somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'বুড়ি ইজেরগিল' গল্পের শেষ পর্ব

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১০:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভীরু, অক্ষম অসহায় মানুষের, হীনমন্যতাবোধসম্পন্ন মানুষের একটা অসুবিধাজনক দিক এই যে এই বিরুদ্ধ-পৃথিবী থেকে তারা কেবলই পালাতে চায়। পৃথিবীর কোন সুদূর নিরাপদ কোণে নিজের একাকী অস্তিত্ব নিয়ে কোনমতে টিকে থাকতে চায়। আপয়াতভাবে সবকিছুকে সে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার ভান করে, কিন্তু সেসব করে ঐ হীনমন্যতার কারণে। এই দুর্ধর্ষ পৃথিবীটাকে তার বড় ভয় হয়। পৃথিবীড় সবকিছুর কাছে কেবলই পরাজিত হয়ে চলে বলে তার সংকীর্ণ ছোট প্রকোষ্ঠের বাইরের সব জিনিশকেই সে আশংকা আর সন্দেহের চোখে দেখে। প্রতিটি জিনিশকেই নিজের অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর মনে করতে থাকে। এইজন্য তার পুরো চাউনিটিই হয়ে পড়ে নেতিবাচক। কোন জ্বলজ্বলে বা অসাধারন জিনিষ দেখলেই সে বেশি করে ভীত হয়ে পড়ে। মওকা বুঝে তাকে ধ্বংশ করে দিতে চেষ্টা করে। এটাও করে সে কিছুটা ভীরুর মত, নিজেকে যতটা পারে নিরাপদে রেখে। এই ভীরু, নির্বীজ মেরুমজ্জাহীন মানুষগুলো-যে ঠিক কেমন তার ছবি রেখে গেছেন ম্যাক্সিম গোর্কি তাঁর ‘বুড়ি ইজেরগিল’ গল্পের শেষ পর্বে। উজ্জ্বল অনিন্দ্যসুন্দর সে-গল্প সংক্ষেপে এরকমঃ


অনেক অনেক আগে স্তেপে একজাতের লোক বাস করত। তাদের তিনধারে ছিল জঙ্গল আর একধারে স্তেপ। তারা যেমন ছিল স্ফূর্তিবাজ, তেমন ছিল তাদের গায়ের জোড় ও সাহস। একদিন তাদের বরাতে দুঃখ নেমে এল। কোথা থেকে এক অন্য জাত এসে জঙ্গলে তাড়িয়ে দিল তাদের। সে জঙ্গল যেমন অন্ধকার তেমন ভ্যাপসা। গাছগুলো অনেক পুরোনো, ডালপালাগুলো জড়াজড়ি করে আকাশকে পুরোপুরি রুখে দিয়েছে। সে জঙ্গলে জীবন বাঁচানো অসম্ভব। ওরা সামনে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু ওদের এগোবার সঙ্গে সঙ্গে সে জঙ্গল আরো অন্ধকার আর বিপদসংকুল হয়ে ওঠে। সবাই মৃত্যুর আশংকায় উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ল। মেয়ে ও শিশুরা করুন কান্নায় বিলাপ জুড়ল। কে আজ এগিয়ে আসবে তাদের উদ্ধার করতে? কে দেখাবে এই গহীন ভয়ংকর দুর্ভেদ্য অরণ্য থেকে নিস্ক্রমনের পথ।

শেষপর্যন্ত সত্যি সত্যি একজন উঠে দাঁড়ালো তাদের মধ্য থেকে, যেমন উঠে দাঁড়ায় সবযুগে সবখানে। সে সাহসী ডানকো। তাদেরই একজন। জোয়ান বয়স, সুন্দর চেহারা। সবাইকে ডেকে সে বললঃ ওঠো, জঙ্গল কেটে আমরা সবাই রাস্তা করে বেরিয়ে যাব। এ জঙ্গলের শেষ নিশ্চয়ই আছে। পৃথিবীর কোনকিছুর শেষ না-থেকে পারেনা।

ডানকোর আহবানে বন কেটে এগিয়ে চলল তারা। প্রচন্ড তখন তাদের জীবন-উদ্দীপনা আর আত্নবিশ্বাসের উল্লাস।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, বন আরো ঘন আর বিপদশংকুল হয়ে উঠতে লাগলো। গাছগুলো নিরেট দেয়ালের মত আরো গভীর হয়ে পথ আগলে দাড়ালো। একসময় এমন অন্ধকার ঘিরে এল যে মনে হল জঙ্গলের আদিকাল থেকে সবগুলো আঁধার রাত একখানে এসে জড়ো হয়েছে। সেই ভয়ংকর পরিবেশের মধ্যে বেঁচে থাকার আর কোন আশাই রইলনা। ব্যর্থতায় হতাশায় তাদের ক্রোধ গিয়ে পড়ল ডানকোর ওপর। তারা চিৎকার করে বললঃ ‘হতভাগা, আমাদের যত দুঃখের জন্য তুই দায়ী। তুই শেষ করেছিস আমাদের। এর জন্য তোকে মরতে হবে। হয় এই অন্ধকারে আমাদের পথ দেখা , নয় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হ।’

‘তুই মরবি, তোকে মরতে হবে।’ সবাই গর্জন করে উঠল সমস্বরে।
সবার জন্য ভালোবাসায় প্রেমে ডানকোর সমস্ত অস্তিত্ব তখন দাউদাউ করে জ্বলছে।
চিৎকার করে উঠল ডানকোঃ ‘কী করতে পারি আমি এই মানুষদের জন্য। এই অন্ধকারে কোথা থেকে পাব পথ দেখার আলো!’ বলেই হঠাৎ একটা আশ্চর্য কান্ড করল সে। দুহাত দিয়ে নিজের বুকটা একটা ছিড়ে ফেলে দিল আর হৃদয়টাকে বের করে তুলে ধরল মাথার ওপর।

সূর্যের মত জ্বলতে থাকল হৃদয়টা, সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল। সারাটা জঙ্গল স্তব্ধ হয়ে গেল মানুষের প্রেমের সেই মহান আলোয়। মানুষগুলো বিমূঢ় হয়ে পড়ল
‘চলো, এগিয়ে চলো’ চিৎকার করে উঠল ডানকো।

ঢেউয়ের মত সবাই পিছু নিল ডানকোর। ডানকো চলছে সবার আগে, আর তার হৃদয়টা অবিরিত জ্বলছে।
একসময় বন পার হয়ে খোলা জায়গায় গিয়ে পৌছল সবাই। সবাই খুশিতে, উত্তেজনায়, আনন্দে মত্ত হয়ে উঠল। কিন্তু ডানকোর দু-ভাগ হয়ে যাওয়া বুকের লাল রক্তের ধারা তখন দুর্বার হয়ে উঠেছে।

সাহসী ডানকো জঙ্গল-পেরোনো খোলা জায়গার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল, সে-হাসি ভালোবাসার গর্বে ভরা। তারপর চিরতরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
আশায় আনন্দে ভরপুর মানুষেরা তাকিয়ে দেখল না যে ডানকো মরে পড়ে আছে। তার সাহসী হৃদয়টা দেহের পাশে তখনো জ্বলছে। শুধু একজন ভীরু লোক তা দেখতে গেল। কিসের জন্য যেন ভয় পেয়ে মাড়িয়ে দিল সেই গর্বে ভরা হৃদয়টা। ......খানখান হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল সে হৃদয়ের শিখা, তারপর নিভে গেল।


প্রিয় মানুষ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের “সংগঠন ও বাঙালি” গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত “বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতার আরো কারণঃ ব্যক্তিগত অসহায়তা, অক্ষমতা, হীনমন্যতা ও আত্নঘাত” শীর্ষক প্রবন্ধের অনুচ্ছেদ ১৫ থেকে তুলে ধরা।
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×