ভীরু, অক্ষম অসহায় মানুষের, হীনমন্যতাবোধসম্পন্ন মানুষের একটা অসুবিধাজনক দিক এই যে এই বিরুদ্ধ-পৃথিবী থেকে তারা কেবলই পালাতে চায়। পৃথিবীর কোন সুদূর নিরাপদ কোণে নিজের একাকী অস্তিত্ব নিয়ে কোনমতে টিকে থাকতে চায়। আপয়াতভাবে সবকিছুকে সে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার ভান করে, কিন্তু সেসব করে ঐ হীনমন্যতার কারণে। এই দুর্ধর্ষ পৃথিবীটাকে তার বড় ভয় হয়। পৃথিবীড় সবকিছুর কাছে কেবলই পরাজিত হয়ে চলে বলে তার সংকীর্ণ ছোট প্রকোষ্ঠের বাইরের সব জিনিশকেই সে আশংকা আর সন্দেহের চোখে দেখে। প্রতিটি জিনিশকেই নিজের অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর মনে করতে থাকে। এইজন্য তার পুরো চাউনিটিই হয়ে পড়ে নেতিবাচক। কোন জ্বলজ্বলে বা অসাধারন জিনিষ দেখলেই সে বেশি করে ভীত হয়ে পড়ে। মওকা বুঝে তাকে ধ্বংশ করে দিতে চেষ্টা করে। এটাও করে সে কিছুটা ভীরুর মত, নিজেকে যতটা পারে নিরাপদে রেখে। এই ভীরু, নির্বীজ মেরুমজ্জাহীন মানুষগুলো-যে ঠিক কেমন তার ছবি রেখে গেছেন ম্যাক্সিম গোর্কি তাঁর ‘বুড়ি ইজেরগিল’ গল্পের শেষ পর্বে। উজ্জ্বল অনিন্দ্যসুন্দর সে-গল্প সংক্ষেপে এরকমঃ
অনেক অনেক আগে স্তেপে একজাতের লোক বাস করত। তাদের তিনধারে ছিল জঙ্গল আর একধারে স্তেপ। তারা যেমন ছিল স্ফূর্তিবাজ, তেমন ছিল তাদের গায়ের জোড় ও সাহস। একদিন তাদের বরাতে দুঃখ নেমে এল। কোথা থেকে এক অন্য জাত এসে জঙ্গলে তাড়িয়ে দিল তাদের। সে জঙ্গল যেমন অন্ধকার তেমন ভ্যাপসা। গাছগুলো অনেক পুরোনো, ডালপালাগুলো জড়াজড়ি করে আকাশকে পুরোপুরি রুখে দিয়েছে। সে জঙ্গলে জীবন বাঁচানো অসম্ভব। ওরা সামনে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু ওদের এগোবার সঙ্গে সঙ্গে সে জঙ্গল আরো অন্ধকার আর বিপদসংকুল হয়ে ওঠে। সবাই মৃত্যুর আশংকায় উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ল। মেয়ে ও শিশুরা করুন কান্নায় বিলাপ জুড়ল। কে আজ এগিয়ে আসবে তাদের উদ্ধার করতে? কে দেখাবে এই গহীন ভয়ংকর দুর্ভেদ্য অরণ্য থেকে নিস্ক্রমনের পথ।
শেষপর্যন্ত সত্যি সত্যি একজন উঠে দাঁড়ালো তাদের মধ্য থেকে, যেমন উঠে দাঁড়ায় সবযুগে সবখানে। সে সাহসী ডানকো। তাদেরই একজন। জোয়ান বয়স, সুন্দর চেহারা। সবাইকে ডেকে সে বললঃ ওঠো, জঙ্গল কেটে আমরা সবাই রাস্তা করে বেরিয়ে যাব। এ জঙ্গলের শেষ নিশ্চয়ই আছে। পৃথিবীর কোনকিছুর শেষ না-থেকে পারেনা।
ডানকোর আহবানে বন কেটে এগিয়ে চলল তারা। প্রচন্ড তখন তাদের জীবন-উদ্দীপনা আর আত্নবিশ্বাসের উল্লাস।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, বন আরো ঘন আর বিপদশংকুল হয়ে উঠতে লাগলো। গাছগুলো নিরেট দেয়ালের মত আরো গভীর হয়ে পথ আগলে দাড়ালো। একসময় এমন অন্ধকার ঘিরে এল যে মনে হল জঙ্গলের আদিকাল থেকে সবগুলো আঁধার রাত একখানে এসে জড়ো হয়েছে। সেই ভয়ংকর পরিবেশের মধ্যে বেঁচে থাকার আর কোন আশাই রইলনা। ব্যর্থতায় হতাশায় তাদের ক্রোধ গিয়ে পড়ল ডানকোর ওপর। তারা চিৎকার করে বললঃ ‘হতভাগা, আমাদের যত দুঃখের জন্য তুই দায়ী। তুই শেষ করেছিস আমাদের। এর জন্য তোকে মরতে হবে। হয় এই অন্ধকারে আমাদের পথ দেখা , নয় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হ।’
‘তুই মরবি, তোকে মরতে হবে।’ সবাই গর্জন করে উঠল সমস্বরে।
সবার জন্য ভালোবাসায় প্রেমে ডানকোর সমস্ত অস্তিত্ব তখন দাউদাউ করে জ্বলছে।
চিৎকার করে উঠল ডানকোঃ ‘কী করতে পারি আমি এই মানুষদের জন্য। এই অন্ধকারে কোথা থেকে পাব পথ দেখার আলো!’ বলেই হঠাৎ একটা আশ্চর্য কান্ড করল সে। দুহাত দিয়ে নিজের বুকটা একটা ছিড়ে ফেলে দিল আর হৃদয়টাকে বের করে তুলে ধরল মাথার ওপর।
সূর্যের মত জ্বলতে থাকল হৃদয়টা, সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল। সারাটা জঙ্গল স্তব্ধ হয়ে গেল মানুষের প্রেমের সেই মহান আলোয়। মানুষগুলো বিমূঢ় হয়ে পড়ল
‘চলো, এগিয়ে চলো’ চিৎকার করে উঠল ডানকো।
ঢেউয়ের মত সবাই পিছু নিল ডানকোর। ডানকো চলছে সবার আগে, আর তার হৃদয়টা অবিরিত জ্বলছে।
একসময় বন পার হয়ে খোলা জায়গায় গিয়ে পৌছল সবাই। সবাই খুশিতে, উত্তেজনায়, আনন্দে মত্ত হয়ে উঠল। কিন্তু ডানকোর দু-ভাগ হয়ে যাওয়া বুকের লাল রক্তের ধারা তখন দুর্বার হয়ে উঠেছে।
সাহসী ডানকো জঙ্গল-পেরোনো খোলা জায়গার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল, সে-হাসি ভালোবাসার গর্বে ভরা। তারপর চিরতরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
আশায় আনন্দে ভরপুর মানুষেরা তাকিয়ে দেখল না যে ডানকো মরে পড়ে আছে। তার সাহসী হৃদয়টা দেহের পাশে তখনো জ্বলছে। শুধু একজন ভীরু লোক তা দেখতে গেল। কিসের জন্য যেন ভয় পেয়ে মাড়িয়ে দিল সেই গর্বে ভরা হৃদয়টা। ......খানখান হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল সে হৃদয়ের শিখা, তারপর নিভে গেল।
প্রিয় মানুষ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের “সংগঠন ও বাঙালি” গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত “বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতার আরো কারণঃ ব্যক্তিগত অসহায়তা, অক্ষমতা, হীনমন্যতা ও আত্নঘাত” শীর্ষক প্রবন্ধের অনুচ্ছেদ ১৫ থেকে তুলে ধরা।