somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাতীয় শিক্ষানীতি, ধর্ম এবং হরতাল--মুহম্মদ জাফর ইকবাল

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ৮:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(কপি-পেস্ট পোস্ট)

ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল ২৬ ডিসেম্বর দেশে হরতাল ডেকেছে, কারণটা আমি পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। খবরের কাগজ পড়ে মনে হলো, আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতে যথেষ্ট পরিমাণ ‘ইসলামধর্ম’ নেই, সেটা হচ্ছে কারণ। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, যাঁরা হরতাল ডেকেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই জাতীয় শিক্ষানীতিটি পড়ে দেখেননি, পড়ে থাকলে তাঁরা কখনোই এ ধরনের একটি কারণ দেখিয়ে হরতাল ডাকতে পারতেন না। এই শিক্ষানীতিতে ধর্মকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কি হয়নি, সেই বিতর্কে না গিয়ে আমি সরাসরি শিক্ষানীতি থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি, দেশের মানুষই বিচার করুক, হরতাল দেওয়ার আসলেই কারণ আছে কি নেই।
শিক্ষানীতির একেবারে প্রথম লাইনে আমাদের সংবিধানের নির্দেশনা এবং দ্বিতীয় লাইনে জাতিসংঘের শিশু শিক্ষার অধিকারের কথাটি স্মরণ করানো হয়েছে। কাজেই শিক্ষানীতির মূল বক্তব্যটি শুরু হয়েছে তৃতীয় লাইনে এবং লাইনটি আমি হুবহু তুলে দিই: ‘শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা।’ যাঁরা বলছেন শিক্ষানীতিতে যথেষ্ট ধর্ম নেই, তাঁদের আমি প্রয়োজন হলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাই যে একেবারে শুরুতেই বলা হয়েছে, এই শিক্ষানীতির যে কয়টি মূল উদ্দেশ্য আছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা। সেটি কীভাবে করা হবে, পরে বিস্তৃতভাবে বলা আছে। কিন্তু একেবারে প্রথম পর্যায়ে যে ৩০টি লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তার রোল নম্বর হলো: ‘প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়তা করা।’
সেই ১৯৭১ সালে ভয়াবহভাবে এবং গত ৪০ বছর নানাভাবে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই অনেক শিক্ষাবিদই মনে করেন, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো আমাদেরও স্কুল-কলেজে ধর্মশিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তারা সেটা নিজেদের বাসায় পরিবারের কাছ থেকে শিখে নেবে। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য এ যুক্তিটি ব্যবহার করার উপায় নেই—দেশের বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের মা-বাবা অশিক্ষিত কিংবা অল্প শিক্ষিত। তাঁরা ছেলেমেয়েদের ধর্মশিক্ষা দিতে পারবেন বলে মনে হয় না, বরং ধর্মান্ধ কোনো মানুষের হাতে তুলে দেবেন এবং ছেলেমেয়েরা ধর্মের উদার অংশটুকু না শিখে কিছু আচার-আচরণের সঙ্গে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতা শিখে বসে থাকবে। তার চেয়ে অনেক নিরাপদ ব্যাপার হচ্ছে, দেশের জ্ঞানী-গুণী ধর্মপ্রাণ মানুষ দিয়ে চমৎকার কিছু পাঠ্যবই লিখিয়ে নেওয়া, যেটা থেকে এরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ধর্ম শিখে নেবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, ধর্মের সঙ্গে নৈতিকতা শেখানোর এটা হচ্ছে আরেকটা সুযোগ। তাই শিক্ষানীতিতে স্পষ্ট করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ধর্মশিক্ষার ব্যাপারটা উল্লেখ করা আছে।
এই শিক্ষানীতিতে প্রথমবার প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপারটি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষায় আনুষ্ঠানিকভাবে লেখাপড়া শুরু করার আগে শিশুদের লেখাপড়ায় আগ্রহী করার জন্য কয়েকটা কৌশলের কথা বলা আছে, তার মধ্যে একটা কৌশল হিসেবে যেটা লেখা আছে, সেটা হুবহু তুলে দিচ্ছি (পৃষ্ঠা ৩) ‘মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডায় ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত সকল ধর্মের শিশুদের ধর্মীয় জ্ঞান, অক্ষরজ্ঞানসহ আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিকতা শিক্ষা প্রদানের কর্মসূচি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অংশ হিসেবে গণ্য করা হবে।’ যার অর্থ শুধু যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ধর্মশিক্ষার ব্যাপারটা আছে, তা নয়, সেটা শুরু হয়েছে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে।
জাতীয় শিক্ষানীতিতে যথেষ্ট পরিমাণ ধর্ম নেই বলে হরতাল ডাকা হয়েছে অথচ সপ্তম পরিচ্ছেদটির (পৃষ্ঠা ২০) শিরোনাম হচ্ছে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা। সেখানে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে লেখা আছে: ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্ম সম্পর্কে পরিচিত, আচরণগত উৎকর্ষ সাধন এবং জীবন ও সমাজে নৈতিক মানসিকতা সৃষ্টি ও চরিত্র গঠন।’ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দুটি যথাক্রমে ‘প্রচলিত ব্যবস্থাকে গতিশীল করে যথাযথ মানসম্পন্ন ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাদান’ এবং ‘প্রত্যেক ধর্মে ধর্মীয় মৌল বিষয়সমূহের সঙ্গে নৈতিকতার ওপর জোর দেওয়া এবং ধর্ম শিক্ষা যাতে শুধু আনুষ্ঠানিক আচার পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে চরিত্র গঠনে সহায়ক হয়, সেদিকে নজর দেওয়া।’
শিক্ষানীতিতে যথেষ্ট পরিমাণ ধর্ম নেই বলে হরতাল ডাকা হয়েছে, অথচ ইসলামধর্ম শিক্ষার কৌশল হিসেবে যে কয়টি প্রস্তাব রাখা হয়েছে, তার প্রথম তিনটি হচ্ছে: ১. শিক্ষার্থীদের মনে আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও আখিরাতের প্রতি অটল ঈমান ও বিশ্বাস যাতে গড়ে ওঠে এবং তাদের শিক্ষা যেন আচারসর্বস্ব না হয়ে তাদের মধ্যে ইসলামের মর্মবাণীর যথাযথ উপলব্ধি ঘটায়, সেভাবে ইসলামধর্ম শিক্ষা দেওয়া হবে। ২. ইসলামধর্মের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অবহিত হওয়া, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হবে। ৩. কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাতের তাৎপর্য বর্ণনাসহ ইসলামধর্মের বিভিন্ন দিক যথার্থভাবে পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করা হবে।
শিক্ষানীতিতে খুঁটিনাটি থাকার কথা নয়, মূল নীতিটা বলে দেওয়া হয়, যে নীতিকে সামনে রেখে পুরো ব্যবস্থাকে সাজিয়ে নেওয়া হয়। যাঁরা হরতাল ডেকেছেন, তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন, যদি ওপরের তিনটি কৌশল অবলম্বন করা হয়, তাহলে আর কোন বিষয়টি বাকি থাকল? একটি শিক্ষানীতিতে এর চেয়ে বেশি কী দেওয়ার আছে?
অন্যান্য পাঠককে বলে দেওয়া যায়, ইসলামধর্ম শিক্ষার মতো হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও খ্রিষ্টধর্ম শিক্ষার কৌশলগুলোও এভাবে গুছিয়ে বলে দেওয়া আছে। শুধু তা-ই নয়, স্পষ্ট করে বলে দেওয়া আছে (পৃষ্ঠা ২১) ‘আদিবাসীসহ অন্যান্য সম্প্রদায় যারা দেশের প্রচলিত মূল চারটি ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের অনুসারী, তাদের জন্য নিজেদের ধর্মসহ নৈতিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।’
শুধু যে ধর্মের কথা বলা হয়েছে তা নয়, জাতীয় শিক্ষানীতিতে ধর্মের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে (পৃষ্ঠা ২১), যার প্রথম বাক্যটি হচ্ছে, ‘নৈতিকতার মৌলিক উৎস ধর্ম।’ ইউরোপের অনেক দেশের একটি বড় অংশের মানুষ কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্মাবলম্বী না হয়েই বড় হচ্ছে এবং তার পরও তারা যথেষ্ট নীতিমান। কাজেই আধুনিক পৃথিবীর মানুষ এই বাক্যটি নিয়ে তর্কবিতর্ক করতে পারে কিন্তু তার পরও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এই বাক্যটিকে শিক্ষানীতিতে সংযোজন করে দেওয়া হয়েছে।
এখন পর্যন্ত যেটুকু লেখা হয়েছে, তার পুরোটুকু হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ধর্মশিক্ষা। এ ছাড়া রয়েছে মাদ্রাসাশিক্ষা—তার জন্য পুরো একটা অধ্যায় রয়েছে (পৃষ্ঠা ১৮)। তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে যেটা লেখা হয়েছে, সেটা হুবহু আমি তুলে দিচ্ছি: ‘মাদ্রাসা শিক্ষায় ইসলাম ধর্মশিক্ষার সকল প্রকার সুযোগ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে। শিক্ষার্থীরা যেন ইসলামের আদর্শ ও মর্মবাণী অনুধাবনের পাশাপাশি জীবন ধারণসংক্রান্ত জ্ঞানলাভ করতে পারে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শী হয় ও তার উৎকর্ষ সাধনে ভূমিকা রাখতে পারে, তার জন্য যথার্থ জ্ঞানলাভের ব্যবস্থা করা হবে। সাধারণ বা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা যেন সমানভাবে অংশ নিতে পারে, সে জন্য মাদ্রাসা ও শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিম্নরূপ: এরপর চারটি ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য আর লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। যার প্রথমটি হচ্ছে: ‘শিক্ষার্থীর মনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর প্রতি অটল বিশ্বাস গড়ে তোলা এবং শান্তির ধর্ম ইসলামের প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবনে সমর্থ করে তোলা।’ আমরা যদি লেখাপড়ার দিক থেকে বিবেচনা করি, তাহলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চতুর্থটি: ‘শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে অন্যান্য ধারার সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষায় সাধারণ আবশ্যিক বিষয়সমূহে অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করা।’ এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে আরও একবার বলা হয়েছে, ‘পরীক্ষা ও মূল্যায়ন অধ্যায়ে (২১ নম্বর অধ্যায়, পৃষ্ঠা ৫০)।’ সেখানে ৯ নম্বর কৌশল হিসেবে লেখা হয়েছে, ‘মাদ্রাসার ক্ষেত্রে জুনিয়র দাখিল, দাখিল ও আলিম পরীক্ষায় সকল ধারার জন্য আবশ্যিক বিষয়সমূহে অন্যান্য ধারার সঙ্গে অভিন্ন প্রশ্নপত্র অনুসরণ করা হবে।’
শিক্ষানীতির অন্য সবকিছু ছেড়ে দিয়ে শুধু এই একটি বিষয়ের কথাটা চিন্তা করলেই সবাই বুঝতে পারবে, এটি কত যুগান্তকারী একটা সিদ্ধান্ত। বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করলেই সবাই সেটা বুঝতে পারবে। সবাই জানে, দাখিল এবং এসএসসিকে সমপর্যায় ধরা হয়, ঠিক সে রকম আলিম এবং এইচএসসিকে সমপর্যায় ধরা হয়। শুধু তা-ই নয়, সাধারণ ধারার মতো মাদ্রাসাতেও বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। এই বিষয়গুলো জেনে অনেকের ধারণা হতে পারে, মাদ্রাসায় যারা লেখাপড়া করে, তাদের বুঝি স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করা ছেলেমেয়েদের মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। বিষয়টি একেবারেই সত্যি নয়—আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারে প্রায় ১৫ হাজার ছেলেমেয়ে বিজ্ঞান বা ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। তাদের ভেতর থেকে মাদ্রাসার মাত্র একটি ছাত্র বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটে মেধা তালিকায় আসতে পেরেছে। হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ভেতর থেকে যদি মাত্র একটি ছাত্র ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে, সেই লেখাপড়ার মাঝে খুব বড় গলদ রয়েছে।
মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটের বিষয়গুলোতে তুলনামূলকভাবে বেশি এসেছে কিন্তু ভর্তি হতে গিয়ে তারা আবিষ্কার করেছে, বেশির ভাগ বিভাগে তাদের ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা নেই। কারণ, তারা যে বিষয়গুলো পড়ে এসেছে, সেগুলোতে মার্কস পাওয়া যায় অনেক বেশি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতে ভর্তি হওয়ার জন্য সেগুলো কোনো কাজে আসে না।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মাদ্রাসাছাত্রদের সঙ্গে আসলে যে প্রতারণাটা করা হচ্ছে, সেটি এই শিক্ষানীতিতে প্রথমবার বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন থেকে তারা যখন দাখিল বা আলিম পাস করবে, তখন তাদের লেখাপড়ার মান হবে একজন এসএসসি বা এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীর সমান। তার কারণ সবাই এখন একই পাঠ্যসূচিতে লেখাপড়া করবে, একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দেবে। এত দিন যারা ভেবে এসেছে, মাদ্রাসায় গিয়ে কম লেখাপড়া করে বেশি গ্রেড পেয়ে যাবে, তাদেরও ফাঁকি দেওয়ার দিন শেষ। এখন অন্য সবার মতো সমান লেখাপড়া করে তাদের গ্রেড তুলে আনতে হবে।
এ তো গেল দাখিল-আলিমের কথা, এর পরও স্নাতক আর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে রয়েছে ফাজিল আর কামিল। তাদের ডিগ্রি কে দেবে? শিক্ষানীতিতে পরিষ্কার করে লেখা আছে, ‘উল্লিখিত কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য একটি অনুমোদনকারী (অ্যাফিলিয়েটিং) ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।’
কওমি মাদ্রাসাগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসতে চায় না, তার পরও শিক্ষানীতিতে তাদের উপেক্ষা করা হয়নি। কৌশলের একটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কওমি মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন করে উক্ত কমিশন কওমি প্রক্রিয়ায় ইসলাম শিক্ষার ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষাদান বিষয়ে সুপারিশ তৈরি করে সরকারের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করবে।’
এই হচ্ছে শিক্ষানীতিতে ধর্মসংক্রান্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে একটা ধারণা। এ দেশের মানুষের কাছে আমার প্রশ্ন, একটি শিক্ষানীতিতে কি এর চেয়ে বেশি ধর্ম সম্পর্কে থাকা প্রয়োজন? যদিও শিক্ষানীতিতে ধর্ম নেই বলে যাঁরা দাবি করছেন, তাঁরা কি সরাসরি এটা নিয়ে প্রকাশ্যে বিতর্কে যেতে প্রস্তুত আছেন? তাঁদের যদি একটা চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়, তাঁরা কি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার সাহস দেখাতে পারবেন?

২.
যাঁরা হরতাল ডেকেছেন, মোটামুটিভাবে বোঝা যায় যে তাঁদের কাছে ধর্ম খুব একটা সংকীর্ণ বিষয়, ধর্ম পালন থেকে সেটা ব্যবহার করায় তাঁদের আগ্রহ বেশি। কিন্তু আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ করেছি, বিএনপি এই হরতালকে সমর্থন দিয়েছে। আমি যেহেতু শিক্ষানীতি কমিটির একজন সদস্য হিসেবে কাজ করেছিলাম, তাই খুব আগ্রহ নিয়ে এ বিষয়ে কে কী বলছে, সেটা লক্ষ করছিলাম। আমি বেশ আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করেছিলাম, বিএনপিপন্থী শিক্ষাবিদেরাও এই শিক্ষানীতির বিপক্ষে গুরুতর কিছু বলেননি, তাঁরা সাধারণভাবে এটা সমর্থন করেছেন। কিন্তু ২৬ ডিসেম্বরে হরতালকে সমর্থন জানানোর পর আমি খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গেছি। বিএনপির একাধিক সাবেক শিক্ষামন্ত্রী আছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আছেন, অন্যান্য শিক্ষানীতির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষাবিদেরা আছেন, তাঁদের কাছে আমার অত্যন্ত সহজ একটা অনুরোধ—তাঁরা কি পরিষ্কার করে বলবেন, শিক্ষানীতির কোন অংশটির কারণে তাঁরা হরতালকে সমর্থন দিয়েছেন? যদি সে রকম কিছু খুঁজে না পান, তাহলে কি তাঁরা তাঁদের দলকে সেটা বোঝাবেন?

৩.
আসলে যাঁরা হরতাল ডেকেছেন এবং যাঁরা সেটাকে সমর্থন করেছেন, তাঁদের আপত্তি অন্য জায়গায়। এই শিক্ষানীতিটি তৈরি করা হয়েছে আমাদের ছেলেমেয়েদের আধুনিক ছেলেমেয়ে হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। তাদের দেশপ্রেম শেখানোর কথা বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা হয়েছে, অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলা হয়েছে। মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, ছেলেদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একই সুযোগ পেয়ে একই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। তাদের কারুকলা শেখানোর কথা বলা হয়েছে, সুকুমার বৃত্তি বিকাশের কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞানমনস্কতার কথা বলা হয়েছে, সৃজনশীলতার কথা বলা হয়েছে—এক কথায় আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, সেই বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য যে রকম একটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন, সে রকম একটি শিক্ষাব্যবস্থার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যাঁরা হরতাল ডেকেছেন, তাঁরা আসলে সেই বাংলাদেশকে চান না। সত্যি কথা বলতে কি, তাঁরা এ বাংলাদেশটিকেই চাননি—যে পাকিস্তানকে পরাজিত করে আমরা এই বাংলাদেশ পেয়েছি, তাদের ঘাড়ে এখনো সেই পাকিস্তানি ভূত চেপে বসে আছে। এই বাংলাদেশকে তাঁরা আর পাকিস্তান রাষ্ট্র বানাতে পারবেন না কিন্তু চিন্তাভাবনায়, আদর্শে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো ১০০ বছর পিছিয়ে নেওয়াই হচ্ছে তাঁদের একমাত্র স্বপ্ন। শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে কথা বলে তাঁরা সেই কাজটিই করে যাচ্ছেন।
এ দেশে যতবার শিক্ষানীতি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, দেশের প্রগতিশীল মানুষ ততবার তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। এই প্রথমবার একটি শিক্ষানীতি দেওয়া হয়েছে, যেটি প্রগতিশীল মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছে। দেশের ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যদি এর বিরোধিতা করে, তাহলে অন্য সবাইকে মাঠে নেমে এসে এর বাস্তবায়নের কথা বলতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধী মানুষগুলোকে বোঝাতে হবে, এই দেশটি আমাদের—তাদের নয়!

আজকের প্রথম আলো
১২টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×