সুমেরু অঞ্চলে আমাদের আজ ৫ম দিন। এর মধ্যে শহর, মহাসড়ক, উন্মুক্ত প্রাঙ্গন এবং নদী/হ্রদের তীর থেকে নিশীরাতে সূর্যের হালকা আলোতে প্রকৃতির অপূর্ব রূপ দেখেছি। হাতে সময় আছে আর একদিন। তাই আজ পাহাড়ে উঠে নিশীরাতের সূর্য দেখার প্রোগ্রাম রেখেছি।
আজকের পরিকল্পনা:
১। সকালে কিরুনা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে পর্বত দর্শন
২) বিকালে কিরুনা শহরে পাহাড়ের উপরে উঠে মধ্যরাতের সূর্য দর্শন
সুইডেনের উচ্চতম পর্বত কেবনেকাইসে দর্শন (Kebnekaise)
কেবনেকাইসে পর্বতে যাওয়ার রাস্তা - একই রাস্তার দুটি ছবি: গ্রীষ্ম ও শীতকালে
কেবনেকাইসে পর্বতটি সুইডিশ ল্যাপল্যাণ্ড এলাকায় অবস্থিত। এই পর্বতের দুটি চূড়া রয়েছে: দক্ষিণ চূড়া, উচ্চতা ২,১২০ মিটার (6,960 ft), উত্তর চূড়া উচ্চতা ২,০৯৭ মিটার (6,879 ft)। ৭৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এই পর্বতটিতে যাওয়ার অনেকগুলো পথ আছে। মানচিত্র দেখে পর্বত যাওয়ার যে পথটি আমি পছন্দ করেছি তার দূরত্ব কিরুনা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার। পর্বতে উঠার মতো প্রস্তুতি, ইচ্ছা বা সময় কোনটাই নেই। যাওয়ার উদ্দেশ্য পর্বতটাকে কাছে থেকে দেখা। মানচিত্রে গাড়ির রাস্তাটি পর্বতের একদম কাছে এসে শেষ হয়েছে মনে হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এসে দেখলাম রাস্তার শেষের অংশটুকু হাঁটা রাস্তা। অর্থাৎ গাড়ি পার্কিং-এ রেখে বেশ কিছু পথ হেঁটেই পর্বতের কাছে আসতে হবে।
আমার মেয়ে পর্বত অভিমূখে বিপুল উৎসাহে দুর্গম পথ হেঁটে যাচ্ছে
যা-ই হোক, অগত্যা আমরাও কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। দেখে মনে হচ্ছে পর্বত একদম কাছেই, কিন্তু হাঁটছি তো হাঁটছিই পথ শেষ হয় না! পাহাড়ি এই কাঁচা রাস্তাটিতে এদিকে-সেদিকে বিভিন্ন সাইজের পাথর ছড়িয়ে আছে। যার কারণে হাঁটতেও কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এর মধ্যেই আমার মেয়ে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সে আর যেতে চাচ্ছে না। পর্বত আর বেশি দূরে নয় বলে আশ্বাস দিয়ে তাকে হাঁটার জন্য উৎসাহিত করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার মেয়ে ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে বসে কাঁদতে শুরু করলো। এখন কী করা যায়! এত দীর্ঘ পথ গাড়িতে ও হেঁটে এসে পর্বতের খুব কাছ থেকেই ফিরে যাবো তা কি করে হয়। এখানে আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। তারপর আমার মেয়েকে কাঁধে নিয়ে আবার পর্বতের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। পর্বত দেখে ফিরে আসা কিছু রসিক পর্যটক আমরা বাপ-বেটির অবস্থা দেখে হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করলেন।
কেবনেকাইসে যাওয়ার হাঁটা রাস্তা, পর্বতের পাদদেশে মিনি পার্ক
অবশেষে আমরা ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত এবং ক্ষুধার্ত দেহ নিয়ে পর্বতের পাদদেশে এসে হাজির হলাম। এলাকাটি দেখতে পার্কের মতো খুব সুন্দর, এখানে বিশ্রামের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা আছে। কিছু পর্যটক এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছে। কিছু পরিব্রাজক (hiker) পিঠে বিরাট ব্যাগ নিয়ে পর্বতে উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একপাশে তাঁবু করে এখানকার আদিবাসী সামি লোকেরা খাবার-দাবার বিক্রি করছে। আমরা তাদের থেকে হরিণের মাংসের মেগা সাইজের দুটি বার্গার ও এক বোতল সফট ড্রিংকস কিনে পার্কের টেবিল-বেঞ্চে বসে ক্ষুধার্ত হাঙরের মতো গপাস গপাস করে গিলতে লাগলাম। হরিণের মাংস দিয়ে সদ্য তৈরি গরম গরম বার্গারগুলো ক্ষুধার্ত পেটে খাওয়ার সময় একেবারে ঝাক্কাস মজা লাগলো! আমরা বাপ-মেয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকলেও বার্গার খাওয়ার পরে আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করলাম। 'পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি'।
আমরা পেট শান্তি করে আস্তে আস্তে পর্বতের পাশে গেলাম। শুরুর দিকে পর্বতে উঠার রাস্তায় হেঁটে অল্প কিছুদুর যাওয়ার পর থেমে গেলাম। শুরুর দিকে রাস্তা মোটামুটি ঢালু হলেও পাথরের অসমতল রাস্তায় হাঁটার মতো তেমন এন্যার্জি আর আমাদের ছিল না। তাছাড়া যেই কঠিন রাস্তা হেঁটে এখানে এসেছি সেটা পেরিয়েই আবার পার্কিংয়ের জায়গায় যেতে হবে এবং বিকালে কিরুনায় পাহাড়ে উঠে নিশীরাতে সূর্য দেখতে হবে। তাই পর্বত সংলগ্ন এলাকায় ঘোরাঘুরি করে কিছু ছবি তুলে এবং পরিশেষে পর্বত মহাশয়কে প্রণাম জানিয়ে ধীরলয়ে কটেজে ফিরে আসলাম।
পাহাড়ের উপরে উঠে মধ্যরাতের সূর্য দর্শন
মধ্যরাতের সূর্যের দৃশ্য পাহাড়, নদী ও মাঠ যেখান থেকে দেখি না কেন সব দৃশ্যই সুন্দর
কিরুনাতে ২৮ মে থেকে ১৫ জুলাই প্রায় দেড় মাস রাতে সূর্য অস্ত যায় না। তাই মধ্যরাতেও এখানে সম্পূর্ণ অন্ধকার হয় না। বাংলাদেশে মাগরিবের আধা ঘণ্টা আগে যে রকম আলো থাকে এখানে রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত সে রকম আলো থাকে। এই আলোয় পার্কে বসে পত্র-পত্রিকা বা বই-পুস্তক পড়তে সমস্যা হয় না। তাই এই সময় রাস্তার বাতিগুলো দিনরাত নিভানো থাকে। ১টার পর থেকে সূর্য আস্তে আস্তে উপরে চলে আসে, তখন সব জায়গা থেকে সূর্য দেখা যায়। ঠিক একইভাবে রাত ১১টার সময়েও সূর্যকে সব জায়গা থেকে দেখা যায়। রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত সময়ে সূর্যকে মেঘমুক্ত পরিস্কার আকাশে স্পষ্টভাবে দেখতে হলে বিশেষ কিছু ভিউ পয়েন্টে যেতে হয়। যেমন: নদীর ধারে, বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে বা পাহাড়ের উপরে। নিশীরাতে সূর্য দেখার প্রধান ও একমাত্র অন্তরায় হচ্ছে মেঘ। তাই এখানে তিন-চার দিন থাকতে পারলে নিশীরাতে সূর্য দর্শন মিস্ হওয়ার সম্ভাবনা কম। যে দিন আকাশ পরিষ্কার থাকবে সে দিনই যে কোনো ভিউ পয়েন্টে গিয়ে নিশীরাতে সূর্য দর্শনের সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
পাহাড়ে উঠার রাস্তা ও পাহাড় থেকে সূর্য দর্শন
গতকালই আবহাওয়া সংবাদ দেখে নিশ্চিত হয়েছিলাম যে আজকে আকাশ পরিষ্কার থাকবে। তাই সকালে পর্বত দেখার কাজ সেড়ে বিকালে (রাত ৯টা) নিশীরাতে সূর্য দর্শনের সিডিউল রেখেছিলাম। আমরা সূর্য দর্শনের ভিউ পয়েন্ট হিসাবে কিরুনা শহরের পাহাড়কে নির্বাচন করলাম। কারণ পাহাড়টি কিরুনা শহরের মধ্যেই এবং আমাদের কটেজ থেকেও বেশি দূরে নয়। গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। পাহাড়টি খুব বেশি উঁচু নয়। পাহাড়ের উপরে উঠার রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। আমার আগে আগে বেশ কয়েকটি গাড়ি যাচ্ছে তাদেরকে অনুসরণ করতে লাগলাম। ৩ - ৪ মিনিট উঠার পর একটা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। আমার সামনের সব কয়টি গাড়ি এখানে পার্কিং করলেও একটা গাড়ি আরো উপরের দিকে উঠতে লাগলো। আমিও তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। একটু পরে দেখি এই রাস্তাটা বেশ সরু, পেঁচানো এবং খুবই খাড়া। সামান্য উল্টাপাল্টা হলে গাড়ি পিছন বা পাশের দিকে গড়িয়ে পড়ে যাবে। এ ধরনের পাহাড়ি রাস্তায় আমার গাড়ি চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। খুবই ভয় পাচ্ছি কিন্তু কিছু করার নেই সামনের দিকে যেতেই হবে। গাড়ি ব্যাক করে পিছন দিকে যেতে চাইলে আরো বেশি বিপদ! যাক, কোনো রকমে রাস্তার শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছে গেলাম। শেষের এক থেকে দেড় মিনিটের রাস্তাটা গাড়ি নিয়ে না উঠলেই পারতাম। না জেনে না বুঝে অন্ধভাবে ঐ চালু ও অভিজ্ঞ চালককে অনুসরণ করে আমার মতো আনভিজ্ঞ গাড়ি চালকের এই বিপদ। যা-ই হোক, আপাতত গাড়ি রেখে আমরা পাহাড়ের চূড়ায় একটা নিরিবিলি জায়গায় বসলাম। রাত এখন প্রায় ১১টা, সূর্য এখনো অনেক উপরে। সবার মতো আমরাও মধ্যরাত তথা রাত বারোটার পর দিগন্তরেখার কাছে সূর্যের অবস্থান দেখার অপেক্ষায় রইলাম। এরমধ্যে দেখলাম ছোট ছোট কিছু হালকা মেঘখণ্ড আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই অনেক দর্শনার্থীর চোখেমুখে কিছুটা দুশ্চিন্তার আভাস, সূর্য দেখার দুর্লভ মুহুর্তে না আবার সূর্য মেঘে ঢেকে যায়!
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এখানে দিক নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত হতে হয়। যেমন: উত্তর মেরুর কেন্দ্রবিন্দুতে আমি দাঁড়িয়ে পৃথিবীর যেদিকে তাকাই না কেন সব দিকই দক্ষিণ! যদিও উত্তর মেরুর কেন্দ্রবিন্দু থেকে আমরা অনেকটা দক্ষিণে তারপরেও সূর্যের অবস্থান দেখে পূর্ব বা পশ্চিম নির্ণয় করা সহজ নয়। যা-ই হোক, সূর্যাস্ত দেখার জন্য আমরা অনেকটা উত্তরমূখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সূর্য উত্তর-পূর্ব দিক থেকে অর্থাৎ আমাদের বামদিক থেকে এসে উত্তর-পশ্চিমদিক অর্থাৎ আমাদের ডানদিকে যেতে যেতে অস্ত যাবে। ঘড়িতে সময় যতই এগিয়ে যাচ্ছে সুর্যও আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসছে এবং আকাশের রং নীল থেকে হালকা লাল হচ্ছে। এভাবে এক সময় দেখা গেল সুর্য একেবারে দিগন্তরেখার কাছাকাছি চলে এসেছে এবং আকাশ চোখ ধাঁধানো স্বর্ণালী রং ধারণ করেছে। দেখে মনে হয় কয়েক মিনিটের মধ্যেই সূর্য দিগন্তরেখার নিচে চলে যাবে। কিন্তু না! সুর্য এখন নিচেও নামে না, উপরেও উঠে না। আস্তে আস্তে ডান দিকে যাচ্ছে এবং একটু পরেই ডান দিকে সরে সরে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। এই সেই দূর্লভ দৃশ্য যা দেখার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছিলাম। কিরুনা শহর রাত দুটো বাজতেই আবার দিনের পূর্ণাঙ্গ আলোয় ফিরে এসেছে। নিশিরাতের সূর্যতো দেখলাম। এখন গাড়ি নিয়ে নিচে নামার পালা। উপরের ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তাটুকু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে আমার মেয়েকে হেঁটে নিচের পার্কিংয়ের জায়গায় গিয়ে অপেক্ষা করতে বললাম। অগত্যা দূর্ঘটনা যদি হয়েই যায় আমি মরে গেলেও আমার মেয়েটা বেঁচে থাকবে। যা-ই হোক, গাড়ি নিয়ে আস্তে আস্তে খুব সাবধানে সহি-সালামতে নেমে গেলাম।
কেন এমন হয়
দিগন্তরেখার উপরে মধ্যরাতের সূর্যের অবস্থান ধাপে ধাপে (স্লো মোশন) দেখানো হলো - সূর্য দিগন্তরেখার কাছাকাছি এসে আবার উপরের দিকে উঠে যায়।
উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে বৎসরের একটা সময় দিনের ২৪ ঘণ্টা সূর্য দেখা যায় আবার আরেকটা সময় ২৪ ঘণ্টায় একবারও সূর্য দেখা যায় না - এই ব্যাপারটা কেন হয় সে ব্যাপারে অনেকের স্পষ্ট ধারণা নেই। তাই এখানে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করলাম।
আমরা সবাই জানি, পৃথিবী তার নিজ অক্ষে একবার পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে আবর্তন করতে সময় নেয় প্রায় ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ একদিন। পৃথিবীর এই আবর্তন গতির (আহ্নিক গতি) জন্য পৃথিবীর যেদিক সূর্যের সামনে আসে সেদিক সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়। তখন ওই আলোকিত স্থানসমূহে দিন থাকে। আর আলোকিত স্থানের উল্টো দিকে অর্থাৎ পৃথিবীর যে দিকটা সূর্যের বিপরীত দিকে থাকে, সে দিকটা অন্ধকার থাকে। সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছে না।
[বিষুবরেখা বা নিরক্ষরেখা (equator) একটি কাল্পনিক রেখা যা পৃথিবীর মাঝ বরাবর এবং উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু থেকে সমান দুরত্বে কল্পনা করা হয়। এটি পৃথিবীকে দক্ষিণ গোলার্ধ এবং উত্তর গোলার্ধে ভাগ করে। উত্তর মেরু থেকে প্রায় 23.4° দক্ষিণ পর্যন্ত এলাকা নিয়ে একটি বৃত্ত আঁকলে যে এলাকা পাওয়া যায় তাকে বলে সুমেরু বৃত্ত (arctic circle)।]
জুনের শেষ সপ্তাহে পৃথিবী ও সূর্যের অবস্থান (বামে) --- ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পৃথিবী ও সূর্যের অবস্থান (ডানে)
পৃথিবী তার নিজ যে অক্ষে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ২৪ ঘণ্টায় একবার আবর্তন করে সেখানে আমরা যদি একটি রেখা টানি তবে দেখতে পাব যে সেই অক্ষরেখাটি (Rotation axis) সূর্যের সাথে লম্বভাবে সমান্তরাল নয়। এটি 23.4° হেলানো। উপরের বামপাশের ছবিতে জুনের শেষ সপ্তাহে পৃথিবী ও সূর্যের অবস্থান লক্ষ্য করুন। ছবিতে পৃথিবীর বিষুররেখার আশেপাশের এলাকাগুলো যখন সূর্যের দিকে থাকে তখন সেখানে দিন, এটি আহ্নিক গতির কারণে আবার যখন সুর্যের উল্টো দিকে চলে যায় তখন সেখানে রাত। ব্যাপারটা একদম পরিষ্কার! এবার একই ছবিতে পৃথিবীর উত্তর মেরুতে সুমেরু বৃত্তের এলাকাটি দেখুন। এর ডান পাশের এলাকাটি সুর্যের দিকে তাই সেখানে দিন, এলাকাটি আহ্নিক গতির কারণে আবার যখন সুর্যের উল্টো দিকে চলে যায় তখন সেখানে রাত হওয়ার কথা! কিন্তু না, ছবিতে দেখুন সেই এলাকাতেও সূর্যের আলো তির্যকভাবে গিয়ে পড়েছে (Sunrise/Sunset: Upp all day)। কারণ পৃথিবী ডান দিকে (সূর্যের দিকে) 23.4° হেলিয়ে থেকে নিজ অক্ষে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার করে ঘুরছে।
ছয় মাস পর অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পৃথিবী বার্ষিক গতির অর্ধবৃত্ত অতিক্রম করে সূর্যের ডান দিকে চলে এসেছে। উপরের ডান পাশের ছবি লক্ষ্য করুন। পৃথিবীর ডান দিকে 23.4° হেলিয়ে থাকার কারণে সুমেরু অঞ্চলে ২৪ ঘণ্টায় একবারও সূর্যের আলো পড়ে না। অর্থাৎ এখানে এখন সব সময় অন্ধকার (Sunrise/Sunset: Down all day)। যা-ই হোক, এখনও ব্যাপারটা বুঝতে কারো অসুবিধা হলে নিচের ভিডিওতে Summer solstice এবং Winter solstice দেখতে পারেন:
কিরুনার মুসলমানদের রোজা পালন
গ্রীষ্মকালের রমজান মাসে ইফতার ও সেহরির সময় নিয়ে বিভ্রান্ত কিরুনায় বসবাসকারী মুসলিম মহিলা
(সূত্র: আল জাজিরা Ramadan where the sun never sets)
কিরুনাতে হাতেগনা কিছু অভিবাসী মুসলমান বাস করে। তাদের অনেকেই প্রাত্যহিক জীবনে ইসলাম ধর্মের চর্চা করে। কোন বছরে রমজান যদি মে থেকে জুলাই মাসের মধ্যে পড়ে তখন এখানে ২৪ ঘণ্টা সূর্য দেখা যাওয়ার কারণে সেহরি ও ইফতার নিয়ে স্থানীয় মুসলিমদের সমস্যা হয়। আবার নভেম্বর থেকে জানুয়ারির মধ্যেও যদি রমজান পড়ে তখন ২৪ ঘণ্টায় একবারও সূর্য দেখা না যাওয়ার কারণেও সেহরি ও ইফতার নিয়ে সমস্যা হয়। তাই সমাধান হিসাবে এদের কেউ কেউ স্টকহোমের সময় অনুসরণ করে আবার কেউ কেউ মক্কার সময় অনুসরণ করে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে আল-জাজিরার নিচের প্রতিবেদনটি পড়তে পারেন:
Ramadan in Sweden with no dusk, no dawn
অরোরা বা মেরুজ্যোতি
সুমেরু এলাকা গ্রীষ্মকালে নিশীরাতে সূর্য দেখার জন্য যেমন বিখ্যাত তেমনি শীতকালে অরোরা বা মেরুজ্যোতি (northern-light) দেখার জন্যও বিখ্যাত।
আমার এই ভ্রমণ কাহিনী গ্রীষ্মকালের। গ্রীষ্মকালে এখানে রাতেও যথেষ্ট আলো থাকার কারণে অরোরা দেখা যায় না। আগের পর্বগুলোতে মন্তব্যে অনেকে অরোরা সম্পর্কে উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। তাই পাঠকদের আগ্রহে অরোরা বা মেরুজ্যোতির ব্যাপারে সামান্য আলোচনা করলাম। মেরুজ্যোতি বা মেরুপ্রভা বা আরোরা বা আরোরা অস্ট্রালিস বা Northern lights হলো আকাশে একধরনের প্রাকৃতিক আলোর প্রদর্শনী। আরোরা দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। আমরা জানি যে প্রতি মুহূর্তেই সূর্য্য আয়নিত কণা বিকিরণ করছে। বিভিন্ন সময়ে মারাত্মক সৌর ঝড়ের কারণে এই বিকিরণের তীব্রতা অনেক গুণ বেড়ে যায়। ভীষণ শক্তিশালী এই বিকিরণ সারা সৌরজগৎে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ হিসেবে ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং স্বাভাবিকভাবেই প্রতিনিয়ত এটি পৃথিবীকেও আঘাত করে। সূর্য্য আয়নিত এসব কণার (প্রধা্নত ইলেক্ট্রন, কিছু ক্ষেত্রে প্রোটন) সাথে বায়ুমন্ডলের থার্মোস্ফিয়ারে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সাথে সংঘর্ষের কারণে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের পরমাণু বা অণুসমূহ চার্জিত কণিকাসমূহের কাছ থেকে কিছু শক্তি লাভ করে উত্তেজিত হয়। এই উত্তেজিত কণাগুলো যখন আলোর নিঃসরণ ঘটিয়ে সাধারণ অবস্থানে ফিরে আসে, তখনই মেরুজ্যোতি দেখা যায়। এসব ইলেক্ট্রন সাধারণত পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র বরাবর পরিভ্রমন করায় শুধুমাত্র মেরু অঞ্চলেই অরোরা দৃশ্যমান হয়।
আরোরাতে যা ঘটে তেমনটি ঘটে নিয়নের বাতিতেও। নিয়ন টিউবের মধ্যে নিয়ন গ্যাসের পরমাণুগুলোকে আন্দোলিত করবার জন্য ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ। তাই নিয়নের বাতিগুলো এরকম উচ্চ মানের রঙ্গিন আলো দেয়। আরোরাও ঠিক এভাবে কাজ করে-তবে এটি আরো বড় মাত্রায় হয়। আরোরাগুলো মাঝে মাঝে আলোর পর্দার মতো দেখায়। তবে এরা গোলাকার অথবা সর্পিল বা বাঁকানোও হতে পারে। বেশিরভাগ আরোরাতে সবুজ রঙ এবং গোলাপী রঙ দেখা যায়। তবে অনেকসময় লাল রঙ বা বেগুনী রঙের হতে পারে। মেরুজ্যোতির রঙ নির্ভর করে কোন গ্যাসীয় পরমাণু ইলেক্ট্রন দ্বারা উদ্দীপ্ত হচ্ছে, এবং এই প্রক্রিয়ায় কত শক্তি বিনিময় হচ্ছে তার উপর। উত্তর অক্ষাংশে অরোরা সুমেরুজ্যোতি বা সুমেরুপ্রভা (Aurora Burealis/The Northern Light) নামে পরিচিত, এবং দক্ষিণ অক্ষাংশে একে বলা হয় Aurora Australis (or The Southern Light). অরোরা দর্শনের সবচেয়ে ভালো স্থান হলো সুমেরু অঞ্চল অর্থাৎ আলাস্কা, কানাডা, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে এবং আইসল্যান্ডের কিছু এলাকা । এসব স্থানে শীতকালে অন্ধকার রাতে প্রায় নিয়মিতই মেরুজ্যোতি চোখে পড়ে। মেরূপ্রভা সূর্যালোক থেকে অনেক ম্লান হওয়ায়, তা পৃথিবী থেকে দিনের বেলায় দেখা যায় না।
অরোরা বা মেরুজ্যোতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে আমাদের সুপরিচিত ব্লগার ডঃ এম এ আলী ভাইয়ের এই পোস্টটি দেখতে পারেন:
উত্তরের যাত্রা - ১ম পর্ব : মেরুজ্যোতি দর্শন : ডঃ এম এ আলী
কিরুনাতে এসে অরোরা দেখতে চাইলে অরোরা স্কাই স্টেশনের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন:
Aurora Sky Station – the best place on earth to experience northern lights
ফটো গ্যালারি:
১। কেবনেকাইসে পর্বত ও নিকটবর্তী হ্রদ
২। কেবনেকাইসে পর্বতের পাথরী রূপ
৩। কেবনেকাইসে পর্বতের শীতকালীন রূপ
৪। কেবনেকাইসে পর্বতের বসন্তকালীন রূপ
৫। কিরুনার অদূরে পর্যটকদের প্রিয় এলাকা অবিস্কো (Abisko) এলাকার মধ্যরাতের দৃশ্য
৬। মেঘলা আকাশ নিশীরাতের স্বর্নালী আভাকে যখন ঢেকে দেয় প্রকৃতি তখন আরেক রূপ গ্রহণ করে
৭। নিশীরাতে সুর্য দর্শন ও ওয়াটার স্কী - এসময় অনেকে আবার শারিরীক খসরত ও খেলাধুলায় মেতে উঠে
৮। হালকা মেঘ বা অন্য কোনো প্রতিবন্ধকতার কারণে নিশীরাতে সূর্য সরাসরি দেখা না গেলেও সুর্যের স্বর্নালী আভায় উদ্ভাসিত আকাশ সব জায়গা থেকেই চোখে পড়ে
৯। নিশীরাতে সুর্যের মোলায়েম আলোয় প্রাকৃতিক হ্রদের নীরব-নিস্তব্ধ পরিবেশে স্নান করার এই বিরল সুযোগ অনেকেই মিস্ করতে চাই না
_________________________________________
তথ্য ও ছবিসুত্র: কিছু নিজের, কিছু ইন্টারনেট থেকে নেওয়া
◄ পর্ব ৫ - উত্তর মেরুতে নিশি রাতে সূর্য দর্শন - পর্ব ৭ ►
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩৬