somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আর কত মরলে মানুষ বলবে তুমি শেষে...

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একট ক্ষোভ বুকে চাপা দিয়ে অনেকদিন ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটা বির্বণ কষ্ট প্রায় ভুলে থাকার চেষ্টা করি।হঠাৎ প্রিয় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ আর সাংবাদিক মিশুক মুনীরের মৃত্যু যেন মনে আগুন ধরিয়ে দিল। আমার সেই চিনচিনে কষ্ট এখন তীব্রতর হয়ে প্রতি মুহূর্তে আমাকে বিদ্ধ করে। সেই চাপা ক্ষোভ এখন আর্তনাদের মতো হয়ে গেছে। তারেক মাসুদের মৃত্যুতে পুরো দেশ যখন নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিয়ে উত্তাল,আমাদের খুব জানতে ইচ্ছে হয় কেন চার বছর আগে চৌদ্দগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আমার ছোট মামা শাহেদুল আলম কাদেরী, আমাদের আরেক মামা প্রকৌশলী হারম্নন সালামের মৃতু্যর পর কোন কার্যকর পদেক্ষেপ পাইনি? পরপর কয়েকদিন পত্রিকায় ছবি আর শিরোনামে যুক্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই কেন আমরা দেখলাম না ? সড়ক দুর্ঘটনা কি তবে এই রাষ্ট্রব্যবস্থার দায়ভার নয় ?
তারেক মাসুদের নিষ্পাপ কোমল শিশুটিকে যতবার টিভিতে দেখি ততবারই আত্মগস্নানিতে ভুগি,আমরা কিছুই করতে পারিনি সামগ্রিক ভাবে কিংবা একটা দেশ হিসেবে এই শিশুটির বাবাকে বাচাঁতে। ঠিক তেমনি আমার ছোট মামার মেয়ে ইউসরা কিংবা ছেলে জুলকারনাইনকে যখন দেখি, তখন আত্মদহনে দগ্ধ হই।সড়ক দুর্ঘটনা এই শিশুদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে এক অলস দুপুরে বাবার পাশে নিরাপদ উষ্ণতায় শুয়ে থাকার আনন্দ, বঞ্চিত করলো শীতের সকালে বাবার হাত ধরে সবুজ ঘাসে হাঁটার কোমল মুহূর্ত গুলো থেকে, কেড়ে নিল উৎসবমুখর মুহূর্ত গুলোতে বাবার সাথে ঘুরে বেড়ানোর অসাধারণ সময়টুকু। আমরা কিছুই করতে পারিনি, চার বছর হয়ে গেল। নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি।ছোটমামা, মানিকগঞ্জ, মীরসরাই, তারেক মাসুদ . . . . একের পর এক নিয়মিত হারে মৃত্যুগুলো টনক নড়াতে পারেনি আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নিয়োজিত উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। মীরসরাইয়ে ৫০টি সম্ভাবনার মৃত্যু দেখে চিৎকার করে এই ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়েছিল, " আর কত মরলে মানুষ বলবে তুমি শেষে / বড্ড বেশী মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে". . .
কিছু মানুষ কখনো নীরব হয়ে থাকেন না, কখনো দশজনের মাঝে সাধারণ হয়ে ভিড়ে হারিয়ে যান না।তারা কাজ করে যান, বীরদর্পে নিজের উপস্থিতি প্রমাণ করে যান। তেমনই একজন মানুষ শাহেদুল আলম কাদেরী। আমার জীবনের চলারপথে অনেকগুলো শিক্ষাই আমার ছোটমামার কাছ থেকে পাওয়া।
নেতৃত্ব একজন মানুষের অন্যতম যোগ্যতা। ছোটমামা ছিলেন একজন নেতা, স্বপ্নদ্রষ্টা। কখনো প্রতিবাদী, কখনো উদ্যোগী, কখনো ভালোবাসায় সিক্ত। তার জোরালো কন্ঠস্বর পৌঁছে গিয়েছিল বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটিতে। "চট্টগ্রাম বাঁচলে, বাংলাদেশ বাঁচবে. , . " মামার এই চিৎকার আমাদের আজও উদ্দীপ্ত করে। আমি কোন রাজনৈতিক নেতা হতে চাইনা কিন্তু চাই সামাজিক ও প্রগতিশীল কাজে নেতৃত্ব দিতে। আমার ছোটমামা আমাদের অনুপ্রেরণা।
বড় কিছু সৃষ্টি করতে হলে কিছু মানুষকে অনেক বেশী ত্যাগ করতে হয়। কিছু মানুষের অসাধারণ উদ্যোগ প্রয়োজন। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সেইরকম কিছু উদ্যোগী মানুষের প্রচেষ্টার ফল। নন্দিত ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ইউসুফ চৌধুরী ও ছোট মামা শাহেদ কাদেরী নি:স্বার্থভাবে কি অক্লান্ত পরিশ্রমে ছুটেছিলেন এই প্রতিষ্ঠানটির জন্য, তা চট্টগ্রামের অনেকেইর জানা। কারণ তারা একটি স্বপ্নের পেছনে ছুটেছিলেন, কোনকিছু পাওয়ার আশায় নয়।
আমার মেজ মামা মোরশেদুল আলম কাদেরী ভীষণ বন্ধুবৎসল, সদালাপী। সবার কাছে এই গুণের কারণে তিনি অনেক পছন্দের। বোধ হয় বংশগত ভাবেই তার এই স্বভাবটির উন্মেষ ঘটেছিলো ছোটমামার মাঝে। একজন সামান্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যেমন মামার বন্ধু, তেমনি সচিব ও মন্ত্রী পযার্য়ের অনেকেই ছিলেন ছোট মামার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর গুণের কারণেই বোধ হয় তাকে কাছে টেনে নিয়ে ছিলেন আধুনিক সাংবাদিকতার প্রবর্ত্তক মরহুম ইউসুফ চৌধুরী। কখনো নিজের সন্তান,কখনো বন্ধু, কখনো রাজপথের সহযোদ্ধা হিসেবে তিনি স্নেহধন্য করেছেন শাহেদ কাদেরী মামাকে। অনেক বড় স্বপ্ন দেখতেন আমার ছোট মামা। আর দশজন চট্টগ্রামের মানুষের মতো আমার মাও একটু সন্তানকেন্দ্রিক। এস.এস.সি পরীক্ষার পর সুযোগ পেয়েও যখন নটরডেম কলেজে আমি ভর্তি হলাম না, এইচ.এস.সি'র পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন পড়াশোনা অব্যাহত করলাম না - ছোট মামার অনেক আক্ষেপ ছিল। আমার মাকে সবসময় জিজ্ঞেসা করতো আমাকে কেন মালয়েশিয়া পড়তে পাঠানো হচ্ছেনা ? বড় বিশ্ববিদ্যালয়,বড় পরিবেশ, বৈশ্বিক পড়াশোনা- এই ছিল মামার স্বপ্ন। কেন আমরা চট্টগ্রামের বাইরে যাইনা এই নিয়ে মামার একটা কষ্ট ছিল। মামার মৃত্যুর ঠিক একবছরের মাথায় যখন যুক্তরাজ্যে স্কলারশীপ পেয়েই এমএসসি পড়তে যাচ্ছিলাম তখন উড়োজাহাজে চড়ে আর দশজনের মতো আমি শিহরিত হচ্ছিলাম না। প্লেনে ওঠার পর বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, তীব্রভাবে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল - মামা, তুমি শুনতে পাচ্ছো ? স্বপ্নরা কখনো মরেনা। যেই ভাগ্নেকে তুমি ঢাকায় কিংবা মালয়েশিয়ায় পড়তে পাঠাতে পারোনি, আজ সে সাত সাগরের ওপারে বিলেতে যাচ্ছে।
ছোট মামা সহ আমার মামারা প্রায় সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বড় মামা আমিনুর রশীদ কাদেরী, সেজ মামা খোরশেদুল আলম কাদেরী এখনও যুক্ত আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশিস্নষ্ট বিভিন্ন সংগঠনে অদ্ভুত এক ভালোবাসায়। আমাদের ভাই বোনেরা সবাই চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং বেশ সফল কর্পোরেট হওয়া সত্ত্বেও মামারা সব সময় স্বপ্ন দেখতেন পরিবারের এই প্রজন্মের কেউ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যেদিন আমি নিযুক্ত হলাম বড় মামার চোখে দেখলাম আনন্দের অশ্রু। সেজ মামা হয়ে গেলেন আবেগ আপ্লুত। প্রিয় এই মানুষগুলোর পাশে একজনের অনুপস্থিতি খুব অনুভব করছিলাম। তিনি আমার ছোট মামা। মামা, তোমার প্রিয় ম্যানেজম্যান্ট বিভাগে প্রায়ই আমি ঘুরতে যাই আর ভাবি এটা আমার মামাদের বিভাগ, আমাদের সাথে যার নাড়ীর টান।
যদি কোনকিছু ভালোবাসো, ভালোবাসাটা হতে হবে তীব্র। এই অদ্ভুত ভালোবাসা দেখেছিলাম ছোটমামার মাঝে। কয়েক বছর আগে তুমুল ভাংচুর আর হরতালের মাঝেও চট্টগ্রামের রাস্তায় বের হয়েছিলো একটিমাত্র গাড়ী, সেটি ছোটমামার। অসুস্থ ভাগ্নী সুবাহকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য দেখালেন দুর্দান্ত সাহস। কারণ পরিবার এবং ভাগ্নেদের প্রতি ছিল তার অসীম ভালোবাসা।
শেষ রাতে মাঝে মাঝে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি ছাদে চলে যাই। তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে। ভোরের মায়াময় পরিবেশে আস্তে আস্তে সব তারা নিভে যায় । কিন্তু কোথাও না কোথাও একটা তারা জ্বলতেই থাকে। বোধহয় সেটি শুকতারা। আমার ছোট মামা হলেন শেষ পর্যন্ত জ্বলতে থাকা সেই শুকতারা। যে আলো হয়ে সবসময় জ্বলবে আমাদের মাঝে, উৎস হয়ে থাকবে আমাদের অনুপ্রেরণার।
-আদনান মান্নান
(দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় ৫.০৯.২০১১ তারিখে প্রকাশিত)
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:১১
২৬টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×