ইউরোপের বিখ্যাত দীর্ঘ সান্ধ্যকালীন ট্রেন ভ্রমণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে স্টকহোম – ন্যারভিক রেল ভ্রমণ। এই ট্রেনটি স্টকহোম থেকে শুরু করে সুইডেনের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত শহর কিরুনা হয়ে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা রেলপথ ধরে নরওয়ের ন্যারভিক শহরে গিয়ে শেষ হয়। কিরুনা থেকে শুরু করে ন্যারভিক পর্যন্ত এলাকায় গ্রীষ্মকালে প্রচুর পর্যটক আসে। স্টকহোম থেকে রেলপথে কিরুনার দূরত্ব ১২৩৫ কিলোমিটার এবং যেতে ট্রেনে সময় লাগে প্রায় ১৩ ঘন্টা। সুইডেনের সরকারি রেলওয়ে কোম্পানীর নাম সংক্ষেপে SJ ( Sveriges Järnvägar)। স্টকহোম থেকে সারাদিনে শুধু একটি ট্রেন যায় এবং এটি ছাড়ে বিকাল ৬ টা ১০ মিনিটে। এটি মূলতঃ নাইট-ট্রেন এবং বেশিরভাগ হচ্ছে Sleeping compartment।
সুইডেনের নিশিরাতের রেলগাড়ির নিবাসন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে নিচের ভিডিও ক্লিপটি দেখতে পারেন:
এই ট্রেনের ঘুমের কামরাগুলো তিন রকমের:
১। Sleeping compartment 1 Class: এখানে রুমের মধ্যে দুটি বেড এবং স্নানাগার ও শৌচাগার রয়েছে। সকালে বিনামূল্যে প্রাতরাশ কামরাতেই সরবরাহ করা হয়।
২। Sleeping compartment 2 Class: এখানে উপরে, নিচে, মাঝখানে মোট তিনটি বেড। দিনের বেলায় মাঝখানের বেডটি দেয়ালের সাথে ভাজ করে রাখা হয়। নিচের বেডটি হয়ে যায় তিন সিটের সোফা। রুমের মধ্যে একটি বেসিন, লাগেজ রাখার জন্য একটি শেলফ এবং এরকম কয়েকটি রুমের যাত্রীদের জন্য করিডোরে রয়েছে দুটি শৌচাগার ও একটি স্নানাগার।
৩। Bunk in couchette 2 Class (Liggvagn): এখানে একইভাবে একপাশে তিনটি এবং অন্যপাশে তিনটি মোট ৬টি বেড। দিনের বেলায় নিচের বেড দুটিতে সবার বসার সুবিধার্থে মাঝখানের বেড দুটিকে দেয়ালের সাথে ভাজ করে রাখা হয়। শৌচাগার ও স্নানাগার বাইরের করিডোরে। এ ধরনের কামরাগুলো আবার পুরুষ, মহিলা এবং মিক্সড - এই তিন ভাগে বিভক্ত।
এছাড়া কয়েকটি কমপারমেন্ট আছে চেয়ার সিটের। রেডিমেড ফাস্টফুডসহ রয়েছে একটি রেস্টুরেন্ট।
আমরা টিকেট অনুযায়ী আমাদের কামরায় গিয়ে বসলাম। টিকেট আগে থেকেই বুক করা ছিল। আমাদের কামরাটি ছিল ৩য় ক্যাটাগরির স্লিপিং কমপার্টমেন্ট। ঘুমানোর ইচ্ছা তেমন নেই। ট্রেনের জানালা দিয়ে সুইডেনের প্রকৃতিকে দেখার সুযোগ ঘুমিয়ে নষ্ট করতে চাই না। এই ধরনের কামরায় নিচের ও মাঝখানের বেডে শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করা যায়। তাই আমি বুক করার সময় সেভাবেই বেড বুক করেছিলাম। বেডগুলোর সাথে বালিশ, বিছানার কভার ও লেপ ভাজ করে দেওয়া আছে। আমাদের এই ৬ জনের রুমে মোট ৫ জন যাত্রী। ট্রেন ৬টা ১০ মিনিটে যাত্রা শুরু করার ১৫ মিনিট পরেই টিকেট চেকার এসে টিকেট চেক করে গেলেন। উপরের সিটের দুই যাত্রী সন্ধ্যা ৭ টার মধ্যেই তাদের বেডে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমরা এর মধ্যে করিডোর ধরে ট্রেনের প্রথম কামরা থেকে শেষ কামরা পর্যন্ত একটা চক্কর মারলাম। রেস্টুরেন্ট কারের পরিবেশটা বেশ খোলামেলা এবং জানালাগুলো বেশ প্রশস্ত। এখানে বসে একটু জলপান করলাম। মনে হয় যেন খোলা বারান্দায় বসে কফি পান করছি।
আমাদের সিট ছিল একপাশে মাঝখানের ও নিচের বেড। নিচের বেড দুটো দিনের বেলায় রুমের সবার জন্য বসার সিট। আমরা নিচের বেডে বসে রাত ১০টা পর্যন্ত ট্রেনের দুই পাশের পেছন দিকে ছুটে চলা সুইডেনের প্রকৃতিকে দেখতে লাগলাম। যখন খুব সুন্দর দৃশ্য আসতো তখন করিডোরে গিয়ে ট্রেনের অপর পাশের দৃশ্যও দেখতাম। রাত ১০টার দিকে শুয়ে পড়লাম। আমি নিচের বেড থেকে এবং আমার মেয়ে মাঝখানের বেড থেকে জানালার পর্দা আংশিক সরিয়ে ঘুম না আসা পর্যন্ত বাহিরের দিকেই চোখ রাখলাম। জুন-জুলাই মাসে এখানে ঘড়ির হিসাবে দিন প্রায় ২০ ঘন্টা এবং রাত মাত্র ৪ ঘন্টা। রাতের সেই চার ঘন্টাও আমাদের দেশের মাগরিবের মতো আলো থাকে। কখন ঘুম এসে গেল জানিনা। খুব ভোরে যখন ঘুম ভাঙলো তখন আমরা বোডেন স্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছি। এই ট্রেনটি খুব অল্প কিছু স্টেশনে থামে। তাছাড়া এই সময়ে বেশিরভাগ যাত্রীর গন্তব্যস্থল হচ্ছে কিরুনা থকে নেরভিক পর্যন্ত এলাকাটি।
দীর্ঘ সময় ধরে ট্রেনের আশেপাশে যত জায়গা দেখেছি সবখানেই মানুষজন খুব কম। তাই এখানকার বেশিরভাগ এলাকা শান্ত ও নির্জন। কিরুনার আগের স্টেশন গ্যালিভারে এসে দেখলাম অনেক লোকজন এবং বেশিরভাগই বিদেশি পর্যটক। মনে হচ্ছে এখানে কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান, মেলা বা প্রদর্শনী এরকম কিছু চলছে হয়তো। ট্রেন থেমে আছে। ট্রেনের গার্ডকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ট্রেন ছাড়তে দেরি হবে নাকি? তিনি বললেন, ইনল্যান্ডসবানা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। এইমাত্র এসে পৌঁছেছে। সেই ট্রেনের অনেক যাত্রী নাকি আমাদের এই ট্রেনে যাবে। পরে ইনল্যান্ডসবানা থেকে ঘুরে আসা এক পর্যটক থেকে জানতে পারলাম যে, ইনল্যান্ডসবানা রেলপথের দুপাশের নৈসর্গিক দৃশ্য নাকি খুবই সুন্দর! ইস্, আগে জানলে ভ্রমণের প্যাকেজে আরো একটা দিন বাড়িয়ে ইনল্যান্ডসবানা রেলপথেও ঘুরে আসতে পারতাম। গত বছর (২০১৯) যুক্তরাজ্যের দৈনিক পত্রিকা দ্যা টেলিগ্রাফের মতে মনোমুগদ্ধকর নৈসর্গিক দৃশ্যের জন্য ইউরোপের সবচেয়ে আকর্ষনীয় ১৫টি রেল ভ্রমণের মধ্যে সুইডেনের ইনল্যান্ডসবানা দ্বিতীয়। (The Telegraph) পরে কৌতুহলবশত আরো তথ্য সংগ্রহ করে যা জানলাম তাতে এ ট্রেনে ভ্রমণের খুব ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের অভাবে এবং পূর্ব পরিকল্পনা পরিবর্তন করে তা আর সম্ভব হয়নি।
আমাদের ট্রেন যে রেলপথে এসেছে সেটি সুইডেনের পূর্ব সীমানা হয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তরে এসেছে। ইনল্যান্ডসবানা রেলপথটি সুইডেনের একদম মধ্যখানে দক্ষিণ থেকে উত্তরে এসেছে। ইনল্যান্ডস্ লাইন (সুইডিশ: ইনল্যান্ডসবানা) সুইডেনের ক্রিস্টিনহ্যামন থেকে মোরা হয়ে গালিভারে এসে শেষ হয়েছে। এটি ১,২৮৮ কিলোমিটার দৈর্ঘের সিঙ্গেল ট্র্যাকের রেলপথ। এটি ১৯০৮ ও ১৯৩৭ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল এবং উত্তর ও মধ্য সুইডেনের কেন্দ্রীয় অংশগুলির মধ্য দিয়ে চলে। এই ট্রেনগুলো কিছুটা ধীর গতির ডিজেল ইঞ্জিনে চলে। গ্রীষ্মকালে পর্যটকদের জন্য এখানে Gallivare থেকে Mora এবং Mora থেকে Gallivare দু'দিনের একটি প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয়। মাঝখানে একরাত যাত্রীদেরকে Ostersund'এ হোটেলে রাখা হয়। এই সৌখিন প্যাকেজের মধ্যে রয়েছে সার্বক্ষনিক গাইড, রেল লাইনের পাশে হ্রদ ও নদীর তীরে নির্জন-নিস্তব্ধ পরিবেশে বসে চা/কফি পান, আশেপাশের স্থানীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখা। পাঠকের উপলদ্ধির সুবিধার্থে ইনল্যান্ডসবানা রেলপথের কয়েকটি ছবি (একের ভেতরে পাঁচ) এখানে দিলাম। (More info: Inlandsbanan)
ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে। আমরা এখন আমাদের গন্তব্যস্থল কিরুনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মালামাল গুছিয়ে নামার প্রস্তুতি নিয়ে জানালার পাশে বসে কিরুনা তথা উত্তর মেরুর আদিবাসী সামীদের চারণভূমি লাপল্যান্ডের অপরূপ প্রকৃতিক দৃশ্য নয়ন ভরে উপভোগ করতে করতে স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে কিরুনায় পৌঁছে গেলাম। অনলাইনে যে কোম্পানী থেকে কিরুনায় চারদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করেছিলাম তারা আমাকে ই-মেইলে জানিয়েছিল কিরুনা রেল স্টেশনে আমাকে গাড়ি প্রদান করা হবে। তাই প্লাটফরমে নেমে রেন্ট-এ-কারের কোনো লোকজন আছে কিনা দেখছি। স্টেশনের সামনে দেখলাম একজন যুবতী বড় করে আমার নাম লেখা একটি কাগজ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে ওকে সম্ভাষণ করে আমার পরিচয় দিলাম। মেয়েটি একটু মিষ্টি করে হেসে করমর্দন করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, Welcome to the land of the midnight sun!
কিরুনা রেল স্টেশন
সুইডেনের স্টকহোম থেকে কিরুনা পর্যন্ত ১৩০০ কিলোমিটার রেল ভ্রমণের নৈসর্গিক দৃশ্যগুলো সবার সাথে শেয়ার করার জন্য মোট ১৩টি ছবি নিচে যোগ করলাম। প্রতিটি ছবি থেকে পরবর্তী ছবির রেল ভ্রমণ দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। ট্রেন থেকে চলন্ত অবস্থায় আমার তোলা ছবিগুলো অত সুন্দর হয়নি, তাই বেশিরভাগ ছবি ইন্টারনেট থেকে নিয়েছি।
ব্লগের ভার্চুয়্যাল সহযাত্রীদের ভ্রমণের জন্য স্টকহোম থেকে কিরুনা পর্যন্ত যাওয়ার পথের কিছু ছবি :
01. Uppsala
02. Gävle
03. Soderhamn
04. Hudiksvall
05. Sundsvall
06. Harnosand
07. Ornskoldsvik
08. Umea
09. Bastutrask
10. Boden
11. Murjek
12. Gallivare
13. Kiruna
ছবি ও তথ্যসূত্র: সুইডেন রেলওয়ে ও ইন্টারনেট
◄ পর্ব ২ ——— সুমেরু অঞ্চলে নিশি রাতে সূর্য দর্শন ——— পর্ব ৪ ►
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ২:৩৮