এলেবেলে...
আত্মজীবনী লেখার ক্ষেত্রে আমার খুব একটা উপযুক্ত বয়স হয়নি। জীবনী লেখবার মতো জীবন ও কাটাইনি তাই, এটাকে জীবনী না বলে স্মৃতিচারণ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবো।স্মৃতিচারণে বয়স বা ব্যক্তিত্ব কোনো বাধাই নয় এই যা ভরসার কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যখন ই স্মৃতিচারণ করতে যাই তখন তারা যে আমার স্কুল জীবনের এসেম্বলিতে দাড়ানো প্রথম সারির ভালো ছেলেগুলোর মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে একের পর এক আসবে তা নয়...বরঞ্চ ঠিক আমার ই মতো লাইনের বিভিন্ন মাথা থেকে কেওয়াজ করতে করতে ঠেলাঠেলি হুড়োহুড়ি করে ভজঘট লাগিয়ে তেক্ত করে ছাড়ে, খেই হারিয়ে ফেলি। কোন ঘটনার পর যে কোন ঘটনাটা ঘটেছিল তার তাল থাকে না, উলটো অই ঘটনার পর ওটা ঘটলে কতো ভালো হতো এই ভাবতে ভাবতে স্মৃতির বদলে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাই বারবার।যাই হোক এটাই তো হারাবার বয়স। দাদু বলে গেছেন “কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা...মনে মনে...”। খামাখা বলে গেছেন নাকি? আমার জন্যই বলে গেছেন। উনি বুড়া ঝুরঝুরা বয়সে হারাতে পারলে আমার জওয়ান গরম রক্ত কি দোষ করলো। যাই হোক আবার অকাজের কথায় ফেরত আসি।আমি রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি পেশ করলাম জানতে পারলে ঢাকা শহরের সেরা স্কুলের শ্রেষ্ঠ বাংলা স্যার অযু করে পরপারে রওনা দিবেন, অসংখ্য কমলমতি শিশু বঞ্চিত হবে। কাজটা ঠিক হবে না। স্যারের কথায় মনে হলো স্কুল লাইফ নিয়ে স্মৃতি ঘাটাঘাটি করলে কেমন হয় ! এলেবেলেই তো লিখতে বসছি যা খুশি লিখলেই হলো...আমি নিজে ছাড়া আর পড়বেটাই বা কে...আর পড়লেই বা কি...কাউকে বিনোদন করতে বসছি নাকি !
হুম, স্কুল লাইফ... যে লাইফে বাপ-মার কাছে পোলাপানের স্কুল টাই মেইন, লাইফ গৌণ আর পোলাপানের কাছে লাইফ টাই মেইন বাকি সব ই গৌণ । এ দুইএর কেচকিতে পরে ইতিহাসে যত বিরল প্রতিভা ধ্বংস হয়েছে এই বান্দা তন্মধ্যে অন্যতম। এ ভাবলে চলবে না যে নিজ জীবনের ব্যর্থতা ঢাকতে স্কুল জীবনের উপর দোষ ঢেলে দিলাম। মাশাল্লাহ আমার স্কুল ছিলই অমন যে স্যারদের দশ মণি কুনির তলে চাপা পরে সুপ্রতিভা আটকে যেত আর বিশফোড়ার মতো কুপ্রতিভা ফেটে এমন সব দুরমতি গলগল করে বের হয়ে আসতো যে তাতে জীবন খুব সমৃদ্ধশালী বা সম্মানীত হয়ে উঠার অবকাশ পাবে বলে নিজেরাই আশা করতে পারতাম না। আর কুনি মারার ক্ষেত্রে স্যারদের সুনজর ডিএসএলআর ক্যামেরার ডিজিটাল জুমের মতো আমার উপর পুরো স্কুল লাইফে ফোকাস হয়ে থাকতে দেখে আসছি। স্যারদের ব্যায়ামের জন্য আমার অবদান হাশরের ময়দানে শ্বেতপাথরের উপর স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। স্যারদের আশীর্বাদ পুষ্ট এই শরীরের কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যে বেহেস্তের দখলদারিত্ব মুক্ত হবে না তাতে আর দ্বিধা নেই তবে, ভয় হয় দুই-একটা নিতান্ত স্পর্শকাতর স্থাণ না আবার অন্য কোথাও চলে যায়...তাহলে আর বেহেস্তেও প্রবেশ করবো না এই আমার পাকা সিদ্ধান্ত।
আসল কথায় আসি। আমার জীবনে স্কুল ছিল মোট তিনটি। প্রথম স্কুল বেপারে একেবারেই কিছুই মনে নাই। শোনা কথা আমার বাসা থেকে দুই পা দূরে আমাদের গলির ভিতরেই বেশ নাম করা দীপশিখা স্কুল ই আমার প্রথম স্কুল। যে স্কুলে আমি সর্বসাকূল্যে ৩দিনের মতো পরেছিলুম। প্রথমদিন ক্লাসে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়ার পর আম্মাজান কে না দেখে ফোঁপানি সহকারে কান্নার সাথে শুরু হয় আমার জ্ঞানের রাস্তায় হামাগুড়ি দেয়া। টিচাররা প্রথমদিন মাকে এলাও করলেন... দ্বিতীয় দিন বিশেষ বিবেচনা করলেন... তৃতীয় দিন দুইজনকেই ভদ্রভাবে বের করে দিলেন। ওই ছিল অধমের উপর খোদার শেষ মেহেরবানি। এক বছর পর ই অধমকে ভর্তি হতে হয় তুলনামূলকভাবে দূরের এক স্কুলে...রিক্সায় যেতে হতো।
শান্তিনগরের এই স্কুলটার নাম ছিল আব্দুল্লাহ ফারুক ট্রিনিটি হাই স্কুল। সংক্ষেপে ট্রিনিটি স্কুল। আমার বড় প্রিয় স্কুল। আজ আর স্কুলটা নেই বোধ হয়। আমার প্রিয় জিনিসগুলো কখনো বেশিদিন টিকে না...টিকলেও দেখা যায় আমার পছন্দের সংজ্ঞাই পালটে গেছে। যাহোক এই স্কুলে ও প্রথমদিকে কয়েকদিন বেশ যন্ত্রণা করলাম। আম্মাজানকে পাশে নিয়ে ক্লাস করলাম। দুই-চারদিনের ভিতর স্বাবলম্বি ও হয়ে গেলাম। মাকে আর দরকার হলো না।(মাকে আর দরকার হলো না...পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ দেখা যায় যাদের কাছে মা=দরকারি বস্তু...প্রয়োজন শেষ তো মা চক্ষুশূল...নিরপেক্ষভাবে নিজের স্মৃতি ঘেটে আমি তাদের সাথে নিজেকে আলাদা করতে পারছি না... পৃথিবীর প্রতিটি মা এর কাছে স্বার্থপর এই ছেলেটি ক্ষমা চায়)।
আমি জানি না এই স্কুলটার বাতাসে কি ছিল...শুধু জানি এমন কিছু একটা ছিল যা অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করতে পারে। প্রমাণ, আমি নিজে। কারণ স্কুলটাতে আমি ছিলাম রেকর্ড ভাঙ্গা ছাত্র। ষাণ্মাসিক পরীক্ষার দশদিন আগে ভর্তি হয়েও রেকর্ড ভেঙ্গে ফার্স্ট। নিজের ঢাক পিটাতে চাচ্ছি না কিন্তু লিখিত স্মৃতিচারণ সৎ হতে হয়। ঢাক পিটাচ্ছি কেন একটু পর পরিষ্কার হবে। স্কুলটাতে যতদিন পড়ি তাতে একবার ই দ্বিতীয় হই, বদলা নেই আরেকবার রেকর্ড ভেঙ্গে। এরকম ভাল ছাত্রদের উপর টিচারদের বিশেষ কৃপা দৃষ্টি থাকে। অসম্ভবের ওই দিনগুলোতে আমার উপর ও ছিল। বেশি মাত্রায় ছিল। মনে পড়ে একবার এক পরীক্ষায় সবার আগে লেখা শেষ করে বসে ছিলাম দেখে যে আপা গার্ড দিচ্ছিলেন উনি সাংঘাতিক দুশ্চিন্তায় পরে আমার পাশে এসে চোরের মতো বলেছিলেন “বোকা ছেলে না পারলে আমাকে ডাকো না কেন? কোনটাতে আটকে গেছ বলো, আমি বলে দিচ্ছি”। আহারে স্মৃতি...এই জন্যেই স্মৃতি এত মধুর। এ ছাড়াও আরো বহু প্রমাণ ছিল যেমন লেট করলেও শুধু আমি ক্লাসে ঢুকতে পারতাম...আমি ভুল উত্তর দিলেও ক্লাসে আমার সম্মান রাখতে উনারা ওটাকে রাইট বলে বসতেন (এই বেপারটায় মজা পেয়ে আমি প্রায়ই ইচ্ছা করে ভুল উত্তর দিতাম) এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, আমাকে কোনো কারণেই কোনোদিন শাস্তি দিতেন না। আমার উপর টিচারদের বিশেষ দৃষ্টির মাত্রা বুঝাতে ঘটনাটা উল্লেখ করলাম। এটা ছিল প্রথম ধাপ। যে ঘটনাটা আসলে বলতে চাচ্ছি তা বলার আগে দুটো ধাপ পার হতে হবে। প্রথম ধাপে বললাম আমাকে টিচাররা কি দৃষ্টিতে দেখতেন এবং তার কারণ...
এইবার দ্বিতীয় ধাপ,
স্কুলে আমার শুরুতে বন্ধু ছিল তিনজন। জাভেদ,রাতুল আর মাহাবুব। যদিও ক্লাসে ছেলে মেয়ে একসাথে ছিল কিন্তু আমরা কোন এক অদ্ভুত কারণে ওই অতোটুকু বয়সেই মেয়েদের পাত্তা দিতাম না, বন্ধুত্ব করতাম না। জাভেদের অন্তর পুড়ে ঝামা কিন্তু আমার “সিদ্ধান্তর” উপর কিছু বলতেও পারতো না। এরপর আমার এক মেয়ে কাজিন ভর্তি হয়...শুরু হলো শনির চক্র। ক্লাসের কিছু মেয়ে আমাদের বন্ধু হতে চাইতো। আমার কাজিন এসেই তাদেরকে দলে নিয়ে নিল। আমার সাথে এক ক্লাসে পড়লেও সে আমার বড় সো কিছু বলার উপায় ছিল না। ওর কিল বড় সাংঘাতিক ছিল বাবা। দলে ভিড়ল ফাল্গুনি, মুক্তি আর লোপা। এর মধ্যে ফাল্গুনি ছিল সেইরাম সৌন্দর্য। ফরসা, লালচে চুল, বাদামি চোখ, কমলা ঠোঁট এবং সবচেয়ে বড় কথা আমার পর ই তার অবস্থাণ। ক্লাসের সেকেন্ড। ওদের সাথে মিশতে মিশতে কয়েক মাসে পেকে ইয়ে হয়ে গেলাম। ফাল্গুনিরে দেখে প্রায়ই বুক চিনচিন করে। গোঁদের উপর বিষফোঁড়া, মাইয়া আমার প্রতি বেসম্ভব রকম কেয়ারিং। আর কি লাগে ভাইলোগ...হয়েই গেল সর্বনাশ। যাও বা বাঁচার আশা ছিল তাও খাইলো আমার কাজিন। আমারে একদিন বলল লোপা আমারে “লাভ ইউ” করে। মানুষের চেহারা নিয়ে কিছু বলা ভদ্রলোকের কাজ না। আমি ভদ্রলোক না সো বলবো। লোপা ওই বয়সে আমার থেকে আধা হাত লম্বা, নেড়া মাথায় সবে কদমফুলের মতো চুল গজাচ্ছে এবং কালো ঠোঁটের আড়ালে ফোকলা হাঁসি। একটুকুও বানানো বর্ণনা না। এই ভয়ঙ্কর সংবাদ শুনেই মাথায় কেমিকেল লোচা হয়ে গেল।
এইবার আসল কাহিনী,
পরদিন স্কুলে গেলাম। জানের তিন দোস্তরে দেখেও মন মগজ ঠিক হইল না। ধীরে ধীরে সবাই ক্লাসে আসলো। ফাল্গুনি আমার পাশে তার নিয়মিত জায়গা দখল করে নিল। আমার বুকে ধাই ধপাধপ। ওর সাথে ঠিকভাবে কথা বলতে পারি না আর। মনে মনে শিওর হয়ে গেসি যে আমারো “লাভ ইউ” হয়ে যাইতেসে। এর মধ্যে এসে ঢুকল লোপা, মুক্তি আর আমার পাকনা কাজিন। ব্যাস, লোপার খোমা দেখার সাথে সাথে আমি শিওরের উপরে সাড়ে শিওর হয়ে গেলাম যে আমার ফাল্গুনির সাথে লাভ ইউ হয়েই গেসে, আর কোনো উপায় নাই। ফাল্গুনির চেহারার মধ্যে আমি বউ,বোন,মা,মাদার টেরেসা সব দেইখা ফেললাম। বুঝলাম ওই আমার পরিত্রাতা। বাঁচতে হলে ওর আর আমার লাভ ইউ হইতেই হবে, অ্যাট এনি কস্ট। বাট যে মুহূর্তে এটা ভাবা ওই মুহূর্ত থেকেই আমি ফাল্গুনির সামনে কেমন জানি কেঁচো টাইপের হয়ে গেলাম। ওর সাথে আর ভালোভাবে কথা বলতে পারি না। মনে অস্বস্তি নিয়ে দিনটা কাটলো। এরপর আরো কয়দিন খারাপ গেল। লোপার ভয়ে সব ফ্রেন্ডকেই এড়ায় চলি। ফাল্গুনিরে দেখলে টাকরা শুখায় যায়। ক্লাস ওয়ানের হাটু সাইজের বাচ্চার বুকে গন্ধমাদন পর্বত সমান চাপ। এরপর ই ঘটলো ঘটনা। একদিন স্কুল শেষে বসে আসি বারান্দায় বাবা এসে নিয়ে যাবে এই অপেক্ষায়, মন বিক্ষিপ্ত। আসলো আমার নায়িকা, ফাল্গুনি। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের পিছনে বাথরুম। চোরা মন নিয়ে ফাল্গুনির সাথে ঠিকভাবে কথা বলতে পারলাম না। ফাল্গুনি রাগ করে উঠে যাচ্ছিল, চোখে পানি। নগদে আমার প্রেমিক বংশের রক্তে জোয়ার ডেকে গেলো। লাফ দিয়ে উঠে মেডামের হাত ধরে টান দিলুম। ইচ্ছা ছিল সব কথা খুলে বলার কিন্তু কথাগুলো অত্যন্ত গোপন, আড়ালে বলা উচিত এই বোধ(!) আমার ছিল...আর তাতেই খাইলাম ধরা রে মামা। মাইয়ার হাত ধরে টান দিলাম বাথরুমের দিকে। ফাল্গুনি প্রথমে অবাক, তারপর টাসকি, সবশেষে আতঙ্কিত হয়ে ম্যা আ আ আ করে উঠলো। আমি ততোধিক টাসকিত ও আতংকিত হয়ে হাত ছেড়ে দিতেই পালায় গেলো। চরম টেনশন আর অপরাধবোধ নিয়ে দিনটা কেটে গেলো।
পরদিন ঘটলো সেই দুঃস্বপ্ন যা আমি কোনোদিন কল্পনাও করিনি।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১:৩১