পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ : মার্শাল ল’ জারি ও সংবিধান স্থগিত রাখা অগ্রহণযোগ্য : বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদই মূল জাতীয় পরিচয়
মার্শাল ল’ জারি ও সংবিধান স্থগিত করা অগ্রহণযোগ্য ও অবৈধ বলে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখলকারীদের শাস্তি হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করা হয়েছে। আপিল বিভাগ জাতীয় পরিচয় বাংলাদেশী বহাল রাখেন। হাইকোর্ট বাংলাদেশীর স্থলে জাতীয় পরিচয় ‘বাঙালি’ করার কথা বলেছিল। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ এ রায় মঙ্গলবার প্রকাশ করা হয়। ১৮৪ পৃষ্ঠার রায়ে ২২টি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যা কিছু করতে হবে সংবিধান অনুযায়ীই করতে হবে। সংবিধানের বাইরে কিছু করা যাবে না।
আপিল বিভাগের রায়ের ১৮২, ১৮৩ ও ১৮৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত পর্যবেক্ষণে ১. লিভ পিটিশন দুটি খারিজ করে দিয়ে নিম্নলিখিত পরিবর্তন সাপেক্ষে হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে অনুমোদন দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, ২ (ক) সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ ও চতুর্থ তফসিলের ব্যাপারে হাইকোর্টের রায়ের সব অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ বাতিল করা হলো এবং ৯৫ অনুচ্ছেদের বৈধতার অনুমোদন দেয়া হয়নি। ৩(ক) ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সম্পাদিত সব বিধান, বিষয় ও কার্যাবলী, যা সম্পন্ন হয়েছে, তা অতীত (পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড) হিসেবে গণ্য হবে। (খ) তবে যেসব পদক্ষেপ নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে না; (গ) উক্ত সময়ে সম্পাদিত যেসব বিধান জনগণের কল্যাণে বা উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে; (ঘ) উক্ত সময়ে সম্পন্ন ওইসব নৈমিত্তিক কাজ যা একটি নির্বাচিত সরকার করে থাকে; (ঙ) (১) ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বরে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন, যা সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত (২) প্রজ্ঞাপন (সংশোধনী) আদেশ ১৯৭৭ (প্রজ্ঞাপন আদেশ নম্বর ১, ১৯৭৭), যা সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সম্পর্কিত; (৩) দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন (সপ্তম সংশোধনী) আদেশ, ১৯৭৬ (দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন আদেশ নম্বর ৪, ১৯৭৬) এবং দ্বিতীয় প্রজ্ঞপন (দশম সংশোধনী) আদেশ ১৯৭৭ (দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন আদেশ নম্বর ১, ১৯৭৭), যা সংবিধানের ইংরেজি ভার্সনের ৪৪ ধারা সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত; (৪) দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন (সপ্তম সংশোধনী) আদেশ, ১৯৭৮ (দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন আদেশ নম্বর ৪, ১৯৭৮), যা সংবিধানের বাংলা ভার্সনের ৪৪ ধারার সঙ্গে সম্পর্কিত; (৫) দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন (দশম সংশোধনী) আদেশ, ১৯৭৭ (দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন আদেশ নম্বর ১, ১৯৭৭), যা সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের উপধারা (২), (৩), (৪), (৫), (৬) ও (৭)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থাত্ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এবং সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং; (চ) সব বিধান ও শাসনতান্ত্রিক পদক্ষেপসমূহ যা মূল সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
উল্লেখ্য, সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ থেকে ৭ উপধারাগুলোতে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। ১০২ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে কতিপয় আদেশ ও নির্দেশ প্রভৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগকে ক্ষমতা দেয়া হয়।
মামলার সূত্রপাত : ১৯৭৫ সালের পর জরুরি অবস্থার ক্ষমতাবলে পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটের মুন সিনেমা হল পরিত্যক্ত সম্পত্তি ঘোষণা করে তা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। সিনেমা হলটিসহ ওই সম্পত্তির মালিকানা ফেরত পেতে ইতালিয়ান মার্বেল নামের একটি কোম্পানি ২০০০ সালে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করে। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ওই রিটের ওপর শুনানি শেষে ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট রায় দেন। রায়ে সিনেমা হলটি রিটকারীর অনুকূলে দেয়ার পাশাপাশি সংবিধানের ৫ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাকের রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ ও একই বছর ৬ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছে খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা হস্তান্তরকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি বিচারপতি সায়েমের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা গ্রহণ ও তাকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ এবং জিয়াউর রহমানকে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগও সংবিধান-বহির্ভূত বলা হয়। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে ওই সময়ের সরকার আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল দায়ের করে। সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর রাষ্ট্রপক্ষ লিভ টু আপিল প্রত্যাহার করে নেয়। ওই সময় অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে বলেন, হাইকোর্টের রায় বর্তমান সরকারের চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। তাই সরকার লিভ টু আপিল না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের ওই সিদ্ধান্তের পর বিএনপি মহাসচিব অ্যাডভোকেট খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও সুপ্রিমকোর্টের তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিলের পক্ষাবলম্বনের আবেদন করেন। আপিল বিভাগ তা মঞ্জুর করলে তারা লিভ টু আপিল দায়ের করেন। আদালত এ আবেদন গ্রহণ করলে পূর্ণাঙ্গ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে গত ২ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম (বর্তমান প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, বিচারপতি বিজন কুমার দাস, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে গঠিত আপিল বিভাগের ছয় সদস্যের ফুল বেঞ্চ কিছু সংশোধন, পরিমার্জন ও পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবীর করা লিভ টু আপিল খারিজ করে দেন। গত মঙ্গলবার পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি প্রকাশ করা হয়।
পঞ্চম সংশোধনীতে যা রয়েছে : শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংযোজন করা হয়। এছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য চার মূলনীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, সমাজতন্ত্রের জায়গায় ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার এবং জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্র সংযোজন করা হয়। সংবিধানের ৮(ক) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে আরও বলা হয়, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহার ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি।’ এছাড়া চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত একদলীয় বাকশাল শাসন ব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির অধীন থেকে বের করে আনা হয়। একই সঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের স্বাধীনতাও পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিক্রিয়া : অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলামসহ আপিল বিভাগের ৬ জন বিচারপতির স্বাক্ষর শেষে গত মঙ্গলবার সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের মাধ্যমে এ রায় প্রকাশ করা হয়। ওইদিন রাতে তাত্ক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম পর্যবেক্ষণসহ রায়ের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, হাইকোর্টের রায়ে খন্দকার মোশতাক ও বিচারপতি সায়েমের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণ ও সামরিক শাসন জারি অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ে মার্শাল ল’কে অবৈধ বলা হয়েছে। সংবিধান স্থগিত করা কিংবা অংশবিশেষ স্থগিত করা অগ্রহণযোগ্য বলা হয়েছে। যারা ভবিষ্যতে এ রকম করবে তাদের উপযুক্ত শাস্তির বিধান করার বিষয়ে বলা হয়েছে। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের সংবিধান সংশোধন, প্রজ্ঞাপন জারি, বিধি-বিধান প্রণয়নসহ অন্যান্য কার্যক্রমগুলোকে ‘পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড’ বলা হয়েছে। ওই সময়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ জনকল্যাণমূলক কাজগুলোকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, রায়ে উচ্চাভিলাষীদের সংবিধান স্থগিত করা, কাটাছেঁড়ার বিষয়ে আপিল বিভাগ তিরস্কার করেছেন। এ ব্যাপারে সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে। অসাংবিধানিকভাবে ও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল প্রক্রিয়া চিরতরে বিদায় জানানোর কথাও রায়ে বলা হয়েছে। জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেছিল। আপিল বিভাগ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পক্ষে মত দিয়েছেন। হাইকোর্টের রায়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের বিষয়ে আপিল বিভাগের কোনো নির্দেশনা নেই বলে তিনি জানান। আপিল বিভাগের এ রায় ’৭২ সালের মূল সংবিধানে যাওয়ার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করবে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর সব কিছু বাতিল করা হয়নি। আবার মূল সংবিধানের ব্যাপারে হাইকোর্টের রায়ের সব কিছুকে বহাল রাখা হয়নি। বিষয়টি সংসদই ঠিক করবে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আপিল বিভাগের কোনো নির্দেশনা নেই। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রই থাকবে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ বিষয়েও আপিল বিভাগের কোনো নির্দেশনা নেই। কাজেই চতুর্থ সংশোধনী পুনর্বহালের কোনো সুযোগ নেই।
আমার দেশ