ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ: আলোচিত ও অনালোচিত কারণসমূহ পর্ব -১৬ (শেষ পর্ব)
গত অর্ধ-শতাব্দী যাবৎ বিভিন্ন মুসলিম দেশে, বিশেষত মিসর, সুদান ও মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে কিছু আবেগপ্রবণ ‘অর্ধ-আলিম’ ধর্মগুরু -প্রাচীন খারিজীদের মতই- পাপে লিপ্ত হওয়া বা ইসলামের বিধান লঙ্ঘন করাকে ‘কুফরী’ বা ধর্মদ্রোহিতা ও ধর্মত্যাগ বলে মত প্রকাশ করতে থাকেন। বিশেষত তারা দাবি করতে থাকেন যে, আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রগুলির জালিম শাসকগণ যেহেতু ‘ইসলামী’ আইনে বিচার করেন না, বা ইসলাম বিরোধী আইনে বিচার করেন, সেহেতু তারা সকলেই কাফির ও ধর্মত্যাগী মুরতাদ। এরপর তারা বলতে থাকেন যে, এ সকল রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকারকারী সকল নাগরিকই কাফির ও ধর্মত্যাগী মুরতাদ। এদের মধ্যে একটি সুপরিচিত দল মিসরের শুকরী আহমদ মুসতফা প্রতিষ্ঠিত ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’। এরা এক পর্যায়ে তাদের দলভুক্ত হতে আপত্তি করে এমন সকল মানুষকে কাফির-মুরতাদ হিসেবে গণ্য করে এবং এইরূপ কাফির-মুরতাদদেরকে গুপ্ত হত্যা করার জন্য দলের কর্মীদের প্রতি নির্দেশ জারি করে। বিশেষত যে সকল আলিম ও ইসলামী ব্যক্তিত্ব এদের কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের বিভ্রান্তি বুঝাতে চেষ্টা করতেন বা তাদের বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে কথা বলতেন তাদেরকে তারা গুপ্ত হত্যা করতে শুরু করে। যদিও মিসর সরকার এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়, তবুও অনেক আবেগী মুসলিমের মধ্যেই তাদের এ সকল মতামতের প্রভাব থেকে যায়। এছাড়া আরো অনেক গোষ্ঠি ও দলের মধ্যে এইরূপ চিন্তা বিভিন্নভাবে দেখতে পাওয়া যায়।
এরা খারিজীদের মত কুরআনের কিছু আয়াতের প্রমাণ পেশ করত। এছাড়া আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র, রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, আইন, বিচার ইত্যাদি বিষয়ে আধুনিক অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ, আলিম বা ধর্মীয় নেতার বক্তব্য তারা নিজেদের পক্ষে পেশ করত।
বর্তমানে জঙ্গিদের মতবাদের অন্যতম ভিত্তি এই ‘কাফির’ বলার প্রক্রিয়া। একই পদ্ধতিতে তারা ঢালাওভাবে মুসলিম সমাজের মানুষদেরকে কাফির বলে ঘোষণা দিয়ে নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের পটভূমি তৈরি করছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, নেতা বা আলিমের কিছু আবেগী কথাকে তারা নিজেদের পক্ষে পেশ করছে। আমরা অত্যন্ত বেদনার সাথে লক্ষ্য করি যে, অনেক আলিম বা ইসলামী কর্মে লিপ্ত ব্যক্তি রাজনৈতিক বিষয়াদিতে সহজেই বিভিন্ন কর্ম বা মতকে ‘কুফরী’ বলে অভিহিত করেন। তাঁরা কুফরীতে লিপ্ত মানুষদেরকে হত্যার ফাতওয়া কখনোই প্রদান করেন না। কিন্তু জাঙ্গিদের হত্যাকাণ্ডের জন্য তাদের বক্তব্য কার্যকর পটভূমি তৈরি করে।
(৮) ফলাফল লাভের ব্যস্ততা
দ্রুত ফলাফল লাভের আগ্রহ জঙ্গিবাদের উত্থানের আরেকটি কারণ। “‘ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে বা ইসলামের বিজয় আনতে হবে। অমুক বা তমুক পদ্ধতিতে তা আসবে না, বরং আমাদের এই পদ্ধতিতেই এ বিজয় দ্রুত হাতের মুঠোয় এসে যাবে।” “অমুক পদ্ধতিতে শত বৎসর বা হাজার বৎসর কাজ করলেও ইসলামের বিজয় আসবে না, কিন্তু আমাদের পদ্ধতিতে কাজ করলে অল্প সময়েই তা এসে যাবে।” এইরূপ প্রচারণা জঙ্গিদের কর্মী সংগ্রহের একটি বড় মাধ্যম।
জঙ্গিদের এই প্রচারণার জন্য একটি ভাল ক্ষেত্র ইতোমধ্যেই মুসলিম সমাজগুলিতে তৈরি হয়ে রয়েছে। সমাজে ইসলামী দাওআত, প্রচার, দ্বীন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির জন্য বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠি কর্মরত রয়েছেন। ইসলামী শিক্ষাকে অনুধাবন করা, গুরুত্ব নির্ণয় করা এবং প্রচারের পদ্ধতির ক্ষেত্রে এ সকল দলের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে এবং থাকাই স্বাভাবিক। তবে সবারই লক্ষ্য নিজ নিজ ‘বুঝ’ অনুসারে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ও পরিপূর্ণ ইসলামী জীবনব্যবস্থার প্রতি মানুষদের আহ্বান করা। কে কত পূর্ণাঙ্গরূপে ইসলামকে উপস্থাপন করতে পারছেন সেটিই এখানে মূল বিবেচ্য হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু অনেক সময় আবেগী ইসলাম প্রচারক এক্ষেত্রে ‘কত তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যাবে’ তা বিচার করতে শুরু করেন। তিনি বলতে থাকেন, ‘অমুক পদ্ধতি ভাল নয়, কারণ ঐ পদ্ধতিতে কর্ম করে শত বৎসরে বা হাজার বৎসরেও ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।’ মনে হয় কে কত তাড়াতাড়ি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারল এর উপরেই আল্লাহ নবী-রাসূল ও মুসলমানদের হিসাব নিবেন।
ফলাফল লাভের জন্য ব্যস্ততা বা ফলাফলের ভিত্তিতে কর্মের সফলতা বিচার ইসলামী দা‘ওয়াতের ক্ষেত্রে অন্যতম বিভ্রান্তি। এই ব্যস্ততার ফলে দুই প্রকারের বিভ্রান্তির জন্ম নেয়।
প্রথম বিভ্রান্তি: ফলাফলের দ্রুতার ভিত্তিতে কর্মের বিচার অথবা ফলাফল না পাওয়ার কারণে কর্মকে ব্যর্থ মনে করা।
অনেক সময় আবেগী মুমিনের মনে ফলাফল লাভের উন্মাদনা তাকে বিপথগামী করে ফেলে। মুমিন চায় যে, সমাজ থেকে ইসলাম বিরোধী ও মানবতা বিরোধী সকল অন্যায় ও পাপ দূরীভুত হোক। কোনো মুমিনের মনে হতে পারে যে, এত ওয়ায, বক্তৃতা, বইপত্র, আদেশ নিষেধ ইত্যাদিতে কিছুই হলো না, কাজেই তাড়াতাড়ি কিভাবে সব অন্যায় দূর করা যায় তার চিন্তা করতে হবে। এই চিন্তা ভয়ঙ্কর ও ইসলামী শিক্ষার বিরোধী। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন,
يا أيها الذين آمنوا عليكم أنفسكم لا يضركم من ضل إذا اهتديتم
“হে মুমিনগণ, তোমাদের উপরে শুধু তোমাদের নিজেদেরই দায়িত্ব। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তাহলে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।”
তাহলে মুমিনের দায়িত্ব হলো নিজের সৎ থাকা ও অন্যদেরকে সৎপথে আহ্বান করা। আমাদের আহ্বান বা আদেশ-নিষেধ সত্ত্বেও যদি কেউ বা সকলেই বিপথগামী হয় তবে সেজন্য মুমিনের কোনো পাপ হবে না বা কোনো মুমিনকে সেজন্য আল্লাহর দরবারে দায়ী হতে হবে না। অনেক নবী শতশত বছর দাওয়াত ও আদেশ-নিষেধ করেছেন, কিন্তু অল্প কয়েকজন ছাড়া কেউ সুপথপ্রাপ্ত হয় নি। এতে তাঁদের মর্যাদার কোনো কমতি হবে না বা তাঁদের দায়িত্ব পালনে কোনো কমতি হয়নি। কাজেই মুমিন কখনোই ফলাফলের জন্য ব্যস্ত হবেন না।
মুলঃ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
পি-এইচ. ডি. (রিয়াদ), এম. এ. (রিয়াদ), এম.এম. (ঢাকা)
অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া