ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ: আলোচিত ও অনালোচিত কারণসমূহ পর্ব -৭
আমরা আগেই দেখেছি যে, সন্ত্রাসীদের জাতি, ধর্ম গোত্র ইত্যাদিকে ঢালাওভাবে ‘সন্ত্রাসের’ কারণ বা চালিকা শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা সঠিক নয়। এতে সন্ত্রাস দমনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। কারণ, কোনো, জাতি, ধর্ম বা গোত্রের সকল মানুষকে তো আর ঢালাওভাবে বিচার করা যায় না। জঙ্গিবাদের দায়িত্ব ‘ওহাবী মতবাদের’ উপর চাপানোর বড় বিপত্তি হলো, এসে সমস্যা সমাধানের পথ হারিয়ে যাবে। কেননা সৌদি ওহাবীদের সাথে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক স্থাপন করা কঠিন, কারণ জঙ্গিবাদ তাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত। আর অন্য কোনো দেশের কেউ নিজেকে ওহাবী বলে স্বীকার করেন না, কিন্তু প্রায় সকল ধর্মীয় দলই বিরুদ্ধবাদীদের দ্বারা ‘ওহাবী’ বলে আখ্যায়িত।
আলোচিত চতুর্থ কারণ: ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্র
বিশ্বের সর্বত্রই সাধারণ আলিম-উলামা, পীর-মাশাইখ, ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও ইসলামী দলসমূহ জঙ্গিবাদের বিরোধিতা করছেন এবং নিন্দা করছেন। সাধারণভাবে তাঁরা উপরের তিনটি কারণকে জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণ বলে স্বীকার করেন না। রবং তাঁরা দাবি করেন যে, ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রের কারণেই এই জঙ্গিবাদের উত্থান। ইসলামকে কলঙ্কিত করতে, ইসলামী দেশগুলির আর্থ-সামাজিক উন্নতি বন্ধ করতে এবং এ সকল দেশে সামরিক আধিপত্য বিস্তার করতেই তারা গোপন অর্থায়নে কিছু মুসলিম যুবককে বিভ্রান্ত করে এরূপ জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করেছেন।
তাঁরা তাদের এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারেন না, তবে অনেক যুক্তি পেশ করেন। তাঁরা দাবি করেন যে, এই বোমাবাজি, অশান্তি, সন্ত্রাস এগুলি মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে কখনো দেখা যায় নি। ‘সভ্যতার সংঘাত’ থিওরি আবিষ্কারের পূর্বে বিগত দেড় হাজার বৎসর ধরে কখনোই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ‘জিহাদ’ নামে এরূপ সন্ত্রাস কখনোই দেখা যায় নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত যুদ্ধের ময়দান ছাড়া কোথাও কোনো মুসলিম ব্যক্তিগতভাবে বা দলগত ভাবে কাউকে গুপ্ত হত্যা করেছে, কারো বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করেছে…. ইত্যাদির কোনো নযির আমরা দেখতে পাই না। ‘সভ্যতার সংঘাত’ থিওরি আবিষ্কারের পরে পাশ্চাত্য বিশ্ব নিজ প্রয়োজনেই এই অবস্থা তৈরি করে নিয়েছে।
দীর্ঘ অর্ধ সহস্র বৎসর যাবৎ ক্রুসেড যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন ইউরোপীয় খৃস্টানগণ। ১ম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পতন ও মুসলিম বিশ্বে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে ক্রুসেডের সমাপ্তি হয়েছে বলে ধারণা করেছিলেন তারা। বিংশ শতাব্দির ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষত সেভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পরে তারা হিসাব নিকাশ পাল্টে ফেলেন। তারা ‘সভ্যতার সংঘাতের’ থিওরী উপস্থাপন করেন। তারা ভালভাবেই উপলব্ধি করেন যে, মুসলিম বিশ্বকে তার নিজের গতিতে অগ্রসর হতে দিলে ২১শ শতকের প্রথমার্ধেই মুসলমানগণ ‘বিশ্ব শক্তিতে’ পরিণত হবে। অর্থনৈতিক স্থিতি, প্রযুক্তিগত শক্তি ও সমর শক্তিতে তারা শক্তিশালী হয়ে যাবে এবং তাদের ‘নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানোর’ কোনো সুযোগ থাকবে না। মুসলিম উম্মাহকে ঠেকাতে হলে তাদেরকে আঘাত করতে হবে।
কিন্তু আঘাত তো কোনো ‘কারণ’ ছাড়া করা যায় না। স্বভাবতই কোনো মুসলিম দেশই পাশ্চাত্যের সাথে কোনো সংঘাতে যেতে রাজি নয়। কিন্তু সংঘাত না হলেও তো কাজ উদ্ধার করা যাচ্ছে না। বিশেষত দুর্বলকে সংঘাতের মধ্যে নামাতে পারলে বিজয় নিশ্চিত থাকে। এজন্যই তাঁরা এই জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়েছেন।
এ সকল মুসলিম পণ্ডিত আফগান জিহাদকে অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করেন। সোভিয়েত আগ্রাসনের প্রতিবাদে আফগানিস্থানের মুসলিম জনগোষ্ঠি প্রতিরোধ শুরু করে। আমেরিকা এই সুযোগে এ সকল প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে অস্ত্র, ট্রেনিং, প্রযুক্তি ও সকল প্রকার সাহায্য দিয়ে এগিয়ে নেয়। সারা বিশ্বে এদের পক্ষে প্রচার চালায়। এরপর তারা তাদেরকে উস্কানির মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য করে। তারা বেপরোয়া হয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলেন। পরিত্যক্ত ও উত্তেজিত এ সকল মানুষ আবেগ তাড়িত হয়েও অনেক কাজ করতে থাকেন। এছাড়া এ সকল ‘মুজাহিদ’দের মধ্যে আমেররিকার নিজস্ব অনুচর রয়েছে। যারা এদেরকে ‘সংঘাতের পথে’ যেতে প্ররোচিত করছে। এরা জিহাদ ও কিতাল বিষয়ক আয়াত ও হাদীসগুলির অপব্যাখ্যা করে মুসলিম উম্মাহকে ‘প্রিম্যাচিউরড’ সংঘাতের পথে যেতে উস্কানি দিচ্ছে। এভাবে সারা মুসলিম বিশ্বে ‘জিহাদের’ বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
‘ইসলামপন্থী’দের এই দাবির যুক্তি যত জোরালোই হোক তার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। এছাড়া এই দাবিও সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে কোনোরূপ সহায়তা করে না। সর্বোপরি, শত্র“ তো শত্র“র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেই। যদি কেউ সত্যিই ইসলামের শত্র“ হন তবে তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এজন্য তাঁদের দোষ দেওয়া বা তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা অর্থহীন কর্ম। আমাদের দেখতে হবে কি কারণে মুসলিম যুবকগণ তাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছেন। কারণগুলি চিহ্নিত করে সেগুলির প্রতিকার না করতে পারলে আমাদের দোষারোপ ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও তাঁদের ষড়যন্ত্র সফলতা লাভ করবে।
মুলঃ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
পি-এইচ. ডি. (রিয়াদ), এম. এ. (রিয়াদ), এম.এম. (ঢাকা)
অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া