
চর্যাগীতির আবিষ্কার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সমগ্র উনিশ শতকে তো বটেই, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত এই অমূল্য ঐতিহাসিক উপাদানগুলি শিক্ষিত সমাজের আগোচর ছিল। ১৮৫৮ সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্র 'বিবিধার্থ' সংগ্রহ' পত্রিকায় 'বঙ্গভাষার উৎপত্তি' নামে যে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন সেখানে বাংলাকে হিন্দীর পূর্বী শাখা থেকে উৎপন্ন বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন সেখানে বিদ্যাপতির রচনাবলী ; অন্যদিকে ১৯১১ সালে প্রকাশিত দীনেশচন্দ্র সেনের The History of Bengali Language and Literature-এ বাংলা সাহিত্যের আদিপর্বে বৌদ্ধ প্রভাবের কথা উল্লিখিত হলেও তাঁর আলোচনা প্রধানত গোপীচন্দ্রের গান, ডাক- খনার বচন ইত্যাদি কতকগুলি লৌকিক উপাদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এই সব আলোচনায় অনুমানের স্থান যতটা প্রশস্ত ছিল তথ্যের প্রতিষ্ঠা ততটা প্রধান ছিল না। অবশ্য উপযুক্ত তথ্যও তখন সহজ প্রাপ্য ছিল না। সেদিক থেকে চর্যাগীতিগুলির আবিষ্কারে ইতিহাসের অনেক শূন্যস্থান পূরণ ও পূর্বে অনুমিত সূত্রের পুনর্মূল্যায়ন সম্ভব হয়েছে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই অমূল্য ঐতিহাসিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয় বাংলার . বাইরে রক্ষিত নেপালের রাজকীয় গ্রন্থভান্ডারে। প্রকৃতপক্ষে নেপাল ও তিব্বতে রক্ষিত বিভিন্ন বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থের পুথির দিকে সর্বপ্রথম বিদেশী গবেষকদেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। Brian Hodgson নামে জনৈক ইংরেজ নেপাল থেকে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের অনেকগুলি পুথি আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের পর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস রচনা ও শাস্ত্রগ্রন্থ সম্পাদনার ব্যাপারে গবেষকদের মধ্যে বিশেষ তৎপরতা দেখা দেয়। বিস্তৃত ভাবে এ কাজ প্রথম শুরু করেন Eugene Burnoul (১৮৪৪)। এর পর আরও অনেক গবেষক নূতনতর পুথির সন্ধানে অনেকবার নেপালে গিয়েছেন। Daniel Wright ও Cecil Bendall এর নাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাঙালি গবেষকরাও এ ব্যাপারে পশ্চাৎপদ ছিলেন না। রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপাল গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন বৌদ্ধপুথির সন্ধান করে ১৮৮২ সালে Sanskrit Buddhist Literature in Nepal নামে একটি পৃথির তালিকা প্রকাশ করেন। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর সরকার হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপর বাংলা-বিহার-আসান-উড়িষ্যার পুথিসন্ধান ও সংগ্রহের দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। রাজেন্দ্রলালের তালিকা ও আরো নবাবিষ্কৃত পৃথির ভিত্তিতে হরপ্রসাদের মনে হয় যে নেপালের নানা জায়গায় বৌদ্ধধর্ম-সংক্রান্ত নানা পুথি ছড়িয়ে রয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এইসব উপকরণ একান্ত অপরিহার্য। এইসব উপকরণ সংগ্রহের জন্য তিনি ১৮৯৭-৯৮ সালে দুইবার নেপালে গিয়ে কতকগুলি সংস্কৃত পুথি সংগ্রহ করে আনেন এবং ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল গিয়ে আরও কিছু পুথি আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কৃত পুথিগুলির মধ্যে 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়', সরহপাদের দোহা ও অদ্বয়বজ্রের সংস্কৃতে রচিত 'সহজাম্নায় পঞ্জিকা' নামক টীকা এবং কৃষ্ণাচার্যের দোহা ও আচার্যপাদের সংস্কৃতে রচিত 'মেখলা' নামক টীকার পুথিগুলিকে প্রাচীন বাংলায় রচিত বলে তাঁর মনে হয়। এই তিনখানি পুথির সঙ্গে ডাকার্ণবের পুথিটি গ্রহণ করে তিনি বাংলা ১৩২৩ সনে (ইং ১৯১৬) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা' প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থ প্রকাশের পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ বিষয়ক পূর্বতন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তগুলি বিচলিত হয়ে পড়ল। শুধু বাংলাই নয় হিন্দী, মৈথিলী, ওড়িয়া প্রভৃতি অন্যান্য নবা ভারতীয় আর্য ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহাসিকদের মধ্যেও বিশেষ তৎপরতা দেখা গেল । ফলে এক দিকে নেপালের পুথি সম্পর্কে ভারতীয় গবেষকদের আগ্রহ আরো প্রসারিত হলো, অন্য দিকে হরপ্রসাদ আবিষ্কৃত রচনাবলীর নিবিড়তর বিশ্লেষণ শুরু হল। এই বিশ্লেষণের ফলে দেখা গেল, হরপ্রসাদের আবিষ্কার চমকপ্রদ হলেও তাঁর সিদ্ধান্তগুলি সমস্তই অভ্রান্ত নয়। প্রথমত দেখা গেল তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সব কয়টি পুথিই বাংলায় রচিত নয়, শুধু প্রথম পুথিটির ড্র চাই বাংলা, অন্য তিনটি পশ্চিমা অপভ্রংশে রচিত । দ্বিতীয়ত হরপ্রসাদ মনে করেছিলেন যে তাঁর আবিষ্কৃত পুথিখানিই চর্যাগীতি সংগ্রহের মূল পুথি এবং সেই পুথিরই নাম 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়'। সেই অনুসারে মুদ্রণের সময় পুথির নামকরণ করেছিলেন 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়'। কিন্তু সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় - আবিষ্কৃত তথ্যের সূত্র ধরে ডঃ প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যাগীতির যে তিব্বতী অনুবাদ সংগ্রহ করেছিলেন তাতে দেখা যায় যে মূল গীতিসংগ্রহের নাম ছিল 'চর্যাগীতিকোষবৃত্তি'।
চর্যাপদের সাহিত্য মূল্য ও সমাজচিত্র সম্পর্কে জানুন
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:২১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


