somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আখের গুড় নাকি বিষ!

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ৮:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
কৈফিয়ত: এটি একটি কপি-পেস্ট পোস্ট
সবার পড়া উচিৎ মনে করে পোস্ট করলাম।
আখের গুড় নাকি বিষ!



চুলার ওপর বিশাল ড্রামের কড়াই। চুলি্লর ভেতর জ্বলছে গনগনে আগুন। কড়াইয়ে প্রথমে দেওয়া হলো চিটাগুড় (সাধারণত গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার্য)। আগুনের তাপে কিছুক্ষণ পর সেই গুড় পাতলা হয়ে এলে তার মধ্যে ঢেলে দেওয়া হলো পরিমাণমতো চিনি। হাতা দিয়ে নেড়ে নেড়ে চিনি মেশানো হলো চিটাগুড়ের সঙ্গে। প্রায় ২০ মিনিট এভাবে নাড়ার পর চিনি ও চিটাগুড়ের মিশ্রণ কিছুটা গাঢ় হয়ে এলে তাতে ঢেলে দেওয়া হলো অল্প পরিমাণ গমের আটা। এই তিনটি উপাদান আবার নাড়া হলো আরো প্রায় পাঁচ মিনিট। এ পর্যায়ে দ্রবণটিতে মেশানো হলো হাইড্রোজ, ফিটকিরি ও ডালডা। এরপর সব উপাদান আগুনের তাপে আরো পাঁচ মিনিট ধরে নাড়ানো হলো। ব্যস, মাত্র ৩০ মিনিটে কোনো রকম আখের রস ছাড়াই তৈরি হয়ে গেল চমৎকার, সুস্বাদু আখের গুড়। তবে সাবধান, দেখতে বা খেতে যত ভালোই হোক, এই ভেজাল গুড় স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
আখের গুড় তৈরি করতে মূল উপাদান হিসেবে যে আখের রস প্রয়োজন হয়, সেই রসের কোনো অস্তিত্বই থাকে না এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত গুড়ে। ফলে এটি গুড় না হয়ে হচ্ছে বিষাক্ত কোনো খাদ্যদ্রব্য; যদিও বিশুদ্ধ আখের গুড় হিসেবে এই গুড় এখন রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি দরে।
আবার ড্রামের মধ্যে নোংরা অবস্থায় সংরক্ষিত আগের বছরের আখের নালি দিয়েও তৈরি হয় ভেজাল গুড়। এই নালি গুড়ের মধ্যে চিনি, গমের আটা, হাইড্রোজ, ফিটকিরি ও ডালডা মিশিয়ে তৈরি করা হয় নতুন ভেজাল গুড়। দেখতে সুন্দর (উৎপাদনকারীদের ভাষায় এক নম্বর) এই গুড় বর্তমানে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি দরে। এটিকেও আখের গুড় হিসেবে ধরা যায় না। বলা যায় চিনির ভেজাল গুড়।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, গুড়ের নামে যা বিক্রি হয় তা গুড় নয়। এগুলো বিষাক্ত খাদ্যদ্রব্য, যা খেলে লিভার, কিডনি, পরিপাকতন্ত্র, খাদ্যনালিসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. শহিদুল ইসলাম বলেন, যেসব উপাদান দিয়ে আখের গুড় তৈরি হচ্ছে, একমাত্র চিনি ছাড়া সেগুলোর সব কিছুই মানবদেহের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এই গুড় ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আবার চিটাগুড়ের প্রভাবে ঝিমুনিসহ নেশার ভাব হতে পারে। চিটাগুড়ে কিছু পরিমাণে অ্যালকোহল থাকে, যা নেশার ভাব সৃষ্টি করে। তিনি আরো বলেন, মিলে চিনি তৈরির পর উচ্ছিষ্ট চিটাগুড় সাধারণত পশুখাদ্য বা অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়। এটি মানুষের খাওয়ার উপযোগী নয়। কাজেই চিটাগুড় থেকে তৈরি ভেজাল গুড় খেলে মানুষের হজম শক্তি কমে যাওয়া, ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।
গত বুধবার সরেজমিন চারঘাটের মেরামতপুর ও গোপালপুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায় ভেজাল গুড় তৈরির মহোৎসব। রাজশাহী জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে চারঘাট উপজেলা সদর। এখান থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে মেরামতপুর গ্রাম। এই গ্রামের পাশেই গোপালপুর গ্রাম। এই দুটি গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতেই গড়ে উঠেছে ভেজাল আখের গুড় তৈরির কারখানা। দুুটি গ্রামে ১২০ থেকে ১৩০টি বাড়িতে ভেজাল গুড় তৈরি করা হয় বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে।
বুধবার সকাল ৯টার দিকে প্রথমে মেরামতপুর গ্রামে ঢুকতেই নাকে ভেসে আসে আখের গুড়ের মিষ্টি গন্ধ। গ্রামের মধ্য দিয়ে গেছে এবড়ো-খেবড়ো একটি পাকা রাস্তা। এই রাস্তার বাঁ পাশের একটি বাড়িতে তৈরি হচ্ছিল আখের ভেজাল গুড়। ওই বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যায় অভিনব পদ্ধতিতে গুড় তৈরির কর্মযজ্ঞ। বাড়ির মালিকসহ আরো তিন শ্রমিক আখের ভেজাল গুড় তৈরিতে ব্যস্ত। কেউ চুলায় জ্বাল দিচ্ছেন, কেউ পাশে রাখা ড্রাম থেকে চিটাগুড় মেপে চুলার ওপর কড়াইয়ে ঢালছেন। আবার কেউ চিনি মাপায় ব্যস্ত। কেউ ব্যস্ত ছিলেন কড়াইয়ের ওপর চিনি ও চিটাগুড় মেশানোর কাজে। একজনকে দেখা গেল পাটালিতে রাখা গুড়ের তত্ত্বাবধান করতে।
সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বাড়ির মালিক ছুটে এসে ছবি না তোলার অনুরোধ জানান। 'আপনাদের কোনো সমস্যা হবে না'- এমন অভয় দেওয়ার পর বাড়ির মালিক হযরত আলী ছবি তুলতে দিতে রাজি হন। তিনি জানান, চার মাস ধরে তিনিসহ অন্যরা এভাবে গুড় তৈরি করছেন। ৩০ কেজি গুড় তৈরি করতে সর্বোচ্চ সময় লাগে ৩০ মিনিট। সেই গুড় পাটালিতে ঢেলে ঘণ্টাখানেক রাখার পর পুরোপুরি তৈরি হয় আখের পাটালি গুড়। হযরত আলী আরো জানান, তাঁদের তৈরি গুড় নাটোরের আড়তদাররা এসে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে কিনে নিয়ে যান। তাঁরাই চাহিদা দিয়ে এই গুড় তৈরি করিয়ে নেন। এরপর তা নাটোরের আড়তদারদের কাছ থেকে রাজশাহী, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বাজারের পাইকারি গুড় ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যান। তাঁদের কাছ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে বাজারজাত করেন। এভাবেই কয়েক হাত বদল হয়ে শেষ পর্যন্ত এই গুড় বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে।
হযরত আলী জানান, তাঁর মতো মেরামতপুর গ্রামের আরো অন্তত ৬০ জন এ ব্যবসা করে থাকেন। গত কয়েক বছর তাঁরা বাজার থেকে চিনি, চিটাগুড়, ডালডা, হাইড্রোজ, ফিটকিরি ও গমের আটা কিনে অথবা বাড়িতে ড্রামের মধ্যে রেখে দেওয়া আগের বছরের পুরনো আখের নালি দিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করছেন।
আমিনুল ইসলাম নামের আরেক গুড় প্রস্তুতকারক জানান, চিটাগুড় ১৫ টাকা ও চিনি ৫১ টাকা দরে বাজার থেকে কিনে আনেন তাঁরা। এ ছাড়া অন্য উপাদানসহ ১৮ পাটালি (প্রতিটি ১৫ কেজি করে) গুড় তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় ১১ হাজার টাকা। সেই গুড় বিক্রি হয় ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকায়। প্রতিদিনের আয় এক থেকে তিন হাজার টাকা। পুরনো আখের নালি গুড় ও চিনি দিয়ে যে গুড় তৈরি হয়, তাতে ব্যয় হয় অন্তত ১৫ হাজার টাকা। বিক্রি হয় ১৮ থেকে ২২ হাজার টাকা দরে। এতে লাভ হয় তিন থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত।
গোপালপুর গ্রামের কাশেম জানান, তিনি চিটাগুড় দিয়ে গুড় তৈরি করেন না। তিনি পুরনো গুড়ের সঙ্গে চিনিসহ অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে নতুন গুড় তৈরি করেন। গ্রামের আরো অনেকেই এভাবে আখের গুড় তৈরি করে থাকেন। পাশাপাশি চিটাগুড় দিয়েও গুড় তৈরির কারবার চলছে সমানতালে। এভাবে রাজশাহীর দুই গ্রাম মিলে ১২০ থেকে ১৩০ জন উদ্যোক্তা আখের গুড় তৈরি করেন। জানা গেছে, প্রতিদিন তাঁরা অন্তত এক হাজার মণ গুড় তৈরি করেন।
কাশেমের ছেলে মামুন জানান, আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে আখ কাটা শুরু হবে। তখন তাঁদের এ ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ ওই সময় আখের রস দিয়ে আসল আখের গুড় উৎপাদিত হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভেজাল গুড় প্রস্তুতকারক জানান, স্থানীয় প্রশাসনকে মাসোহারা দিয়ে এই ভেজাল ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
চারঘাট থানার ওসি আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'এ ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমার জানা নেই। কাজেই মাসোহারা আদায় করার প্রশ্নই আসে না। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আমরা বড় অভিযানে নামব। প্রয়োজনে র‌্যাব নিয়ে এসে অভিযান চালাব।'
এ ব্যাপারে চারঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুন্সি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, 'বিষয়টি আমিও জানি। পুলিশ, র‌্যাবসহ বিএসটিআইয়ের প্রতিনিধিদল নিয়ে এর আগে কয়েকবার অভিযানও করেছি। কিন্তু কোনোভাবেই মারাত্মক ক্ষতিকারক ভেজাল গুড় তৈরির এ ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না।'
বিএসটিআইয়ের রাজশাহী অঞ্চলের উপপরিচালক রেজাউল করিম সরকার বলেন, 'এটি বিএসটিআইয়ের কাজের আওতার মধ্যে পড়ে না। ফলে এ নিয়ে আমরা অভিযান চালাতে পারি না। স্থানীয় প্রশাসন চাইলে আমরা তাঁদের সহযোগিতা করব।'

সূত্র: কালের কণ্ঠ, ০৭.০৯.২০১২
৭টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×