somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উত্তর মেরুতে নিশি রাতে সূর্য দর্শন - পর্ব ৫

১৮ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৮:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আজকের পরিকল্পনা:

১। সকালে কিরুনা শহরে লোহার খনি পরিদর্শন করা,
২) আদিবাসি সামীদের জীবন ও সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীতে কিছুক্ষণ সময় কাটানো,
৩) কিরুনা থেকে উত্তর-পূর্বদিকে কার ট্রিপ (450 km)।
kiruna → Gallivare → Pajala → Lovikka → Vittangi → Kiruna

১। লোহার খনি পরিদর্শন

সকাল ৯ টার আগে কিরুনা পর্যটক কেন্দ্র অফিসের সামনে এসে হাজির হলাম। বরাবর ৯টায় LKAB'এর গাড়ি এসে হাজির। আমরা ১২ জন ভিজিটরকে নিয়ে গাড়িটি কিরুনা খনিতে এসে গেল। কিরুনার এই খনিটি বিশ্বের বৃহত্তম ভূগর্ভস্থ লোহা আকরিক খনি। এখানে রিমোর্ট কন্ট্রোল মেশিন দিয়ে ভূগর্ভস্থ আকরিক খনন করে চালকবিহীন ট্রেনের সাহায্যে উপরে উঠানো হয়। LKAB (ইংরেজিতে: Loussavaara Kiirunavaara Ltd) নামে সুইডেনের সরকার মালিকাধীন স্বনামধন্য একটি কোম্পানী এই কাজগুলো করে। তারা একটি নির্দিষ্ট ফি নিয়ে সর্বক্ষণিক গাইড সহকারে খনিটি পর্যটকদের প্রদর্শন করার জন্য বিশেষ একটি ব্যবস্থা রেখেছে। এমনকি শারীরিক প্রতিবন্ধী ভিজিটরদের জন্যও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে কিরুনা পর্যটক কেন্দ্রের অফিস এবং অন্যান্য কয়েকটি স্থান থেকে এদের নিজস্ব বাসে উৎসাহী পর্যটকদের খনিতে নিয়ে আসে। এরপর বিশেষভাবে নির্মিত লিফটের মাধ্যমে সবাইকে ভূপৃষ্ট থেকে ৫৪০ মিটার নিচে LKAB's Visitor Centre'এ নিয়ে যায়। খনিটিতে ইদানিং ১৪০০ মিটার নিচের থেকে আকরিক খনন করে। দীর্ঘদিন ধরে ভূ-গর্ভস্থ লোহার আকরিক উত্তোলনের ফলে মাটির নিচে ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে কিরুনা শহরে ভূমি ধ্বসের সম্ভাবনা খুব বেশি। তাই এই পুরো কিরুনা শহরটি নিরাপদ দূরত্বে স্থানান্তারিত করার এক দীর্ঘ মেয়াদি মহাযজ্ঞ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে শহর কতৃপক্ষ।

কিরুনা খনিতে খনন কার্য ও লোহার আকরিক

এটি বিশ্বের সবচেয়ে গভীর ভূগর্ভস্থ লোহার খনি। এখানে রয়েছে প্রায় 20,000 বর্গমিটার আয়তনের প্রদর্শনী কেন্দ্র যাকে লোহার খনি সম্পর্কিত যাদুঘরও বলা যায়। এখানে লোহার খনিতে ব্যবহার হয় এমন সব পুরাতন ও আধুনিক যন্ত্রপাতি, পরিবহন ট্রলি এবং পরিবেশ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি সুন্দেরভাবে সাজানো আছে। যাদুঘর দেখানোর পর সবাইকে একটি করে হ্যালমেট এবং পলিথিনের রেইন কোর্ট দেওয়া হলো যাতে খনি ঘুরে দেখার সময় কারো মাথায় আঘাত না পায় এবং পোশাকে ময়লা না লাগে। এরপর আমরা গাইডকে অনুসরণ করে খনির ভেতরে লাইভ আকরিক উত্তোলন ও উপরে সরবরাহের প্রসেস দেখলাম। এটা মাটির নিচে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জগৎ। সবকিছু বর্ণনা করলে পোস্ট অনেক বড় হয়ে যাবে। লোহার খনি সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে আগামীতে আলাদা পোস্ট দেবো। সুইডেনে রয়েছে SSAB নামে স্টীল প্রস্তুতকারী বিরাট প্রতিষ্ঠান যাদের একাধিক কারখানা আছে। যা-ই হোক, ওরা আমাদেরকে চা-কফি আপ্যায়নসহ সবকিছু ঘুরেফিরে দেখিয়ে, সব তথ্য বর্ণনা করে এবং ভিজিটরদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সবাইকে আবার একই বাসে করে নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়।

২) সামীদের প্রদর্শনীতে কিছুক্ষণ

আদিবাসী সামিদের জীবনযাপন ও সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী

আগের পর্বে বর্ণিত আইস হোটেলের পাশের এলাকায় রয়েছে আদিবাসী সামীদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতি বিষয়ক উন্মুক্ত যাদুকর। লোহার খনি পরিদর্শনের পর চলে এলাম এখানে। এখানে রয়েছে তাঁবুর মতো দেখতে সামীদের কয়েকটি অস্থায়ী ঘর, সামীদের খাদ্য পরিবেশনের জন্য রেস্টুরেন্ট এবং অনেকগুলো রেইনডিয়ার। আমাদের দেশের গরুর খামারের মতো সামিদের রয়েছে হরিণের (reindeer) খামার। এদের আয়-রোজগারের উৎস হস্তশিল্প, হাতে বানানো ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং হরিণের চামড়া ও মাংশ। এদের রেস্টুরেন্টে মাছ এবং হরিণের মাংশ বিভিন্নভাবে রান্না করে অনেকগুলো খাওয়ার মেনু করা আছে। আমরাও সামান্য খেয়ে দেখলাম। দাম বেশি, পরিমাণে কম এবং খুব একটা মজা লাগেনি। এদের খাদ্যে মসল্লা একদম কম, তাছাড়া বেশিরভাগ আইটেম ধুঁয়া দিয়ে রান্না করা। কিছু বয়স্ক সামি নারী-পুরুষ তাদের নিজস্ব নাচ-গান পরিবেশন করছে।
[উত্তর মেরুর এস্কিমো সম্পর্কে জানতে চাইলে পড়তে পারেন ব্লগার এম এ আলী ভাইয়ের এই পর্বটি:
(উত্তরের যাত্রা : ২ য় পর্ব – এস্কিমো জীবনাচার দর্শন)

৩) কার ট্রিপ (কিরুনা → গ্যালিভারে → পায়ালা → ভিট্টাঙ্গি → কিরুনা)


সামিদের জীবনযাপন ও সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী এক ঝলক দেখে এখান থেকে আমাদের লং ড্রাইভ ট্রিপ শুরু করলাম। বিভিন্ন শহরের মধ্যে আন্তঃসংযোগ সড়কগুলো বেশ প্রশস্ত। এখানে জনসংখ্যা খুব কম হওয়ায় রাস্তায় গাড়িও খুব কম। এসব রাস্তার পাশে কোনো দোকান থাকে না, মানুষজন হাঁটে না এবং মহাসড়কগুলোতে কম গতির গাড়িও চলে না। ট্রাফিক নিয়ম জানা থাকলে এবং মেনে চললে এখানে গাড়ি চালানো সহজ। রাস্তার দুপাশে বেশিভাগই বনাঞ্চল। উল্লেখ্য, সুইডেনের মোট ভূখন্ডের ৭০ ভাগ বনাঞ্চল। অনেক দুর পরপর বিশেষ করে যেখানে সুন্দর দৃশ্য রয়েছে সেখানে রাস্তার দুপাশে গাড়ি পার্কিং ও বসে বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলোর কোন কোনটাতে পাবলিক টয়লেটও থাকে। আশেপাশের শহর, দোকান, রেস্টুরেন্ট এবং বিশ্রামের স্থান সম্পর্কে আগেই রাস্তার পাশে সাইন বোর্ডের মাধ্যমে তথ্য দেওয়া থাকে। তাই এসব এলাকায় যারা নতুন আসে তাদের জন্যও সবকিছু খুঁজে পাওয়া সহজ।

আলটায়্যারভি হ্রদ ও গ্রীষ্মকালীন আবাস

কিরুনা থেকে মহাসড়ক E10 ধরে গ্যালিভারে অভিমূখে যাত্রার ২০ মিনিট পরেই দেখলাম রাস্তার ডানপাশে আলটায়্যারভি হ্রদের পাশে সাজানো-গোছানো সবুজ বনের ছায়া-সুনিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশে অনেকগুলো গ্রীষ্মকালীন আবাস এবং ক্যারাভ্যান নিয়ে রাত কাঠানোর ব্যবস্থা। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা প্রাত্যহিক জীবনের একগেঁয়েমি কাজকর্ম ও সংসার জীবনের সব ঝামেলা ভুলে এখানে নয়ন জুড়ানো নীরব প্রকৃতির মাঝে শরীর-মনকে প্রশমিত করার জন্য কয়েকটা দিন কাটিয়ে যায়। আমরাও সেখানে গিয়ে একটু ঘুরে আসলাম। বেশ সুন্দর জায়গা। এটা নাকি শীতকালেও খুব জনপ্রিয়। তখন হ্রদের পানির উপরের স্তর জমে বরফ হয়ে যায়। তার উপরে তুষারের একটি মোলায়েম প্রলেপ পড়ে। তখন এখানে পর্যটকরা হ্রদের উপরে হাঁটাহাঁটি, স্কী চালানো ও শীতকালীন বিভিন্ন খেলাধুলো করতে আসে।

গ্যালিভারে

শীতের শেষে বরফ গলার পর গ্যালিভারের একটি পাহাড়ি অঞ্চল ও গ্রীষ্মকালে সবুজ-শ্যামল সমতল ভূমিতে একটি হ্রদ

উত্তর সুইডেন বা ল্যাপল্যান্ডে কিরুনারে পরেই গুরুত্বপূর্ণ শহর গ্যালিভারে (সুইডিশ উচ্চারণ: জ্যালিভারে)। জনসংখ্যা প্রায় দশ হাজার। গ্যালিভারের খুব কাছেই গড়ে উঠেছে আরেকটি লোকালয় মালমবারিয়েট। এখানে লোহার আকরিকের খনি পাওয়ায় এখন লোকসংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। গ্যালিভারে উপজেলার প্রায় ১০০ কিলোমিটার পড়েছে মেরু রেখার উত্তরে অর্থাৎ সুমেরু অঞ্চলে। পর্যটকদের জনপ্রিয় রেলভ্রমণ ইনল্যান্ডভানার সরব উত্তরের স্টেশন গ্যালিভারে। এই শহরে ঢুকে আমরা গাড়ি পার্কিংএ রেখে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করার জন্য রেস্টুরেন্টের খোঁজে এদিক-সেদিক হাঁটতে লাগলাম। পীৎজা, কাবাব এবং সুইডিশ খাবার খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তাই একটু ঝাল বা এশিয়ান খাবারের কোন রেস্টুরেন্ট পাওয়া যায় কিনা দেখছি। দূর থেকে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট দেখে তাড়াতাড়ি সেদিকে গেলাম। ঢুকে দেখি রেস্টরেন্টের মালিক ও কর্মচারি বাংলাদশি! আমি থেকেই জানতাম ইউরোপ-আমেরিকার বেশিরভাগ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের মালিক বাংলাদেশি। পৃথিবীর উত্তরে এসে বাংলাদেশি লোক পেয়ে আমরা যতটুকু আশ্চর্য্য হয়েছি তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য্য হয়েছে উনারা বাংলাদেশি পর্যটক পেয়ে!

রাস্তা থেকে একটু দুরে নদীর দৃশ্য ও রাস্তার পাশে যাত্রীদের জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা

যাক দেশিলোকদের হাতের রান্না ঝাল তরকারি, ডাল-ভাত ও টান্দুরি মুরগী খেয়ে এই প্রথমবারের মতো মনে হলো পেট ভরে খাওয়ার খেলাম। দেশিলোকেরা এখানের ভ্রমণ সম্পর্কিত তেমন একটা বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে পারলেন না। কথাবার্তায় মনে হলো ভ্রমণ ও নিঃসর্গ প্রকৃতি নিয়ে উনাদের তেমন একটা আগ্রহ নেই। যা-ই হোক খাওয়া-দাওয়ার পরে দেশিলোকদের থেকে বিদায় নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। এই নিস্তব্ধ-নীরব-নির্জন জনপদে দেশিলোক পেয়ে আমাদের মনের জোর একটু বেড়েছে। অনেকদিন পর পেট পুরে দেশি খাবার খেয়ে এখন গাড়ি চালাতে ঝিমুনি আসছে। ভাবলাম ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালানো ঠিক হবে না। কিছুক্ষণ গাড়ি চালানোর পর রাস্তার পাশে নদীর ধারে প্রকৃতিক পরিবেশে বিশ্রামের জন্য পাতানো বেঞ্চ পেয়ে সেখানে কিছুক্ষণ শুয়ে হালকা ঘুমিয়ে নিলাম। অনেকটা বাংলাদেশে চৈত্রের দুপুরে রাস্তার পাশে বটগাছের নিচে ঘুমানোর মতো অনুভূতি।

পায়েলা


পায়েলা টর্নো নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন শহর। শহর ও আশেপাশের এলাকার মোট লোকসংখ্যা প্রায় সাত হাজার। এখান থেকে ফিনল্যান্ডের সীমানা খুবই কাছে। এখানে সুইডিশ ও ফিনিশ দুটি ভাষারও ব্যবহার চোখে পড়ে। পায়েলাতে গ্রীষ্মকালে কয়েকদিন ব্যাপী বিরাট মেলা বসে। উত্তর সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের অনেক দূরদুরান্ত থেকে লোকজন এই মেলায় আসে। এখানে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের লোকজন অনেকটা এক দেশের বাসিন্দা হিসাবে বাস করে। সীমান্ত সম্পূর্ণ উন্মুক্ত সীমান্তের দুইপাশের দোকানগুলোতে প্রতিটি জিনিসের দাম উভয় দেশের মুদ্রায় লেখা আছে এবং দুই ধরনের মুদ্রায় দোকানদাররা গ্রহণ করে।

ভিটাঙ্গি


ভিটাঙ্গি টর্নো নদীর তীরে একটি প্রাচীন ও খুবই ছোট জনপদ। জনসংখ্যা মাত্র ৮০০ জন। এখানে একটি গীর্জা, দুটি দোকান, একটি রেস্টুরেন্ট ও একটি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। কাছের শহর কিরুনা। জনপদটি ছোট হলেও আশাপাশে রয়েছে প্রকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর বিস্তীর্ণ এলাকা। এখানে বছরের সব সময় পর্যটকের ভীড় থাকে। খরস্রোতা টর্নো নদীর কারণে এখানকার ভূপ্রকৃতি উত্তরের অন্যান্য এলাকা থেকে কিছুটা ভিন্নতর।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেউ যদি বিনা অনুমতিতে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পা রাখে সম্পত্তিটির মালিক সেই ব্যক্তিকে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করতে পারবে। এটা করা সেখানে আইনগত বৈধ। সুইডেনে ব্যক্তিগত বাড়িঘর ছাড়া উন্মুক্ত পাবলিক এরিয়ায় যেসব ব্যক্তিগত সম্পত্তি রয়েছে (যেমন: ফসলের মাঠ, খামার, বনাঞ্চল, পার্ক, বাগান, উন্মুক্ত প্রদর্শনী ইত্যাদি) তা পরিদর্শন করার অধিকার সব লোকের আছে। এর জন্য কোনো পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয় না। তবে শর্ত একটি: পরিদর্শনের সময় কেউ এ ধরনের সম্পত্তি নষ্ট করতে পারবে না বা নষ্ট বা পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করতে পারবে না। তাই নিঃসর্গ প্রকৃতিকে উপভোগ করার জন্য সুইডেন অনেক দেশের পর্যটকদের জন্য স্বর্গরাজ্য।

আরো একটি সুন্দর দিনের সমাপ্তি

প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব ৭ ঘণ্টায় ঘুরে কিরুনা ফিরলাম রাত ১১টায়। খুবই ক্লান্ত থাকায় আর কোথাও গেলাম না। পথে হালকা খাওয়া-দাওয়া করলেও রাতে খাওয়ার জন্য রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খাবার কিনে কটেজে ফিরে গেলাম। স্নান করে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত ১২টা। আমাদের আজকের দীর্ঘ ভ্রমণের মধ্যে চারটি ব্যাপার আমার কাছে বেশ ব্যতিক্রমধর্মী মনে হয়েছে।



রাতের আকাশে হালকা মেঘ এবং সূর্যের তীর্যক আলোর সোনালি আভা। এই দৃশ্যটা রাত ১০টা থেকে প্রায় রাত ২টা পর্যন্ত থাকে। এসময় দিনের আলোটা অনেকটা আমাদের দেশের মাগরিবের আধা ঘন্টা আগে যেরকম আলো থাকে সেরকম। এর থেকে আর বেশি অন্ধকার হবে না। তাই গ্রীষ্মের এই সময় এখানে বেশিরভাগ লোক লংড্রাইভে রাতেই গাড়ি চালায়।

নির্জন নিস্তব্ধ বনাঞ্চলে জন-মানবহীন পেট্রোল পাম্প। এখানে আশাপাশে কোনো বসতি নেই, মানুষের চলাফেরা নেই। গাড়িতে তেল লাগলে ব্যাংক কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করে তেল নেবেন। ব্যাপারটি আমার কাছে বেশ খুবই আশ্চর্য্য মনে হলো। খোলা আকাশের নিচে কোনো কেয়ারটেকার ছাড়া এভাবে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত পেট্রোল পাম্পটি দেখে প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল পরিত্যক্ত। গাড়ি থেকে নেমে পাম্পের মিটার ও কার্ড দিয়ে পেমেণ্টের বক্স দেখে বুঝলাম এটা জীবন্ত! কৌতুহলের বশে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাদের গাড়িতে তেলও নিলাম। প্রথমে ব্যাংক কার্ড ঢুকিয়ে পিন কোড দিয়ে OK দিতে হবে। এরপর কার্ডটি ভেলিট কিনা এবং কার্ডের একাউন্টে টাকা আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে ডিসপ্লেতে তেল নেওয়ার জন্য মেসেজ দেখাবে। উল্লেখ্য, এর আগে পাম্পে সুইচ চাপলেও তেল আসবে না। তেল নেওয়ার পর ডিসপ্লেতে OK বাটন চেপে নিশ্চিত করার পর তেলের পরিমাণ ও দামসহ বিস্তারিত প্রিন্ট হয়ে রিসিপ্ট আসবে।
অটোমেশন, স্বয়ংক্রিয় এলার্ম, ভিডিও ক্যামেরা গার্ড যতই থাকুক না কেন, কোনো হারামজাদা যদি মুখোশ পড়ে এসে পাম্পটি ভেঙ্গে দেয় বা আগুন লাগিয়ে দেয় কী অবস্থা হবে! যা-ই হোক, সবকিছুকে আমাদের দেশের চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিতে দেখা ঠিক হবে না।

বিশ্বের বড় বড় অনেকগুলো শহরের অবস্থানের দিক ও দূরত্ব। Pajala (এরা উচ্চারণ করে 'পায়েলা';) থেকে ফিনল্যান্ডের বর্ডার খুবই কাছে, গাড়িতে ৮ থেকে ১০ মিনিট লাগে। এখানে এসে েদখলাম একটা খুঁটিতে বিশ্বের বড় বড় অনেকগুলো শহরের অবস্থান ও দূরত্ব দেওয়া আছে। যেমন লন্ডন ২২৩৯ কিমি. সিডনি ১৫০০০ কিমি., দুঃখিত ঢাকা নেই! থাকলে ঢাকা থেকে ঠিক কত কিলোমিটার দূরত্বে আছি জানতে পারতাম :)। গুগল ম্যাপ অনুসারে ঢাকা থেকে পায়েলার দূরত্ব সরলরেখায় হিসাব করলে ৬৫০০ কিলোমিটার।

উন্মুক্ত বনাঞ্চলে হরিণের রাস্তা পারাপার এখানে নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। যেখানে হরিণের আনাগোনা বেশি সেখানে রাস্তায় সতর্কতামূলক ট্রাফিক সাইন দেওয়া থাকে যাতে চালকেরা গাড়ি আস্তে এবং সতর্কতার সাথে চালায়। আমার সাত ঘন্টার ভ্রমণে আমি এরকম পরিস্থিতিতে দুইবার পড়েছি। একবার খুব অল্পের জন্য রক্ষা! গাড়ির গতি ছিল তখন ৭০ কি.মি./ঘন্টায়। দুই পাশেই গভীর বন। হঠাৎ দেখলাম একটি হরিণ দৌঁড়ে রাস্তা পাড় হচ্ছে। কড়া ব্রেক করে হরিণ ও আমরা উভয়েই দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেলাম। বড় সাইজের হরিণের সাথে ছোট সাইজের গাড়ির সংঘর্ষ হলে হরিণের থেকে গাড়ি এবং মানুষের ক্ষতি বেশি হয়।


ফটো গ্যালারি:

১।

লোহার আকরিক উত্তোলনকারী কোম্পানী LKAB

২।

শহর স্থানান্তরের জন্য নতুন জায়গা ভরাট করা হচ্ছে

৩।

খনির পার্শ্ববর্তী এলাকার একটি বাড়ি উঠিয়ে নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য

৪।

আদিবাসী সামীদের গৃহপালিত একটি হরিণকে পাতা খাওয়াচ্ছে আমার মেয়ে

৫।

গ্রীষ্মকালে শান্ত ও সুস্থির আল্টায়্যারভি হ্রদ

৬।

শীতকালে হ্রদের উপরিভােগের পানি বরফে পরিণত হয় ও এর উপরে থাকে তুষারের প্রলেপ।

৭।

পায়েলার অদূরে সবুজ বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা টর্নো নদী

৮।

পায়েলার বাৎসরিক মেলা


তথ্য ও ছবিসুত্র: কিছু নিজের, কিছু ইন্টারনেট থেকে নেওয়া

     ◄ পর্ব ৪ --- উত্তর মেরুতে নিশি রাতে সূর্য দর্শন --- পর্ব ৬


সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ২:৪৬
১৪টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×