সেদিন পাক্কা আড়াই বছর পরে চট্টগ্রাম শহরে গিয়েছিলাম। নরওয়ে থেকে এসে সোজা রাউজানের গ্রামের বাড়িতে আছি আপাতত কয়েক মাস ধরে। কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে দেখা করতে শুক্রবার শহরে গেলাম। বাংলাদেশে কিছুই বদলায়নি। আরো খারাপের দিকে গিয়েছে।
গ্রামের বাড়ি থেকে বের হয়ে শহরের গাড়ি যেখান থেকে ধরতে হয়, সেখানে রাস্তার উপর গাড়ির পার্কিং। রাস্তায় গাড়িগুলোর ওভারটেকিং প্রতিযোগিতা। বিটিভিতে ভিক্ষুক না থাকার বিজ্ঞাপনমূলক নাটিকা দেখানো হলেও রাস্তায় পাবলিকের ভিড়ের ভিতরেই হঠাত করে গায়ে হাত দিয়ে ভিক্ষা চাওয়া শুরু করে আবর্জনায় মাখামাখি ভিক্ষুকগুলো। ১০ কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে চলা মিছিলের কারণে আধা ঘন্টার পথ পাড়ি দিতে ১ ঘন্টা। অক্সিজেন মোড়ে রাস্তা দখল করে ক্ষমতাসীন দলের বিশাল শোডাউন-মিছিল। ফুটপাত নেই; থাকলেও দখল বা ভাঙ্গাচোরা বা ডাস্টবিনে পরিণত। নালা-নর্দমা বদ্ধ, আবর্জনায় ভরা, মশার কারখানা।
মুরাদপুরের এক রেস্টুরেন্টে চা খাওয়া, সুগন্ধা আবাসিকের এক বন্ধুর বাসায় যাওয়া, এরপর অন্য দুই বন্ধুর সাথে কাতালগঞ্জের কোচিং পাড়ায় যাওয়া। বন্ধুর ভাগ্নের অনলাইন পরীক্ষার খাতার মার্কিং এর জন্য যাওয়া। সেখান থেকে সোজা লিটল এশিয়া রেস্টুরেন্ট। বিলাসবহুল অন্দরমহল ছাড়া গোটা শহর/দেশটাই জঞ্জালে ভরা; মানুষ এতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে, এসবই এনজয় করে। কিন্তু সবচেয়ে সার্কাস্টিক এবং স্যাডিস্ট লেগেছিল লিটল এশিয়ায় বুফে খেয়ে চলে আসার ঠিক আগ মুহুর্তে দেওয়ালের বিশাল টিভি স্ক্রিনে নরওয়ে ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর অসাধারণ সুন্দর দৃশ্যগুলো ভেসে উঠা। মানুষ যথারীতি মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। আমার দুই ডাক্তার বন্ধু হয়তোবা কিছুটা তামাশা করেই বলছিল- এসব মনে হয় সিজিআই, কম্পিউটার গ্রাফিকস। পানি এত নীল ও পরিস্কার কিভাবে হয়?
আমরা বাংলাদেশীরা কিভাবে বুঝবো, দূষিত বায়ু-পানি-মাটি আর শব্দদূষণ কিভাবে আমাদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতি করছে। বুঝলে তো আমরা নিজেরাও পদক্ষেপ নিতাম; আর যারা ফেসবুকে নেই, এসব আলোচনা করছে না- তাদেরকেও উঠতেবসতে এসব নিয়ে বলতাম।
কিন্তু এসব নিয়ে যারা বলে, তারা রিয়েল লাইফে নানাভাবে অপমানিত ও অপদস্ত হয়।
লিটল এশিয়া থেকে বের হয়ে এক ডাক্তার বন্ধু তার স্ত্রীর সাথে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৬ষ্ঠ তলায় দেখা করতে গিয়েছিল; সাথে আমরাও গিয়েছিলাম। চমেক থেকে বের হয়ে আসার সময় আমার সেই বন্ধুকে শুধু একটা কথাই বলেছিলাম- "বাংলাদেশে যদি থাকতে হয়, তবে অন্তত এমন স্বচ্ছল হতে হবে, যাতে রোগের চিকিৎসা ও অন্য কোন কারণে সরকারি হাসপাতালে আসতে না হয়।"
বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আগে মুরাদপুরের এন-মোহাম্মদ কনভেনশন সেন্টারের বারকোড ক্যাফেতে গিয়েছিলাম। মালাই চা আর মিন্ট লেমন খেতে। মুরাদপুরের রাস্তার দুই পাশের আইকনিক খোলা বিশাল নর্দমাগুলো খোলাই আছে; ফুটপাতের পাশে। আর আগের মতই সলিড আবর্জনা ফেলার জন্য ভালনারেবল আছে। বারকোড ক্যাফের পার্কিং, কম্পাউন্ড, ভেতরে সবখানে মানুষের গাদাগাদি। মানুষের বিনোদন, সামাজিকতা আর দেখাসাক্ষাতের উপযুক্ত জায়গা খুবই কম আছে শহরে। বিশেষত নারী-শিশুসহ পারিবারিক কমার্শিয়াল বিনোদনের জন্য। এই ব্যবসার আয়োজক ও উদ্যোক্তারা তাদের মত যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছে জায়গাটা সুশৃঙ্খল, আরামদায়ক ও পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য। কিন্তু মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা ও বুঝ দেওয়া খুবই কঠিন। মানুষ নিজেই মানতে চায় না। এটাই বুঝা গেল কনভেনশন সেন্টারের ভিতরে গিয়ে। যে যার ইচ্ছা মত টেবিলে, মাটিতে যা খুশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে গিয়েছে।
আমার হাতের মিন্ট লেমনটা তখনো শেষ হয়নি। কিন্তু বাড়ির বাস এখন না ধরলে দেরি হয়ে যাবে। সাড়ে দশটার দিকে মুরাদপুর থেকে রাউজানগামী বাসে বসলাম। হাতে মিন্ট লেমনের প্লাস্টিক কাপ ও স্ট্র। বাস যখন বাড়ির মোড়ের রাস্তায় পৌছল, তখন রাস্তাঘাট সুনসান। সবকিছু বন্ধ। কয়েক সেকেন্ড ধরে খুঁজার পরে একটা দোকানের সামনে একটা ময়লার বালতি পেলাম। প্রায় ভর্তি সেটা। মিন্ট লেমনের কাপটা ফেললাম।
নিচের ছবিগুলো পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের গতকালের ছবি।
গতকাল আমাদের বাসার পেছনের উঠানে বাগান করার জন্য মাটি খুঁড়তে গিয়ে, মাটির নিচ থেকে স্কুল ব্যাগ, স্যান্ডেল, ইত্যাদি পাওয়া গিয়েছে। আমাদের জায়গায় আগে একটা কেয়ারটেকার পরিবার থাকতো; তারা তাদের পরিত্যক্ত জিনিস ও আবর্জনাগুলো এভাবে আস্ত মাটির নিচে পুঁতে ফেলে রেখে গিয়েছে। পুরো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ধারণা- প্লাস্টিক বা অজৈব বস্তুগুলো মাটির নিচে রাখলে মিশে যায়; তাই তারা হয় এসব মাটির নিচে পুঁতে ফেলে; কিংবা খোলা জায়গায় পুড়িয়ে ফেলে। আমার মতে পুড়িয়ে ফেলাটা অপেক্ষাকৃত ভালো সমাধান। কারণ, এভাবে বর্জ্য দিয়ে মাটিভরাট করলে দুটো ভয়াবহ ব্যাপার হয়-
১) Stuctural integrity নষ্ট হয়। ফলে বিল্ডিং বা যেকোন নির্মাণ vulnerable অবস্থায় থাকে।
২) গাছপালা শিকড় গভীরে যেতে পারে না। মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়। মাটির ভিত দুর্বল ও নড়বড়ে হয়।
এগুলা আমরা শিক্ষিত বা সচ্ছল মানুষরা কমবেশি জানি/বুঝি। তাও মানি না। আর অশিক্ষিত/দরিদ্ররা জানে না/বুঝে না। ওদেরকে আমরা জানাই না। কিন্তু ওরাই জনসংখ্যার বড় অংশ। ওরাই কায়িক পরিশ্রমগুলা বেশি করে। ফলে ওদের দ্বারাই পরিবেশ দূষণ হয় বেশি।
আর বাংলাদেশীদের সাথে উন্নত দেশে মানুষগুলোর একটাই পার্থক্য- ওরা মাতাল/Drunk অবস্থায় ছাড়া কখনোই পরিবেশ দূষিত হবে, এরকম কোন কাজ সহজে করে না।