লোকটার আপনার প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হয়, যাতে সে তার ভুল বুঝতে পারে এবং অনুতপ্ত হয়! এটাই সঠিক পদ্ধতি, আপনি আমাকে এভাবে বলতে পারেন না বললেই সীন ক্রিয়েট হয়, তাতে মানিরই মান যায়৷
অনেক গেঁজাইছি, না?
ওকে, নো নীড টু হোল্ড অন ডিয়ার, থ্যাংকস ফর ইওর টাইম এ্যান্ড কনসার্ন ❤️