somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সংগ্রামের ইতিহাস কি অবান্তর? ৫

১২ ই আগস্ট, ২০০৭ রাত ৯:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্ব

এই সিরিজ শুরু করার একটা ঐতিহাসিক শানে নুযুল আছে। গত বছর আগস্টে লেবানন প্রসঙ্গে অরূপ-সাদিকের বচসা থেকে মাথায় আসে। ইতিহাস, বিশেষত গণ সংগ্রামের ইতিহাস কি সত্যিই অবান্তর? ঔপনিবেশিক শোষনের বিরুদ্ধে জনগনের সংগ্রাম কি ঐতিহাসিক সিগনিফিকেন্স হারিয়েছে? আজকের ফাটকাবাজীর উন্নয়ন তত্ত্বগুলো কি মুহুর্তের ইশারায় ইতিহাসের দগদগে ঘা গুলো শুকিয়ে ফেলতে পারে? ইতিহাস কতিপয় বিচ্ছিন্ন ঘটনার নিরাসক্ত সমাবেশ হলে সমাজবিজ্ঞানে প্রাক্সিসের মাজেজা কি? কোন উপাদান ব্যবহার করে? ইতিহাসের রেফারেন্স অস্বীকার করে কিভাবে "উপাদান"কে "উপাদান" হিসেবে চেনা যায়? ইতিহাসের ব্যাখ্যাকে সুনির্দিষ্ট অবস্থানের রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত করার বিষয়টা ঠিকাছে। তাতে গণযুদ্ধের সমর্থকরা বরং শক্তিশালীই হয়। নিরপেক্ষ ইন্টারপ্রিটেশানের অস্তিত্ব অস্বীকার করতেই শ্রেণীর প্রসঙ্গ আসে। সুতরাং রাজনৈতিক অবস্থানের অভিযোগ কোন অভিযোগ নয়, তথ্য। সেখানে ১৯৭১ এ গ্রামবাসী যখন শান্তি কমিটি সদস্যের চোখ ট্যাটা দিয়ে তুলে ফেলেন সেটা ইতিহাসে রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী পক্ষের ব্যাখ্যাতেই স্থান পায়। সেখানে তেমন কোন সমস্যা নেই। গত অন্তত শ'দেড়েক বছরে উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে সবচাইতে সক্রিয় ছিলেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। প্রতিষ্ঠান তাকে অনবরত ম্যানিপুলেট করেছে। গণসংগ্রামের লিখিত ইতিহাসে তাই বর্ণহিন্দুদের উল্লেখ কৃষক বিদ্রোহের তুলনায় বেশী থাকে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাস লেখক চতুরতার সাথে সার্চ লাইট ফেলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাতিষ্ঠনিক বিকাশের উপর।

১৯৪৭ পরবর্তী পাকিস্তান শুরু থেকেই ফ্যাসিস্টদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় পুঁথিপত্র তাদের কাছে অবান্তর বিষয়। তারা অশিক্ষা এবং কুপমন্ডুকতাকে ইসলামের গ্লোরি হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতা ছিল তাদের রাজনীতির একমাত্র পুঁজি। লিখিত ইতিহাস দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা প্রমাণ করা যায় না। সুতরাং শুরু থেকেই তাদের অবস্থান ইতিহাস বিরোধী ছিল। বর্ণাশ্রম থেকে মুক্তি পেতে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণ কোন অবস্থাতেই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ র তথাকথিত দ্বিজাতিতত্ত্বকে হালাল করে না। কারণ জিন্নাহর সমর্থনের ভিত্তি ছিল মুসলমান জমিদাররা, যারা কার্যত বর্ণহিন্দুদের ব্যবসার অংশীদার ছিল। সবচাইতে বড় কথা ১৯৪৬ এর সাম্প্রদয়িক দাঙ্গার সময় পূর্ব বঙ্গের হিন্দু জমিদারদের সম্পত্তি দখল দরিদ্র বা ভুমিহীন কৃষকরা করেনি। তারা সেটা সমর্থনও করেন নি। কোন একটা হত্যাকান্ডে নিরীহ কৃষকদের অংশগ্রহণ ছিল না। পুরো ঘটনাটাই ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে ঘটানো। ১৯৪৭ এ পূর্ব আর পশ্চিমবাংলার মাঝের দেওয়াল শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া মাড়োয়াড়ি আর আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ "রমজান"দের চোরাকারবারীর স্বার্থ উদ্ধার করেছে। শ্রেণী সংগ্রামের নির্দেশনা ছিল তার ঠিক বিপরীতে।

পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধগুলো এসেছিল সেই ডিরেকশান থেকেই যারা সক্রিয়ভাবে ১৯৪৬ এর দাঙ্গার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। জমিদারী প্রথা অফিসিয়ালী উঠে গেলে ১৯৪৬ এর দাঙ্গার বেনিফিশিয়ারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা পাবার পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। বিপরীতের সংগ্রাম ঠেকাতে সিপিআই এর ঐতিহাসিক বিভ্রান্তির সুযোগে আবারো প্রতিষ্ঠাণ প্রভাবিত প্লাটফর্ম জন্ম নেয়। তবে পাকিস্থান আমলের রাজনৈতিক সংগ্রামের খুব উল্লেখযোগ্য একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কখনোই শ্রেণী সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়া। এই প্রবণতার প্রভাবই মার্কিনপন্থী আওয়ামী লীগকে শেষ পর্যন্ত অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারস্থ হতে বাধ্য করে। ১৯৬৬তে পার্টি ভেঙে গেলে লাভবান হয় শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ। যার প্রমাণ হচ্ছে ১৯৭০ এর নির্বাচনে ১৯৬৮-৬৯ এ নিহত গরুচোরদের আওয়ামী ঘোমটা পড়ে পীঠ বাঁচানো।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই পীঠ বাঁচানোরাই শান্তি কমিটিতে যোগদেয়। ১৯৭১ এর মার্চ থেকে ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে(পাকিস্থানের পক্ষে) সক্রিয় অবস্থানকারীদের সকলেই ব্যতিক্রমহীনভাবে দ্বিজাতিতত্ত্বের বেনিফিসিয়ারী জোতদার-মহাজনদের শ্রেণীভুক্ত। যারা ১৯৭২ সালে অতিদ্রুত আওয়ামী লীগে যোগদান করে নিজেদের পীঠ বাঁচান। (অনেক জোতদার বা তাদের ছেলেপুলেরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বলে দাবী উঠতে পারে কিন্তু তাদের সংখ্যা কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রদের অনুপাতে নগন্য।) পুরো যুদ্ধের সময় জুড়ে আওয়ামী নেতৃত্বের একাংশের মাথা ব্যাথা ছিল কিভাবে মুক্তিবাহিনিতে বামপন্থীদের যোগদান ঠেকানো যায়। মুজিব বাহিনির জন্মের প্রেক্ষাপট সেটাই।

শেখ মুজিবের আমলে রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত জোতদারদেরই জয়ী করে, যে কারণে তাজউদ্দিন আহমেদকে মন্ত্রীসভা থেকে বিতাড়ন করা হয়। জোতদারদের বিজয়কে স্থায়ী করতে ঘটে ১৫ আগস্টের সামরিক অভূত্থান। শেষ মুজিবের আমলে ঢালাও জাতীয়করণের মাধ্যমে কলকারখানাকে অকার্যকর করা এবং জিয়ার আমলে লোহালক্করের দামে বিকিয়ে দেওয়ার বেনিফিসিয়ারী সেই জোতদার মহাজনরা যারা সেই ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ থেকে যাবতীয় রাজনৈতিক ফেনোমেনার বেনিফিসিয়ারী। শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় টুকুতে তারা কার্যকর প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। এর বাইরে তারা বাকি সবকিছুতেই শক্তিশালী হয়েছে, হচ্ছে।

"উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম" নামের পরিভাষাকে মেনে নিলে অটোমেটিক্যালি আলোচনা "ওয়ার্লড সিস্টেম থিওরি" বিরোধী অবস্থানে চলে যায়। সেক্ষেত্রে "ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিট্যালিজম" এর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। যার অর্থ যেকোন সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ পুঁজির কেন্দ্রীভবনের সাথে জড়িত। সেক্ষেত্রে সব্চাইতে বেশী গণবিরোধী অবস্থানে পড়েন সামরিক-আমলাতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী। আর তাদের সহায়ক হিসেবে ব্যতিক্রমহীনভাবে অঞ্চলভেদে ধর্ম অথবা জাতীয়তাবাদ ব্যবহারকারী ফ্যাসিস্ট চক্র।

এই ফ্যাসিস্ট চক্রকে সাম্রাজ্যবাদ সরাসরি অর্থ এবং অস্ত্রানুকুল্য দিয়ে গড়ে তুলেছে প্রতিবাদকারী জবাই এর উদ্দেশ্যে। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদের বহুমুখী প্রচারকদের মধ্যে এই সংগঠিত সশস্ত্র চক্রটিই প্রধাণ। এদের বিরোধীতার ক্ষেত্রে যার অবস্থান যতটা সক্রিয় তার ভিত্তিতেই প্রতিরোধের চৈতন্যগত অবস্থান নির্ধরিত হয় এবং হবে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ৩:৪৩
২৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×