তারেক মাসুদের নিষ্পাপ কোমল শিশুটিকে যতবার টিভিতে দেখি ততবারই আত্মগস্নানিতে ভুগি,আমরা কিছুই করতে পারিনি সামগ্রিক ভাবে কিংবা একটা দেশ হিসেবে এই শিশুটির বাবাকে বাচাঁতে। ঠিক তেমনি আমার ছোট মামার মেয়ে ইউসরা কিংবা ছেলে জুলকারনাইনকে যখন দেখি, তখন আত্মদহনে দগ্ধ হই।সড়ক দুর্ঘটনা এই শিশুদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে এক অলস দুপুরে বাবার পাশে নিরাপদ উষ্ণতায় শুয়ে থাকার আনন্দ, বঞ্চিত করলো শীতের সকালে বাবার হাত ধরে সবুজ ঘাসে হাঁটার কোমল মুহূর্ত গুলো থেকে, কেড়ে নিল উৎসবমুখর মুহূর্ত গুলোতে বাবার সাথে ঘুরে বেড়ানোর অসাধারণ সময়টুকু। আমরা কিছুই করতে পারিনি, চার বছর হয়ে গেল। নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি।ছোটমামা, মানিকগঞ্জ, মীরসরাই, তারেক মাসুদ . . . . একের পর এক নিয়মিত হারে মৃত্যুগুলো টনক নড়াতে পারেনি আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নিয়োজিত উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। মীরসরাইয়ে ৫০টি সম্ভাবনার মৃত্যু দেখে চিৎকার করে এই ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়েছিল, " আর কত মরলে মানুষ বলবে তুমি শেষে / বড্ড বেশী মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে". . .
কিছু মানুষ কখনো নীরব হয়ে থাকেন না, কখনো দশজনের মাঝে সাধারণ হয়ে ভিড়ে হারিয়ে যান না।তারা কাজ করে যান, বীরদর্পে নিজের উপস্থিতি প্রমাণ করে যান। তেমনই একজন মানুষ শাহেদুল আলম কাদেরী। আমার জীবনের চলারপথে অনেকগুলো শিক্ষাই আমার ছোটমামার কাছ থেকে পাওয়া।
নেতৃত্ব একজন মানুষের অন্যতম যোগ্যতা। ছোটমামা ছিলেন একজন নেতা, স্বপ্নদ্রষ্টা। কখনো প্রতিবাদী, কখনো উদ্যোগী, কখনো ভালোবাসায় সিক্ত। তার জোরালো কন্ঠস্বর পৌঁছে গিয়েছিল বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটিতে। "চট্টগ্রাম বাঁচলে, বাংলাদেশ বাঁচবে. , . " মামার এই চিৎকার আমাদের আজও উদ্দীপ্ত করে। আমি কোন রাজনৈতিক নেতা হতে চাইনা কিন্তু চাই সামাজিক ও প্রগতিশীল কাজে নেতৃত্ব দিতে। আমার ছোটমামা আমাদের অনুপ্রেরণা।
বড় কিছু সৃষ্টি করতে হলে কিছু মানুষকে অনেক বেশী ত্যাগ করতে হয়। কিছু মানুষের অসাধারণ উদ্যোগ প্রয়োজন। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সেইরকম কিছু উদ্যোগী মানুষের প্রচেষ্টার ফল। নন্দিত ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ইউসুফ চৌধুরী ও ছোট মামা শাহেদ কাদেরী নি:স্বার্থভাবে কি অক্লান্ত পরিশ্রমে ছুটেছিলেন এই প্রতিষ্ঠানটির জন্য, তা চট্টগ্রামের অনেকেইর জানা। কারণ তারা একটি স্বপ্নের পেছনে ছুটেছিলেন, কোনকিছু পাওয়ার আশায় নয়।
আমার মেজ মামা মোরশেদুল আলম কাদেরী ভীষণ বন্ধুবৎসল, সদালাপী। সবার কাছে এই গুণের কারণে তিনি অনেক পছন্দের। বোধ হয় বংশগত ভাবেই তার এই স্বভাবটির উন্মেষ ঘটেছিলো ছোটমামার মাঝে। একজন সামান্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যেমন মামার বন্ধু, তেমনি সচিব ও মন্ত্রী পযার্য়ের অনেকেই ছিলেন ছোট মামার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর গুণের কারণেই বোধ হয় তাকে কাছে টেনে নিয়ে ছিলেন আধুনিক সাংবাদিকতার প্রবর্ত্তক মরহুম ইউসুফ চৌধুরী। কখনো নিজের সন্তান,কখনো বন্ধু, কখনো রাজপথের সহযোদ্ধা হিসেবে তিনি স্নেহধন্য করেছেন শাহেদ কাদেরী মামাকে। অনেক বড় স্বপ্ন দেখতেন আমার ছোট মামা। আর দশজন চট্টগ্রামের মানুষের মতো আমার মাও একটু সন্তানকেন্দ্রিক। এস.এস.সি পরীক্ষার পর সুযোগ পেয়েও যখন নটরডেম কলেজে আমি ভর্তি হলাম না, এইচ.এস.সি'র পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন পড়াশোনা অব্যাহত করলাম না - ছোট মামার অনেক আক্ষেপ ছিল। আমার মাকে সবসময় জিজ্ঞেসা করতো আমাকে কেন মালয়েশিয়া পড়তে পাঠানো হচ্ছেনা ? বড় বিশ্ববিদ্যালয়,বড় পরিবেশ, বৈশ্বিক পড়াশোনা- এই ছিল মামার স্বপ্ন। কেন আমরা চট্টগ্রামের বাইরে যাইনা এই নিয়ে মামার একটা কষ্ট ছিল। মামার মৃত্যুর ঠিক একবছরের মাথায় যখন যুক্তরাজ্যে স্কলারশীপ পেয়েই এমএসসি পড়তে যাচ্ছিলাম তখন উড়োজাহাজে চড়ে আর দশজনের মতো আমি শিহরিত হচ্ছিলাম না। প্লেনে ওঠার পর বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, তীব্রভাবে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল - মামা, তুমি শুনতে পাচ্ছো ? স্বপ্নরা কখনো মরেনা। যেই ভাগ্নেকে তুমি ঢাকায় কিংবা মালয়েশিয়ায় পড়তে পাঠাতে পারোনি, আজ সে সাত সাগরের ওপারে বিলেতে যাচ্ছে।
ছোট মামা সহ আমার মামারা প্রায় সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বড় মামা আমিনুর রশীদ কাদেরী, সেজ মামা খোরশেদুল আলম কাদেরী এখনও যুক্ত আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশিস্নষ্ট বিভিন্ন সংগঠনে অদ্ভুত এক ভালোবাসায়। আমাদের ভাই বোনেরা সবাই চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং বেশ সফল কর্পোরেট হওয়া সত্ত্বেও মামারা সব সময় স্বপ্ন দেখতেন পরিবারের এই প্রজন্মের কেউ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যেদিন আমি নিযুক্ত হলাম বড় মামার চোখে দেখলাম আনন্দের অশ্রু। সেজ মামা হয়ে গেলেন আবেগ আপ্লুত। প্রিয় এই মানুষগুলোর পাশে একজনের অনুপস্থিতি খুব অনুভব করছিলাম। তিনি আমার ছোট মামা। মামা, তোমার প্রিয় ম্যানেজম্যান্ট বিভাগে প্রায়ই আমি ঘুরতে যাই আর ভাবি এটা আমার মামাদের বিভাগ, আমাদের সাথে যার নাড়ীর টান।
যদি কোনকিছু ভালোবাসো, ভালোবাসাটা হতে হবে তীব্র। এই অদ্ভুত ভালোবাসা দেখেছিলাম ছোটমামার মাঝে। কয়েক বছর আগে তুমুল ভাংচুর আর হরতালের মাঝেও চট্টগ্রামের রাস্তায় বের হয়েছিলো একটিমাত্র গাড়ী, সেটি ছোটমামার। অসুস্থ ভাগ্নী সুবাহকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য দেখালেন দুর্দান্ত সাহস। কারণ পরিবার এবং ভাগ্নেদের প্রতি ছিল তার অসীম ভালোবাসা।
শেষ রাতে মাঝে মাঝে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি ছাদে চলে যাই। তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে। ভোরের মায়াময় পরিবেশে আস্তে আস্তে সব তারা নিভে যায় । কিন্তু কোথাও না কোথাও একটা তারা জ্বলতেই থাকে। বোধহয় সেটি শুকতারা। আমার ছোট মামা হলেন শেষ পর্যন্ত জ্বলতে থাকা সেই শুকতারা। যে আলো হয়ে সবসময় জ্বলবে আমাদের মাঝে, উৎস হয়ে থাকবে আমাদের অনুপ্রেরণার।
-আদনান মান্নান
(দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় ৫.০৯.২০১১ তারিখে প্রকাশিত)
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:১১