স্কুল থেকে ফিরছিল জামাল। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় ওরই সমবয়সী সাকিব, আমর, হামিদ রাস্তায় মার্বেল খেলছে। ওদেরকে দেখে জামালের হাঁটার গতি কিছুটা কমে যায়। কারণ ওকে দেখলেই এখন তিনজন মিলে টিটকিরি দিবে। এ রাস্তা এড়িয়ে অন্য কোন রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায় কিনা ভাবছিল জামাল। কিন্তু ততক্ষণে ওরা তাকে দেখে ফেলেছে। এখন যদি জামাল রাস্তা পাল্টায় তাহলে ওরা তিনজন খুবই হাসাহাসি করবে আর চিৎকার করে টিটকিরি দিবে। তাই জামাল ওদের সামনে দিয়েই বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সাকিব, আমর, হামিদ ওরা স্কুলে খুব একটা যায় না, মাঝে মাঝে যায়। এ বয়সেই ওরা ইজরায়েলী সৈন্যদেরকে পাথর মারে, মিছিলে অংশ নেয়। তিনজনের কাছেই গুলতি আছে। জামাল ওদের কাছাকাছি আসতেই হাসাহাসি করতে থাকে, আমর বলে উঠে এই, সরে দাঁড়া, আমাদের ভীতুর ডিম মাস্টার মশাইকে রাস্তা ছেড়ে দে, সাকিব এসে ততক্ষণে জামালের পেটেএকটা গুঁতো মেরে দিল। একসময় ওরা তিনজন, জামাল এবং পাড়ার আরো কয়েকজন সমবয়সী মিলে একসাথেই খেলত। জামাল ওদেরকে একদিন আলাপচারিতায় বলেছিল সে বড় হয়ে ওর আব্বার মত স্কুলশিক্ষক হতে চায়। জামালকে ওরা ইজরায়েলী সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার জন্য অনেকবার নিতে চেয়েছিল। কিন্ত জামাল স্কুলের কথা বলে, এটাওটা বলে যায়নি। তাই জামালকে ওরা ভীতুর ডিম মাস্টার মশাই ডেকে ক্ষেপায়। নিজের খেলার সাথীদের এমন আচরণে জামালের মনে খুব কষ্ট লাগে। হঠাৎ করেই ওরা তিনজন একজন আরেক জনের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে দ্রুত চলে গেলে জামাল পিছনের দিকে তাকিয়ে ঘটনাটি বুঝতে পারে, তার বড় ভাই ইয়াছিন আসছে। ইয়াছিনকে দেখেই ওরা সটকে পড়েছে। ইয়াছিনকে পাড়ার সবাই খুব সমীহের চোখে দেখে। খুবই ডানপিটে আর সাহসী ছেলে। একবার অবৈধ দখলদার ইহুদীদের সাথে তাদের পাড়ার লোকজনের সংঘর্ষে ইয়াছিন খুব সাহস দেখায়। সেই থেকেই সবাই তাকে খুব সমীহ করে।
কিরে তোকে না বলছি, ওদের সাথে না মিশতে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মার্বেল খেলছিস? না, আমিতে মাত্র ফিরছি, ওদের সাথে এমনিতে কথা বলছিলাম। আসল ঘটনা গোপন করে জামাল। কারণ ও জানে, আসল ঘটনা যদি বলে তাহলে ওদের তিনজনের কপালে খারাপি আছে।
দুই ছেলেকে একসাথে বাসায় ফিরতে দেখে আসমা আনসারী খুবই অবাক হয়। এক সময় দুভাই সারাক্ষণ একসাথে থাকত। সারাক্ষণই দুভাইয়ের মধ্যে খুনোসুটি লেগে থাকত, আবার গলায় গলায় ভাবও ছিল। গত বছর দুয়েকের মধ্যে বড় ছেলে ইয়াছিন কেমন জানি পাল্টে যেতে থাকে। দুই বছর আগে ইজরায়েলী দখলদাররা গ্রামের একটা একটা জলপাই বাগানের দখল নিতে আসলে গ্রামবাসী ও ইজরায়েলীদের সাথে সংঘর্ষ বাধে। গ্রামের এক লোককে দুই ইজরায়েলী ধরে নিতে চাইলে ইয়াছিন দৌড়ে গিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই লাঠি দিয়ে আঘাত করে দুই ইজরায়েলীর মাথা ফাঁটিয়ে দিয়ে গ্রামের ঐ লোককে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। সেই থেকেই ছেলেটা কেমন যেন পাল্টে যেতে থাকে। লেখাপড়ায় সে কখনো মনযোগী ছিল না। এ ঘটনার পর স্কুলে যাওয়া একেবারেই ছেড়ে দেয়। কোথায় যায়, কি করে, আসমা কিছুই বুঝতে পারে না। ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু ছেলে কিছুতেই কিছু শুনে না। বড় ছেলেকে নিয়ে আসমা সব সময় শংকার মধ্যে থাকে, কখন জানি কি হয়। ছোট ছেলেটা বড়টার খুব উল্টো, পড়াশুনায় খুব মনযোগী, সারাক্ষণ বাড়িতে থাকে। বাড়ির সব কাজে আসমাকে সাহায্য সহযোগিতা করে। ইজরায়েলী সৈন্যরা তার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে প্রায় আট বছর হতে চলল। তখন ইয়াছিনের বয়স পাঁচ আর জামালের বয়স তিন বছর। কত জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করেছে আসমা, কতজনের কাছে গিয়েছে স্বামীর খোঁজে কিন্তু কোন খোঁজ পায় নি। সবাই বলে তার স্বামীকে মেরে ফেলা হয়েছে। যদি ইজরায়েলী কারাগারে তার স্বামী বন্দি থাকত তবে খোঁজ পাওয়া যেত। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর নিদারুণ কষ্টের মধ্যে নিপতিত হয় আসমা। একটি সাহায্য সংস্থার কাছ থেকে মাসে মাসে পাওয়া কিছু টাকা এবং তার সামান্য বেতন দিয়ে সংসার চলে। স্বামীর মারা যাওয়ার পর স্বামী যে স্কুলে চাকরি করত সেখানে আসমাকে কর্তৃপক্ষ কেরানির চাকরি দেয়। মাঝে মাঝে ছেলে দুটোর ভবিষ্যত চিন্তা করে আসমা অস্থির হয়ে যায়। এদিকে ইজরায়েলী অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরাও তাদের বাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। তাদের জলপাই বাগানটা একেবারে দখলদারদের বাগানের লাগোয়া। ছেলেরা যখন থাকে না, তখন এসব চিন্তা আসমার মনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। আলমারি থেকে স্বামীর ছবিটা বের করে দেখেন আসমা। ছবিটা তাদের ডাইনিং রুমেই টাঙ্গানো ছিল। একদিন আসমা দেখতে পান বড় ছেলে ইয়াসিন বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে কাঁদছে। আসমাকে দেখেই দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে যায়। সেদিনই আসমা ছবিটা নামিয়ে আলমারিতে রেখে দেন। তাছাড়া তার নিজের কেন জানি অস্বস্থি লাগে ছবিটার দিকে তাকালে। ছবিটার দিকে তাকালে নিজের মধ্যে প্রচন্ড এক ভাঙ্গন অনুভব করেন আসমা আনসারী। আসমা ভাবে প্রমত্তা নদীর ভাঙ্গন সবাই দেখে, কিন্তু মানুষের মনের ভাঙ্গন কেউ দেখে না, কেউ টের পায় না। ছেলে দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে আসমা আনসারী সে সর্বনাশা ভাঙ্গন ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আসমার মনে হয়, বাবার ছবি দেখলে ছেলেদের মনেও এ ধরনের অনুভূতি হয়। তাই তিনি চান না ছেলেরা কষ্ট পাক। এ সহজ সরল নির্বিবাদী মানুষটাকে কেন যে ইজরায়েলীরা ধরে নিয়ে গেল তার কোন উত্তর খুঁজে পান না আসমা আনসারী। স্কুলে আসা যাওয়া আর মাঝে মধ্যে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে যোগদান করা ছাড়া তেমন একটা বাড়ির বাইরেই বেরুতেন না মানুষটা। ইজরায়েলীদের সাথে সংঘর্ষে গ্রামের কেউ মারা গেলে প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে যেত তার স্বামীর। বলতেন এভাবে ওদের সাথে সংঘর্ষ করে, মারামারি করে আমরা পারব? এভাবে মরতে থাকলে তো আমাদের ছেলেপুলে সব মারা যাবে। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে দ্বিধাগ্রস্থ বিমর্ষ বদনে বলতেন, আলোচনার মাধ্যমেও তো সমাধান হচ্ছে না কোন কিছু। ইয়াসিন আরাফাতের খুবই ভক্ত ছিলেন আসমার স্বামী। বড় ছেলের নাম রাখেন তাই ইয়াসিন আরাফাত। এসব ভাবতে ভাবতে টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিলেন আসমা। হঠাৎ করে বাহির থেকে কে জানি ইয়াসিনকে ডাক দিল। ইয়াসিন খাবার না খেয়েই দ্রুত বেরিয়ে চলে গেল ঘর থেকে।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে জামাল জলপাই বাগানে চলে এলো। প্রতিদিনই সে স্কুল থেকে এসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে জলপাই বাগানে আসে, জলপাই গাছের যত্ন নেয়। আর কাজ না থাকলে বড় জলপাই গাছটায় উঠে বসে থাকে। গাছে উঠে দূরে তাকালেই দখলদার ইজরায়েলীদের বসতি দেখা যায়। ওখানে মাঠে ইজরায়েলী ছেলেরা বাস্কেট বল খেলছে। জামাল দূর থেকে বসে ওদের খেলা দেখে। অনেক দূর বলে ঠিকমত দেখা যায় না। তারপরও তাকিয়ে থাকে। জামালের ও খুব ইচ্ছে করে বাস্কেট বল খেলতে। কিন্তু ওদের গ্রামে কোন বাস্কেট বল কোর্ট নেই। মাঝে মাঝে জামাল চিন্তা করে, ইস যদি বাবা থাকত তাহলে বাবাকে বলত ওকে একটা বাস্কেট বল খেলার কোর্ট বানিয়ে দিতে। মাঝে মাঝে বাড়ির উঠনেই নিজের ফুটবল দিয়ে বাস্কেট বলের মতো খেলার চেষ্টা করে। মা বলেছে ও যদি ভালো করে লেখাপড়া করে তবে তাকে মিসরে ওর বড় মামার কাছে পাঠিয়ে দিবে। ওখানে গেলে নিশ্চয়ই বাস্কেট বল খেলতে পারবে। জলপাই গাছে বসে বসে জামাল যখন এসব ভাবছিল, হঠাৎ করেই কাছে কোথাও গোলাগুলির শব্দ শুনতে পায় জামাল। গেলাগুলির শব্দ শুনে ভয়ে ও দ্রুত গাছ থেকে নেমে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
একদিন খুব ভোরে ভারী ধাতব শব্দে আসমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। শব্দটা খুব কাছ থেকে আসছে। আসমা তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বের হয়ে দেখতে পায় তাদের জলপাই বাগানে ইজরায়েলী দখলদার বুলডোজার চালাচ্ছে। আসমা দিক বিদিক শূণ্য হয়ে বাগানের দিকে দৌড়াতে থাকে। ছোট ছেলে জামালও মায়ের পিছু পিছু দৌড়ে বাগানের দিকে যায়। আসমা চিৎকার দিয়ে গালাগাল করতে করতে বুলডোজারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দুজন ইজরায়েলী তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। আসমাকে সরাতে ব্যর্থ হয়ে তারা তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মাটিতে থাকা পাথরে ধাক্কা খেয়ে আসমার মাথা ফেটে যায়। ক্রুদ্ধ আসমা মাটি থেকে পাথর তুলে নিয়ে সামনে থাকা এক ইজরায়েলীর দিকে ছুঁড়ে মারে। সাথে সাথে ঐ ইজরায়েলীর মাথা ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। পাশে থাকা আরেকজন রিভলভার বের করে আসমাকে তাক করে দুই রাউন্ড গুলি করে। পাশে দাঁড়িয়ে জামাল এতক্ষণ সব দেখছিল, মাকে গুলি খেয়ে পড়ে যেতে দেখে সে দৌড়ে গিয়ে গুলি করা ইজরায়েলীর হাত থেকে রিভলভার কেড়ে নিতে চেষ্টা করে। দুজনের ধস্তা -ধস্তির এক পর্যায়ে হঠাৎ গুলির শব্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গেই জামালের শরীর নিথর হয়ে যায়। ঘটনার দিন রাতে ইয়াছিন বাড়িতে ছিল না। তাদের এক প্রতিবেশী ইয়াছিনকে খুঁজে বের করে খবর দেয় যে তাদের জলপাই বাগানে দখলদার ইজরাইলীরা আক্রমন করেছে। ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে বাড়িতে এসে ইয়াসিন মা ও ভাইয়ের লাশ দেখতে পায়। হঠাৎ করে ঘটনার আকস্মিকতায় ইয়াসিন একবারে পাথরের মূর্তি হয়ে যায়। মা ও ভাইয়ের লাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সবাই মিলে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল, কোন কিছুই যেন তার কান দিয়ে ঢুকছিল না। সবাই ভাবছিল হয়তো বা ইয়াসিন হাউমাউ করে কাঁদবে কিন্তু ইয়াসিনের চোখ দিয়ে এক ফোঁটাও পানি বেরোয়নি। এভাবে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ করেই দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় ইয়াসিন। কেউ বুঝে উঠার আগেই দৌড়ে কোন দিকে যেন উধাও হয়ে যায় ছেলেটি। অনেক খোঁজাখুজি করেও ইয়াসিনকে না পেয়ে গ্রামের মুরব্বিরা ইয়াসিনকে ছাড়াই ইয়াসিনের মা ও ভাইয়ের লাশ দাফন করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
গ্রামের এ অংশটি একেবারে ধ্বংসস্তুপ বলা যায়। কয়েক বছর আগে ইজরাইলী বাহিনীর হামলার কারণে প্রায় সব ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এ অংশে কোন মানুষজন থাকে না বললেই চলে। একটা বিধ্বস্ত পরিত্যক্ত তিন তলা বাড়ির দোতলায় ইয়াসিন শুয়ে আছে। মন খারাপ হলে সে মাঝে মাঝেই এখানে এসে একাকী শুয়ে থাকত। সারাটা দিন সে চেতন আর অর্ধচেতনের মাঝামাঝি একটা ঘোরের মাঝে ছিল। সন্ধ্যা হতে শুরু করছে, ঠান্ডা বাতাস বইছে। ইয়াসিনের স্নায়ুগুলোও যেন কাজ করতে শুরু করেছে। সে শোয়া থেকে উঠে বসে। সমস্ত পৃথিবীর উপর তার অভিমান ঠিকরে পড়ছে। হঠাৎ করেই মৃত ছোট ভাই আর মায়ের রক্তাক্ত লাশ দুটি ইয়াসিনের চোখের সামনে ভেসে উঠে। বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে ইয়াসিনের। হু হু করে কাঁদতে শুরু করে ইয়াসিন। এরপর তাড়াহুড়ো করে বিধ্বস্ত দোতলা বাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করে ইয়াসিন ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ৮:৪২