একসাথে তিন তালাক দিলে কি এক তালাক হয়?
---------------------------------------------------------------------------------
ইদানীং কেউ কেউ এ বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তাই বিষয়টি নিয়ে লেখার ইচ্ছা হল।
------------------------------------------------------------------------------------
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
কেউ কেউ এই ভুল ধারণা প্রচার করে রেখেছে যে, একসাথে তিন তালাক দিলে শুধু এক তালাক হয়। এটিও একটি মারাত্মক ভুল। একই মজলিসে পৃথক পৃথকভাবে তিন তালাক দেওয়া হোক কিংবা একই শব্দে তিন তালাক দেওয়া হোক- যেমন বলল, ‘তোমাকে তিন তালাক দিলাম।’
যেকোনো উপায়ে তিন তালাক দেওয়া হলে তিন তালাক কার্যকর হয়ে বৈবাহিক স¤পর্ক স¤পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায় শুধু মৌখিকভাবে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার যেমন কোনো সুযোগ থাকে না তেমনি নতুন করে বিবাহ দোহরানোর মাধ্যমেও ফিরিয়ে নেওয়ার পথ খোলা থাকে না। একাধিক সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন তালাক দেওয়াকে তিন তালাকই গণ্য করেছেন। যদিও এভাবে তালাক দেওয়ার কারণে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়েছেন।
যেমন-
মাহমুদ বিন লাবীদ রা.বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানানো হলো যে, জনৈক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক দিয়েছে। তিনি (একথা শুনে) রাগান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের মাঝে আমি থাকাবস্থায় আল্লাহর কিতাবের সাথে উপহাস করা হচ্ছে? এ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমি কি তাকে কতল করবো না? (-সুনানে নাসায়ী ঃ ২/৯৮, আলজাওহারুন নাকী ঃ ৭/৩৩৩, প্রকাশক: দারুল ফিকর)
লক্ষ্য করুন, এখানে নবীজী এক সঙ্গে তিন তালাক দেয়ার কারণে রাগান্বিত হয়েছেন, কিন্তু তাকে অকৃতকারয কিংবা এক তালাক বলে ঘোষণা দেন নি।
আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে বরণিত, রাফায়ার স্ত্রী বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমার স্বামী রাফায়া আমাকে এক সাথে তিন তালাক দিয়েছে? এরপর আমি আব্দুর রাহমানের সাথে বিবাহ করেছি। এখন রাফায়ার কাছে যেতে পারবো কিনা? নবীজী বললেন, আবদুর রহমান তোমার সাথে সহবাস করলে এরপর রাফায়ার নিকট যেতে পারবে।( সহীহ বুখারী 5261)
লক্ষ্র করুন, সাহাবাগণ জানতেন এক সাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাক ই হয়, তাই রাফায়ার স্ত্রী তিণ তালাকের পর অন্যত্র বিবাহ বসেছেন, এরপর নবীজীর নিকট পরবরতী বিষয় জানতে এসেছেন।
সাহাবী উয়াইমির আজলানী রা. সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি এবং তার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে লিআন করলেন। যখন লিআন শেষ হলো তখন উয়াইমির রা. বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! এখন যদি আমি তাকে আমার কাছে রাখি তাহলে আমি মিথ্যাবাদী। অতঃপর উয়াইমির রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে স্ত্রীকে এক সঙ্গে তিন তালাক দিলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা কার্যকর করলেন এবং তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটালেন। (-সহীহ বুখারী ঃ হাদীস নং ৫৩০৯, সুনানে আবু দাউদ ঃ হাদীস নং ২২৫০)
হযরত আলী রা. এর শাহাদাতের পর যখন হাসান রা. খলীফা নির্বাচিত হলেন তখন তার স্ত্রী আয়েশা খাছআমিয়া তাকে মোবারকবাদ জানান। হযরত হাসান রা. স্ত্রীকে বললেন, তোমার এই মোবারকবাদ কি হযরত আলী রা.এর শাহাদাতের কারণে? তুমি কি এতে খুশি প্রকাশ করছো? তোমাকে তিন তালাক দিলাম। যখন তার ইদ্দত শেষ হয়ে গেল তখন হাসান রা. তার অবশিষ্ট মহর এবং সাথে আরো অতিরিক্ত দশ হাজার দিরহাম পাঠিয়ে দিলেন। আয়েশা খাছআমিয়ার হাতে যখন এগুলো পৌঁছলো তখন তিনি বললেন, ‘প্রিয়ের বিচ্ছেদের তুলনায় এ সম্পদ অতি তুচ্ছ।’ হযরত হাসান রা. যখন এ কথা শুনলেন তখন অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, ‘আমি যদি নানাজানকে বলতে না শুনতাম কিংবা বলেছেন, আমার আব্বার মাধ্যমে নানাজানের এ কথা না শুনতাম, ' যে ব্যক্তি স্ত্রীকে হায়েয থেকে পবিত্র অবস্থায় পর্যায়ক্রমে তিন তালাক দিল কিংবা একসাথে তিন তালাক দিল তার জন্য ওই স্ত্রী হালাল হবে না অন্য পুরুষের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ছাড়া, তাহলে আমি তাকে ফিরিয়ে আনতাম।’ (-আসসুনানুল কুবরা ঃ ৭/৩৩৬, আলমু’জামুল কাবীর, তাবারানী : হাদীস নং ২৭৫৭, মাজমাউয যাওয়ায়েদ : হাদীস নং ৭৭৮৮)
হযরত হারুন ইবনে আনতারা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তার পিতা বলেছেন, আমি একদিন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর নিকট বসা ছিলাম। ইতিমধ্যে এক লোক এসে বলল, সে তার স্ত্রীকে এক বারেই একশো তালাক দিয়েছে। সে জানতে চাইল, এতে কি এক তালাক গণ্য হবে নাকি তিন তালাক গণ্য হবে? আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বললেন, তিন তালাক কার্যকর হয়ে তোমার স্ত্রী তোমার থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আর বাকি সাতানব্বই তালাকের গুনাহ তোমার উপর বর্তাবে। (-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ঃ আছার নং ১৮১০১)
উপরোক্ত হাদীস ও আসার থেকে বিষয়টি সুপ্রমাণিত যে. এক সাথে তিন তালাক দিলে তা তিন তালাকই হবে । এক তালাক নয়।
সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ ‘হাইয়াতু কিবারিল উলামা’-এর সর্বসম্মতিক্রম সিদ্ধান্তও এটিই যে, এক সাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই কার্যকর হবে, এক নয়। হুকুমতে সৌদিয়া এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি শাহী ফরমানও জারী করেছে। যেন ওই ভুল প্রোপাগান্ডার শিকার কেউ না হয়। সেখানকার সকল আদালতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এই পরিষদের সিদ্ধান্তই ‘অথরিটি’।
আমাদের দেশের যেসব বন্ধুরা সৌদি আরবের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেন তারা এখানে চিন্তার খোরাক পাবেন বলে আশা করি।
প্রকাশ থাকে যে, কেউ কেউ তিন তালকের পর স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার জন্য ওই ভ্রান্ত মত (একসাথে তিন তালাক দিলে সেটা এক তালাক হয়, তিন নয়।) অনুসরণের কথা বলে। এটি সম্পূর্ণ ভুল।
কারণ, ওই মত উম্মাহর সর্বজন স্বীকৃত সিদ্ধান্তের পরিপন্থি যা অনুসরণীয় নয়।
এমনকি কোন শরয়ী আদালতের বিচারকও যদি এ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেয় তাহলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
বিখ্যাত ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুল হুমাম রহ. (মৃত.৬৮১হি.) আলোচ্য মাসআলাটি যে সাহাবাযুগ থেকেই অবিসংবাদিত তা উল্লেখ করার পর লিখেছেন- (তরজমা) “আর এ জন্যই যদি কোন (শরয়ী) আদালতের বিচারক এই সিদ্ধান্ত দেয় যে, এক সাথে তিন তালাক দিলে এক তালাক হয়, তাহলে তার ফায়সালা গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা বিষয়টিতে নতুন ইজতিহাদ ও সিদ্ধান্তের কোন সুযোগ নেই। সুতরাং নতুন কোন সিদ্ধান্ত দেয়া হলে তা শরীয়তসম্মত ‘মতপার্থক্য’ নয়; শরীয়ত গর্হিত ‘বিচ্ছিন্নতা’ হিসাবেই গণ্য হবে।”
দ্বিতীয়ত, যদি তা স্বীকৃত কোন মত হত তারপরও এক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা জায়েয নয়। কেননা, কোন ঘটনা ঘটিয়ে বিশেষ সুযোগ নেয়ার জন্য অন্য মাযহাব বা মতামত গ্রহণ করার অর্থই হলো প্রবৃত্তির অনুসরণ ও সুযোগ সন্ধানী হওয়া যা শরীয়তে নিষিদ্ধ ও গর্হিত কাজ।
সুতরাং একই মজলিসে তিন তালাক দিলে তা এক তালাক হয়, এই ভ্রান্ত মত অনুসরণ করে সারা জীবন হারাম কাজে অতিবাহিত করা নিজের জন্য জাহান্নামের গর্ত খোঁড়া ছাড়া আর কিছু নয়।
পুনশ্চ:
কেউ কেউ ফেবুতে ইদানিং ‘তিন তালাক এক তালাক’ হওয়া প্রসংগে কথা বলছেন, তাদের কথায় বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য নিম্নে মোটা দাগের কিছূ কথা আরজ করছি।
১. এক সাথে তিন তালাকে দিলে তা তিন তালাকই হওয়ার বিষয়টি বহু আগেই সমাধান হয়ে গেছে।
সৌদির আন্তরজাতিক ইসলামিক স্কলার গণ এ বিষয়ে বহু আগেই দীরঘ গবেষণা করে সম্মিলিত সিদ্দান্ত দিয়েছেন, তিন তালাক হবে। তাদের সিদ্ধান্ত (পুরণ কপি) আমাদের নিকট আছে। যারা আরবী ভাল জানেন ও ইসলামী জ্ঞান রাখেন তারা তা সংগ্রহ করতে পারেন।
যারা এক তালাকের কথা বলেন, তাদের প্রত্যেকটি কথা রেফারেন্স সহ সেখানে খন্ডন করা হয়েছে। আমার অনুরোধ থাকবে কেউ এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করার আগে ওই সিদ্ধান্তটি ভালভাবে পড়ুন। এরপর যদি মনে হয়, বিশ্বের নামি দামি আন্তরজাতিক ইসলামিক স্কলার গণ এখানে ভুল করেছেন, তবে সুনিরদৃষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করুন। বলুন কোন রেফারেন্সটি ভুল , েকেন ভুল। দলীল -প্রমাণ সহকারে।
এবং এর সাথে বিশ্বের অন্যতম সেরা মুহাক্কীক ও গবেষক আলেম ,আল্লামা যাহেদ কাওসারী রহ, এর এ সংক্রান্ত থিসিসটিও পড়ৃন। এটিও আমাদের সংগ্রহে আছে। এ দুটি পড়ে এরপর আলোচনা করুন।
২.
একটা কথা প্রায়শই শোনা যায়, নবীজী ও আবু বকর রা.এর যামানায় এক সাথে তিন তালাক দিলে তা এক তালাক গন্য হত।
এ বিষয়টি যারা বলে তারা মূল বিষয়টিকে খন্ডিত ভাবে উপস্থাপন করে। বিভ্রান্ত করার জন্য।
মূল বিষয়টি হল, একটি বিশেষ সূরত তা হল,কেউ পরপর তিনবার বলল, তুমি তালাক, তুমি তালাক, তুমি তালাক।
নবীজীর যুগে ,আবু বকরের রা, যামানায় মানুষ ওইভাবে তালাক দিয়ে বলত, আমি বাকী দুইবার তালাক শব্দ বলেছি,প্রথম এক তালাক কে জোরালো করার জন্য। নতুন তালাক প্রয়োগ করা উদ্দেশ্য নয়। এজন্য তৎকালিন সময়ে দুটি শরতে ও্তইভাবে তিন তালাক দিলে এক তালাক গন্য হত।
শরত দুটি হল, ১, পরপর ওই ভাবে বলতে হবে। ( সৃতরাং এক শব্দে তিন তালাক দিলে তা যে কারযকর হবে তা বলাই বাহুল্য।)
২. নতুন তালাকের নিয়ত না করতে হবে(সুতরাং তিনতালাক দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনবার বললে তা যে কারযকর হবে তা বলাই বাহুল্য)
পরবরতী যামানায়,দেখা গেল মানুষ ব্যাপকভাবে ওইভাবে তালাক বলে-বাস্তব তিন তালাকই উদ্দেশ্য নেয়, প্রথম তালাককে জোরালো করা উদ্দেশ্য হয়না। তাই অবস্থা পরিবরতনের কারণে তখন উমর রা. ওই ভাবে এক সাথে তিন তালাক দিলে তা তিনই কারযকর করতেন।
ব্যাখ্যাটি করেছেন, হাদীস শাস্ত্রের ইমাম নববী রহ. । দেখুন, শরহে নববী 1: 478)
, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ, ইমাম কুরতুবী রহ, সহ প্রমুখ হাদীস শাস্ত্রের ইমাম গণ।
ব্যাখ্যাটির সমরতন পাওয়া যায়,এক হাদীসে দেখা যায় নবীজী সাহাবাকে জিজ্ঞেস করেচেন, তুমি কি এক তালাক উদ্দেশ্য নিয়েছ না তিন তা তুমি শপথ করে বল। (আবু দাউদ 1:300)
আরেক হল, উক্ত বক্তব্যটি ইবনে আব্বস রা.থেকে বরণিত, লক্ষ করুন. খোদ ইবনে আববাস রা. এর ফতোয়া ছিল, তিন তালাক হওয়ার। দেখুন, আল মুগনী 2:243)
তাছাড়া উমর রা. ছিলেন, খুলাফায়ে রাশেদার একজন। নবীজী শুধু নিজেন সুন্নাহ নয়;বরং খুলাফারে রাশেদার সুন্নাহকেও মানার আদেশ করেছেন। দেখুন, ( মুসনাদে আহমদ ,হাদীস: 17145)
সুতরাং যারা বলে, উমরের কথা নয় ,নবীর কথা মানতে হবে তারা আপনাকে বিভ্রান্ত করছে । সাবধান থাকুন। আল্লাহ সৃবহানাহু আমাদের সকলকে হেদায়াত দান করুন।