বিগত কয়েক বছরে আমি বেশ কিছু লেখা বই এবং না-বই আকারে পড়েছি। সবগুলোই নন-ফিকশন। এর বেশিরভাগই দাবা বিষয়ক; অল্প বিস্তর মিউজিক সফটওয়ার এবং আনুষঙ্গিক টেকনিক্যাল বিষয়ের ওপর। অনেক অনেক দিন পর একখানি ফিকশন পড়লাম। পড়তে পড়তে আবার নতুন করে অনুভব করলাম যে ফিকশনের একটি অসাধারণ গুণ আছে। ফিকশনে মানুষে মানুষে সম্পর্কের কথা থাকে, আবেগের কথা থাকে যা টেকনিক্যাল লেখায় থাকে না। এই আবেগ, সম্পর্কের কথা পড়তে পড়তে নিজের আবেগের জায়গাটাতেও নাড়াচাড়া হয়। এই অনুভূতি অসাধারণ।
প্রথমে ভেবেছিলাম পাঠ প্রতিক্রিয়ায় ইতি নেতি সব অনুভূতিই ব্যক্ত করব। কিন্তু এই উপন্যাসখানি পাঠের পর নির্মোহ প্রতিক্রিয়া দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় পাঁচ শত পৃষ্ঠার এই বইখানি আমি এক সপ্তাহেরও কম সময়ে পড়ে শেষ করেছি; এত দ্রুত আর কোন বই পড়েছি বলে মনে পড়ে না। বইখানি পড়তে গিয়ে কতবার আমার চোখ ভিজেছে হিসেব রাখা হয়নি। এই লেখায় আমি শুধু আবেগের জায়গাটা নিয়েই লিখব। উপন্যাস হিসেবে এর নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়াদি এখানে লিখার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। আরেকদিন লিখব।
মুক্তিযুদ্ধ ! এ যে এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান এই বিষয়টি আমি এতদিন শুধু কথার কথা হিসেবেই পড়েছি, লিখেছি। এই উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আমি অনুভব করেছি সত্যিই এটি মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিতে ছড়িয়ে থাকা এক কীর্তির নাম। মহাভারত বা ইলিয়াডে যেমন মূল ঘটনা প্রবাহের সমান্তরালে অসংখ্য উপাখ্যান একই সঙ্গে বয়ে চলে, এখানেই তাই। জাতীয় স্মৃতিসৌধের আকৃতি বিষয়ে একটি লেখায় একবার পড়েছিলাম- অনেক অত্যাচার অনেক শোষণের চাপে একটি চেতনা উঠে দাঁড়াচ্ছে- স্মৃতিসৌধের আকৃতিটি এই বিষয়টি ধরার একটি প্রয়াস। এই উপন্যাসের ঘটনা প্রবাহও কাছাকাছি একটি অনুভূতি দেয়। একটি অসাধারণ নাটক মঞ্চস্থ হতে চলেছে। এর আয়োজন, আবির্ভাব ও অভিনয়ের প্রতিটি দৃশ্যে এত অসংখ্য উপাখ্যান, এত অনন্য সব ত্যাগের গল্প, এত নিবিড় বেদনাময় সব দৃশ্য ! সব যেন সুররিয়ালিস্টিক। "বড় অদ্ভুত সে সময়। সবই অবাস্তব আবার সবই বাস্তব।"
এইসব ঘটনার বর্ণনা আগেও পড়েছি। কিন্তু ফিকশনের আকারে পড়ার বিষয়টা সম্পূর্ণ অন্যরকম। তিরিশ লক্ষ ! যার প্রতিটি সংখ্যার পেছনে একটি করে মৃত্যু ! শুধু পরিসংখ্যান বা ঘটনার বর্ণনা পড়ে সেই সময়কে স্পর্শ করা অসম্ভব। এই উপন্যাসটি পড়ার পর আমার মনে হচ্ছে সেই সময়টিকে দলিলাদির পাশাপাশি অবশ্যই ফিকশনের মধ্য দিয়েও বোঝার চেষ্টা করা অবশ্য কর্তব্য। তাহলেই সেই সময়টিকে কিছুটা হলেও স্পর্শ করা যেতে পারে। কতটুকু পারে আমার জানার বাইরে।
একটি দৃশ্যে এসে আমি এত হাহুতাশ করেছি বলার মত না। খুব কষ্ট লাগছিল। শাহেদ আর আসমানীর মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হয়। সেদিনও ঝগড়া শেষে যথারীতি আসমানী ছোট্ট রুনিকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। শাহেদ সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তাদের পেল না। এতে সে খুব একটা বিচলিতও না। আগেও এমন হয়েছে; আসমানী কয়েক দিন পরেই আবার উদয় হয়েছে। খোঁজাখুঁজি শেষে রাতে শাহেদ যখন বাসায় ফেরার জন্য পা বাড়াল শহরে তখন মিলিটারি নামল। শুরু হল অপারেশন সার্চ লাইট। আহ, কি নিদারুণ করুণ দৃশ্য !
কত শিশু আর কোনদিন মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে পারেনি; জানতেও পারেনি তারা কোথায় আছে কেমন আছে। কত স্বামী নববধুকে ফিরে আসার কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে নি। সেই বধু কি আজও পথ চেয়ে বসে থাকে ? কত মাতা কত পিতা তাঁদের বুকের ধন সন্তানকে দেশমাতার জন্য স্বেচ্ছায় কোরবান করে দিলেন। পরিবার বিচ্ছিন্ন কত সন্তান সম্ভবা প্রাণের দায়ে একাকী পথে পথে ঘুরেছেন। কত চোখের জল, কত রক্ত, কত বেদনা ! যারা পরিবারের সঙ্গে আবার মিলিত হতে পেরেছে সেই মিলন দৃশ্যটিও এত করুণ !
এই সুগভীর বেদনার ভার যে উপন্যাস বইতে পারে, পড়তে পড়তে তার নির্মাণ কৌশল বা লেখকের বলার ধরণ নিয়ে যেমনই লাগুক তা শেষতক আর মনে থাকে না। আমার মনে নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ১:৩৮