আলম সাহেব এমন বিব্রত কখনো হননি । মুখ তুলে তাকাতে পারছেন না পর্যন্ত । ঘন্টা দুই নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড়টা লেগে গেছে একদম। ঘাড়টা এপাশ-ওপাশ করতে পারলে ভাল লাগতো কিন্তু পারছেন না। মনে হচ্ছে একশো জোড়া চোখ তার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। চোখের আঘাতগুলো স্পষ্ট বুঝতে পারছেন তিনি। জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে বের হয়ে যেতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু মৃত্যুভয় আছে এতে । আত্মহত্যা মহাপাপ।
গত বছরই ঢাকা এসেছিলেন তিনি। বাসে করে। সামনে থেকে ডান পাশের তিন নাম্বার সিটে বসেছিলেন তিনি। সিট যে আগে থেকেই খালি ছিল এমনটা নয়। উপর দিকে চুলওয়ালা এক জোয়ান ছেলে নিজে উঠে গিয়ে তাকে বসতে দিয়েছিল।বেশ লেগেছিল তার। ঢাকায় মেয়ের বাসায় পৌছে এশার নামাজের পর সেই ছেলের জন্য দোয়া করেছিলেন বেশ করে।
আজ দাড়িয়ে আছেন পুরো দু’ঘন্টা । হেলপার ধমকের সুরে বলেছিলেন, ‘পেছনে যান’। অালম সাহেব তর্ক করতে জানেন না। কথামত,পেছনে চলে গিয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে। পেছনে যাওয়ার সময় দাড়িয়ে থাকা অন্য মানুষগুলো এমন ভাবে দু’দিকে সরে গিয়েছিলো , যেন তার গায়ে আলকাতরা লাগানো। আলম সাহেব নিজের গায়ের দিকে একবার তাকালেন। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবীটা তো ঠিকই আছে !
যদিও কারও গায়ে লেগে কালো ব্যাগভর্তি আমগুলোর কোন ক্ষতি হয়নি। তবুও কেমন যেন লাগলো তার। এর চেয়ে বরং আমগুলো একটু গলে যেতে পারতো।
দাড়ি পাকার আগে যতটা সম্মান পেতেন দাড়ি পাকার পর সম্মানটা বেড়ে গিয়েছিল তার। সজনে বিক্রেতা থেকে স্বর্ণকার, সবাই তাকে খাতির করতো। এখনো করে। তবে কেন যেন আগের সাথে মেলে না। নামাজ শেষে বাচ্চাগুলোকে যখন কুরআন শিক্ষা দিতে বসতেন, বাচ্চাগুলো দাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতো। তাদেরকে পড়ায় মনোযোগ দিতে বলে নিজের দাড়িতে হাত বুলাতেন তিনি। পড়া শেষে মোনাজাত ধরতেন,“ আল্লাহ, ছেলেমেয়েগুলোকে মানুষের মত মানুষ করো। মোনাজাত শেষে মসজিদ থেকে বের হতে হতে বলতেন, ‘ কখনো কারও ক্ষতি করবা না এমনকি গাছের পাতাকেও কষ্ট দিবা না’। বাচ্চাগুলো ’আচ্ছা হুজুর’ বলে চলে যেত। তাদেরকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আলম সাহেব মসজিদের ভেতর চলে যেতেন। মসজিদে ‘কারেন্টের ফ্যান’ না থাকা স্বত্ত্বেও তার কেমন যেন শীতল লাগে।
বাসে উঠার পর এগুলোই ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে। জীবনে কাউকে কষ্ট দিয়েছেন বলে মনে করতে পারছেন না। মেসওয়াকের ডাল কাটার সময় গাছের কাছে অনুমতি পর্যন্ত নিয়েছেন।
চোখ ভিজে গেছে আগেই।দাড়িতেও লেগেছে দু ‘এক ফোটা । সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বাড়ি ফেরার পর,কখনোই আর বাসে উঠবেন না তিনি।এমনকি মসজিদ থেকে একটু দুরের দোকানটাতেও যাবেন না। মসজিদের ভেতরেই তার মন শীতল থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৬ বিকাল ৪:২৮