অবকাঠামোগত, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আদর্শগত, স্বাস্থ্যগত, শিক্ষাগত বা পেশাগত পরিবর্তন আনার চাইতে- সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন আনাটা আমাদের দেশে অনেক কষ্টসাধ্য।
মানুষের দৈনন্দিন বা অকেশনাল আচারআচরণ ও কার্যকলাপে প্রযুক্তিগত, আধুনিক, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পরিবর্তন আনতে বেশি প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। হয়তোবা এই কারণেই SDG বাস্তবায়নে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকবে এই দেশ; এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক আগত বৈশ্বিক/আঞ্চলিক দুর্যোগে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে এই অঞ্চলের বাসিন্দারা।
বাংলাদেশের মানুষের একটা বড় সময়, শ্রম, অর্থ ও শক্তি খরচ/বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে- "বিয়ে"। সম্ভবত পেশাগত, ব্যক্তিগত ও সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা, বিনোদন, সুস্বাস্থ্যচর্চা ও আত্মোন্নয়নের সুযোগের অভাবের কারণেই মানুষের জীবনে নিজের ও অন্যের বিয়ের প্রতি এই উদ্দাম আকর্ষণ কাজ করে। অধিক জনসংখ্যা ও কম আয়তনের দেশে এরকম হওয়াই অবশ্য স্বাভাবিক।
বিয়ের দাওয়াতের ধরণ ও প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণ নিয়ে আগে লিখেছি; স্বভাবতই বিন্দুমাত্র সাড়া পরেনি। আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আজ লিখবো বিয়ের উপহারের ব্যাপারে। ইসলাম ধর্মের প্রেক্ষাপট থেকে ব্যাখা করছি না- কারণ ঐ এঙ্গেল থেকে বলতে গেলে বাংলাদেশের ৯০% বিয়েই অনৈসলামিক।
বিয়েতে উপহার দেওয়াটা অবশ্যই আবশ্যিক না; কিন্তু মানুষ এটাকেও প্রতিযোগিতা বানিয়ে ফেলেছে- কে কার অনুষ্ঠানে পাল্টা কতটুকু গিফট দিতে পারে। অনেকটা প্রতিদান শোধ করার মত! অনেকে চক্ষুলজ্জার খাতিরেও কিছু একটা দিয়ে বাঁচে!
বিয়ের ইভেন্ট, ফটোগ্রাফি, মেইকাপ, ইত্যাদির মত গিফট কেন্দ্রিক জীবিকা/ব্যবসাও গড়ে উঠেছে অনেক- যাদের অনেকের মুখে শুনেছি- তাদের দোকান থেকে কেনা গিফটের জিনিসই গিফট পাওয়া লোকেরা তাদের কাছে বিক্রি করে যায় অপেক্ষাকৃত কম দামে; এটাই তাদের লাভজনক ব্যবসা! আমাদের দেশের বেশির ভাগ জীবিকাই এরকম- এক হাত ঘুরে অন্য হাত; আরেকজনের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে নিজের উদরপূর্তি।
টেবিল বসিয়ে বিয়ের দিনে গিফট নেওয়া, অথবা বিয়ের আগে বর-কনের বাসায় প্রতিজনে জনে বার বার এসে গিফট দিয়ে যাওয়া- কতটা সময়োপযোগী ও কার্যকরী- সেটা বুঝার ও বুঝানোর সাধ্য বাংলাদেশে অন্তত কারো নেই। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশের সবকিছুই "সংখ্যার অনেক বেশি"। ১০-২০ জন অতিথি হলে বাসায় বা বিয়ের ক্লাবে গিফট নেওয়া ও হ্যান্ডেল করা অপেক্ষাকৃত সহজতর; হাজার জনের মত হলে তা না! তাও আবার এই হাজার জনের সবার গিফটের ধরণ ও সাইজ এক না। হাস্যকর হলেও সত্য- বাংলাদেশের বেশির ভাগ বিয়েতে আসা অতিথিদের ৭০%-এরও বেশি মানুষের সাথে বিয়ের বর কিংবা কনের সামাজিক, পেশাগত, অর্থনৈতিক বা আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি করা বা বজায় রাখা লিটারেলি অসম্ভব। তারপরেও অধিক সংখ্যায় দাওয়াত দেওয়া ও খাওয়ানোর প্রথা চলছে- শুধুমাত্র ইগোকে স্যাটিসফাই করার জন্য।
ওয়েডিং গিফটের ভ্যারাইটির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশীদের ক্রিয়েটিভিটি খুবই পুওর। #শাড়ি, #ঘড়ি কিংবা #ডিনারসেট এর ব্যবসা করার মত প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পেয়ে যায় অনেকে- এক একটা বিয়ের প্রোগ্রামের পরে! অথচ, বর কিংবা কনের পিতা/মাতার নতুন সংসার সাজানোর অনেক খরচ কমিয়ে দিতে পারতো- যদি গিফট দেওয়াতে নতুনত্ব ও বিচক্ষণতা থাকতো। যদিও কেউই গিফট দিতেই বাধ্য করছে না- এটা সম্পূর্ণই অতিথিদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। বিয়ের অনুষ্ঠানের ধরণ বা বিশালতা যেমন সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধা নির্ভর, তেমনি উপহার দিবে কি দিবে না- সেটাও গেস্টদের ইচ্ছার উপরে। প্রত্যক্ষভাবে এসব নিয়ে নোংরামি ও জোরাজুরি করার মানুষ ভদ্র সমাজে কম হলেও, পরোক্ষভাবে এসব নিয়ে আড্ডাবাজি করা, খোঁচা দেওয়া, হাসিতামাশা করা বা সাইকোলজিক্যালি ম্যানিপুলেট করার মানুষ আমাদের চারপাশে ভরপুর।
আমার আলোচনার মূল কথায় আসি।
এই আইডিয়াটা ইন্ডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়াসহ আশেপাশের দেশের আধুনিক তরুণদের বিয়েতে দেখা যাওয়া শুরু করেছে বেশ আগে। উন্নত পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে হয়তোবা এর তেমন প্রচলন নেই- কারণ ওদের বিয়ে, বিয়ের কলেবর, বিয়েতে অতিথির সংখ্যা ও দম্পতির অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার সংজ্ঞাই অন্যরকম!
সম্প্রতি আমার ছোট বোনের বিয়েতে আমার বড় খালু ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে bKash-এ গিফটের টাকা Electronic transfer of money করলেন। খুব কম মানুষকেই এরকম করতে দেখা যায়। উনার এরকম করার দুটো কারণ হতে পারে। প্রথম কারণ- অবশ্যই "দূরত্ব"; এবং কোভিড ও অন্যান্য অসুস্থতার কারণে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ভ্রমণের অপারগতা। দ্বিতীয় কারণটা খুব ইন্টারেস্টিং- নিজের পরিবারের অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগতভাবে ভুক্তভোগী হওয়া। উনার বাসায় খুঁজলে এখনো হয়তো অনেক বছর আগের কোন বিয়ের প্রোগ্রামে পাওয়া গিফট পাওয়া যাবে অব্যবহৃত অবস্থায়; যার কোন কোনটা গিফটের প্যাকেট মোড়ানো অবস্থায় থাকলেও আশ্চর্য হবো না।
পণ্যের উপযোগিতাকে সম্পূর্ণরূপে ইউটিলাইজ না করে- কোনকিছু কেনার যেই কালচার আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে, এর ফলে শুধু যে আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে তা-ই নয়, পরিবেশগত ক্ষতিও হচ্ছে প্রচুর। বিশেষত মেয়েদের ম্যাচিং ড্রেস-ব্যাগ-স্যান্ডেল-মেইকাপের যে পিওর ম্যাটেরিয়ালিস্টিং কালচারের এক্সট্রিম রূপ আমাদের বর্তমান বিশ্বে প্রকট হচ্ছে, সেটার লুপ থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হবে একমাত্র দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মত কোন মহাপ্রলয়ের আগ মুহুর্তে। কিন্তু, অতিরিক্ত উৎপাদন ও অতিভোগের বদঅভ্যাসই আমাদের সামনে এরকম মহাবিপদ ডেকে আনতে যাচ্ছে। সেই ব্যাখায় যাবো না- অনেকে বুঝবে না; বুঝলেও মানবে না।
ইলেক্ট্রনিক মানি ট্রান্সফারের প্রসঙ্গ আসি। খুব রেয়ার কেইস ছাড়া- গিফট দেওয়া বিয়ের অতিথিদের প্রায় সবাই নিজের টাকা খরচ করেই গিফট কিনে ও গিফট দেয়। আর এই গিফটগুলো নেওয়ার সময়- লিস্ট করে হিসাব রাখতে হয়- যেটা অনেক সময় মনের অজান্তেই প্রশ্ন, বিদ্বেষ ও অসুস্থ প্রতিদ্বন্দিতার জন্ম দেয়। এরকম সমস্যা থেকে বাঁচার উপায় আছে। এছাড়া ক্লাবে গিফট পাহারা দেওয়া, গিফট দেওয়ার জন্য হোস্টদের হন্যে হয়ে খোঁজা, গিফট বহনের জন্য পরিবহন ও লোকবল নিয়োগ, গিফট খোলা-বাছাই-বন্টন, যারা বিয়ের অনুষ্ঠানে কাজ করেছে বা ঘনিষ্ঠজন- এরকম লোকেদের গিফটের জিনিস পাওয়ার বায়না, ইত্যাদি থেকে পরিত্রাণের সহজ উপায় আছে। সেটাই হলো- E - Transaction!
যে কেউ চাইলেই, উপহার কেনার জন্য বরাদ্দ টাকা, তা যত অল্পই হোক (লোকদেখানো অপসংস্কৃতি ও অসুস্থ মানসিকতা বাদ দিতে হবে আগে), বর/কনে কিংবা তাদের অভিভাবকের electronic wallet-এ (উদাহরণঃ বিকাশ) পাঠিয়ে দিতে পারে। এটি দ্রুত, নিরাপদ, জবাবদিহিতামূলক, মধ্যস্ততাকারীর ঝামেলা নেই, পরিবহনে আলাদা মনোযোগ লাগে না, কোনরকম বাহ্যিক ঝুঁকি নাই। ক্যাশ/নগদ টাকা হাতে দেওয়ার চাইতেও লক্ষগুণ ভালো। যদিও আমাদের দেশে অনেক আগে থেকে ক্যাশ টাকা গিফট দেওয়ার প্রচলন আছে, তবুও অনেকের মধ্যেই এটা নিয়েও সংকোচ ও লজ্জা কাজ করে। নিকটাত্মীয় ছাড়া কেউ কারো বিয়েতে ক্যাশ দিতে চায় না!! অথচ যে কারো ব্যক্তিগত প্রয়োজন বা সংকটে- একটা হাজার টাকার চায়ের কাপের সেটের চাইতে- একশত টাকা ইলেক্ট্রনিক মানি ট্রান্সফার অনেক কাজে লাগতে পারে।
আরো সহজভাবে বললে- The gift should essentially be #fungibile. fungibility অর্থ পণ্যের এমন বৈশিষ্ট্য- যেটা অর্থনৈতিকভাবে সহজেই বিনিময়যোগ্য। বিশ্বের সবচেয়ে বহুল প্রচলিত ফাঞ্জিবল বস্তু হচ্ছে- টাকা। ইলেক্ট্রনিক্যালি/ডিজিটালি বা ফিজিক্যালি টাকা গিফট করা ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে নববিবাহিতদের ডিস্কাউন্ট কার্ড, হোটেল একোমোডেশন কার্ড, ট্রাভেল টিকেট, ইত্যাদি ভাউচার বা গিফট কার্ড দেওয়ার প্রচলনও আছে সভ্য-আধুনিক সমাজে।
তবে যে কেউ চাইলেই- এক্সক্লুসিভ কিছু গিফট দিতে পারে, যেটার economic ভ্যালুর চাইতে emotional ভ্যালুটাই প্রধান। এটা হতে পারে- একটা ছোট্ট ফাউন্টেইন পেন, বা লেখার ডায়েরি! গিফটের জিনিসের অর্থনৈতিক মূল্যমান দিয়ে কিছুতেই সেটার মর্যাদা নির্ধারণ করা যায় না। আমার মত মানুষ- যে জীবনে তেমন কিছু কখনো গিফট পায়নি- হাড়ে হাড়ে তা বুঝি।
এই Paradigm Shift টা হওয়ার জন্য কেউ কাওকে অবশ্যই explicitly রিকোয়েস্ট করতে পারবে না। নিজেদের ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে এটা চর্চা শুরু করার মাধ্যমেই পরিবর্তন আনা সম্ভব। আর অবশ্যই খাবারের ক্ষেত্রে Redundancy কমাতে হবে, Planning বাড়াতে হবে, এবং wastage কমাতে হবে। শুধুমাত্র গ্রামীণ সংস্কৃতি রক্ষার খাতিরে- গ্রামসম্পৃক্ত বিয়েগুলোর বাসাবাড়িতে "ছাঁচ পিঠা"-র মত নাস্তাগুলির স্তুপ পরে যায়। খাওয়া ও খাওয়ানোর এই দৌরাত্ম্যের মধ্যে যে পরিমাণ খাবারের অপচয় হয়, এবং আয়োজকদের শারীরিক যেই ক্ষতি হয়, সেটা কখনোই পূরণ করা সম্ভব হয় না- বিয়ের অনুষ্ঠানের ক্ষণিকের অতিথিদের পক্ষে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০২১ রাত ৯:০৫