somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ: আলোচিত ও অনালোচিত কারণসমূহ পর্ব -১৪

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ: আলোচিত ও অনালোচিত কারণসমূহ পর্ব -১৪

বর্তমান যুগে ইসলাম প্রচার, সৎকাজে আদেশ, অন্যায় থেকে নিষেধ, দ্বীন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, ‘ইসলামী আন্দোলন’ ইত্যদি বিভিন্ন ইসলামী কর্মকে ঢালাওভাবে ‘জিহাদ’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। এগুলি সবই ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত এবং এগুলির প্রত্যেকটির ইসলামী শরীয়তে পারিভাষিক নাম ও বিধিবিধান রয়েছে, যেগুলি পারিভাষিক জিহাদের বিধান থেকে ভিন্ন। যারা এ সকল কর্মকে জিহাদ নামে আখ্যায়িত করছেন তাঁরা মূলত এগুলির গুরুত্ব বুঝাতে ও এগুলিতে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আভিধানিক অর্থে তা করছেন। কিন্তু আমরা দেখছি যে, এর ফলে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো আলিম যখন দাওয়াত, দ্বীন প্রতিষ্ঠা, আন্দোলন, রাজনীতি, মিছিল ইত্যাদিকে জিহাদ বলে আখ্যায়িত করেন, তখন তিনি কখনোই বুঝান না যে, এই কর্মের জন্য অস্ত্র ধারণ করা যাবে, অথবা এর বিরোধীদেরকে আঘাত করা যাবে। কিন্তু তিনি না বুঝালেও শ্রোতা, পাঠক বা সংশ্লিষ্ট অনেকেই তা বুঝছেন।
এই ‘বুঝ’ জঙ্গিবাদীদেরকে অত্যন্ত সহায়তা করছে। জঙ্গিবাদীদের মতাদর্শের দুটি পর্যায় রয়েছে:
প্রথমত, জিহাদকে ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হিসেবে দাবি করা।
দ্বিতীয়ত, জিহাদের জন্য অস্ত্রধারণ, হত্যা, মৃত্যুবরণ ইত্যাদিকে অত্যাবশ্যকীয় বলে দাবি করা।
কুরআন-হাদীস ও ইসলামের ইতিহাস থেকে দ্বিতীয় বিষয়টি প্রমাণ করা তাঁদের জন্য খুবই সহজ বিষয়। এজন্য তাঁদের বিভ্রান্তির মূল উৎস প্রথম বিষয়ের মধ্যে নিহিত। আমরা দেখেছি যে, পারিভাষিক ‘জিহাদ’ কখনোই ইসলাম প্রতিষ্ঠা, ইসলামী রাষ্ট্র বা আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যম নয়। প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার মাধ্যম মাত্র। কিন্তু জিহাদ শব্দের অতি-ব্যবহারে ফলে অনেকের মনেই বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে, জিহাদই দ্বীন প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করা সকলের জন্য ফরয। জঙ্গিদের প্রচারকর্ম এতে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। তারা কিছু সরলপ্রাণ আবেগী যুবককে সহজেই একথা বুঝাতে পারছে যে, জিহাদই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বপ্রথম ফরয, জিহাদ ছাড়া ইসলাম কায়েম হবে না। আর জিহাদ মানেই তো অস্ত্রের যুদ্ধ ও শত্র“কে হত্যা করা, কাজেই এখনই আমাদের সেই কাজে নেমে পড়তে হবে। এভাবেই একটি বিভ্রান্তি আরেকটি ভয়ঙ্করতর বিভ্রান্তির পথ উন্মুক্ত করছে।
(৬) ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী আইন
ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ রাষ্ট্র ব্যবস্থা। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বকে নিয়ে ইসলাম একটি সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা। তবে এক্ষেত্রে কিছু বিভ্রান্তিকর ধারণা জঙ্গিবাদের জন্য ইতিবাচক ক্ষেত্র তৈরি করে। তন্মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অতি-গুরুত্ব আরোপ এবং ইসলামী রাষ্ট্র ও আইন সম্পর্কে পিউরিটান ও নেতিবাচক ধারণা। অর্থাৎ মনে করা যে, বর্তমান বিশ্বের মুসলিম দেশগুলি সবই অনৈসলামিক রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইসলাম পালন হলোই না। এই ধারণার ভিত্তিতেই জঙ্গিরা ইসলাম প্রেমিক যুবকদেরকে দ্রুত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অস্ত্র তুলে নিতে প্ররোচিত করতে পারছে।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে আমরা দুই প্রকারের সভ্যতা দেখতে পাই: রাষ্ট্র কেন্দ্রিক সভ্যতা ও ধর্ম কেন্দ্রিক সভ্যতা। রাষ্ট্র কেন্দ্রিক সভ্যতার পতন ঘটে রাষ্ট্রের পতনের সাথে। পক্ষান্তরে ধর্ম কেন্দ্রিক সভ্যতার সাথে রাষ্ট্র অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকলেও রাষ্ট্রই সভ্যতার মূল চালিকা শক্তি হয় না। মূলত বিশ্বাস, কর্ম ও আদর্শের উপর এর ভিত্তি থাকে। ফলে রাষ্ট্রের পতনে এই সভ্যতার পতন ঘটে না। ইসলাম দ্বিতীয় প্রকারের সভ্যতার সৃষ্টি করেছে।
অনেক সময় আবেগী মুসলিম মনে করে বসেন যে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই ইসলাম; অথবা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইসলাম পালন হলো না। মুসলিম সমাজগুলিতে ‘আধুনিক শিক্ষিত মুফতী’ বা ‘অর্ধ-আলিম ধর্মগুরু’-দের উত্থানের ফলে এরূপ আবেগী কথা ভাল বাজার পেয়ে গিয়েছে। বস্তুত এই চিন্তা একেবারেই বাতুল। মুমিনের দায়িত্ব আরকানে ইসলাম সহ ইসলামের অন্য সকল দায়িত্ব নিজের জীবনে পালন করা। এরপর সাধ্যানুসারে সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামী বিধিবিধান প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা বা দাওয়াত দেওয়া। প্রথম পর্যায়ের কর্ম তার উপর ব্যক্তিগত ফরয বা ফরয আইন ও তার ফলাফলের জন্য সে দায়ী। দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্ম মূলত সমাজের উপর সামষ্টিক ফরয বা ফরয কিফাইয়া এবং এর ফলাফল লাভের জন্য কোনো মুসলিমই ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নন।
রাষ্ট্র ব্যবস্থাসহ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছাড়া সকল দেশের সকল সমাজের মানুষদের জন্য পালনীয় প্রশস্ততা রয়েছে ইসলামে। মুসলিম-অমুসলিম সকল দেশ ও সমাজে বসবাস করে একজন মুসলিম তার ধর্ম পালন করতে পারেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে তার ধর্ম পালনের জন্য শর্ত বা মূল স্তম্ভ বলে গণ্য করা হয় নি। রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইসলামের একটি অংশ। ইসলামে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান আছে। তবে ইসলাম শুধু রাষ্ট্র ব্যবস্থার নাম নয়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যে কোনো ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যবস্থা লঙ্ঘিত হলে মুসলিম দাওয়াত, সৎকাজের আদেশ, অন্যায় থেকে নিষেধ ইত্যাদি ইসলাম নির্দেশিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা সংশোধন করতে সচেষ্ট হতে পারেন। তবে এই চেষ্টা সফল না হলে তার দ্বীন-পালন ব্যহত হয় বা তার কোনো পাপ হয় বলে মনে করার কোনো ভিত্তি নেই।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক ধারণা হলো মুসলিম দেশগুলিকে ‘অনৈসলামিক রাষ্ট্র’ বলে মনে করা। মুসলিমের ব্যক্তি জীবনে ইসলাম পালনের ক্ষেত্রে যেমন ভুলত্র“টি, পাপ ও ইসলামী বিধান লঙ্ঘন হতে পারে তেমনি রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিচালনায়ও ইসলামী বিধিবিধানের লঙ্ঘন ঘটতে পারে।

মুলঃ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
পি-এইচ. ডি. (রিয়াদ), এম. এ. (রিয়াদ), এম.এম. (ঢাকা)
অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×