somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহামারীর দিনগুলি-৮: ‘দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো’

২২ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৭:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চীনের ঘটনা। মা ছিল ঘরবন্দী। শিশু ছিল বাইরে। কাঁচের ওপার থেকে মাকে দেখে অঝোরে ঝরছিল চোখ। ক্রন্দশী শিশু করোনাক্রান্ত মায়ের দিকে বাতাসে দিয়েছিল আলিঙ্গন। বাতাসে মাখানো সেই আলিঙ্গন দেখে পৃথিবী কেঁদেছে!

এই তো সেদিন, ১লা ফাল্গুনে বন্ধুদের সাথে দেখা। আমরা চীনের জন্য দু:খ করেছি। বাতাসে আলিঙ্গন মিশিয়ে দেয়া মেয়েটির কথা বলেছি। নিজেদের সৌভাগ্যবান বিবেচনা করে বলেছি, ‘ওদের যা বিপদ’! তখনো আমরা জানিনা, আমাদের বেড় দিয়েছে শিকারীর দল।

চীন এখন ঢাকায়। চীন এখন চট্টগ্রামে। চীন এখন কিশোরগঞ্জে।

শহরে, মফস্বলে, গ্রামে মানুষ মরছে। সনাক্ত বা অসনাক্ত। মানুষ মরছে। করোনায় বা ক্ষুধায়। ক্ষুধা সইতে না পেরে গলায় দড়ি দিচ্ছে কিশোরী মেয়ে। সন্তানের ক্ষুধা নিবারণের জন্য মাথার চুল বিক্রি করেছেন মা। তিনি দূর্গাও নন, কালিও নন। মন্ডপে তৈরি হবে না তার মুখাবয়ব। চুল বেচে কোলের শিশুর জন্য দুধের প্যাকেট কিনেছেন মা। আর কিনেছেন দুই কেজি চাল। স্বামী সন্তানের মুখে তুলে দিতে শিউলির মতন সাদা সাদা ভাত।

ভাত! আহারে ভাত! দুই মুঠো ভাতের জন্যে ‘অশনী সংকেত’-এর মতন ভালোবাসার ঘর রেখে হয়তো পালাবে কেউ। ভাতের জন্যে ব্লাউজের বোতাম খুলে দিতে হয়তো কেউ নাম লেখাবে বানিয়াশান্তায়।

মহামারীতে সব বন্ধ। আয় রোজগার নেই। ভারতের একটি গ্রামে ক্ষুধা সইতে না পেরে জঙ্গলে খাদ্য খুঁজতে বেরিয়েছিল কয়েকজন। আর কিছু না পেয়ে তারা ধরে আনলো একটা মস্ত সাপ। নিরন্নের চোখে চাঁদও ‘ঝলসানো রুটি’। বিরাট শরীরের মোটা এক মাংসল সাপ তাই কাবাব হয়ে যায়! কেটে কুটে ঝলসে সেটিকে তারা খুব সুখ করে খেলো। কিন্তু বন্যপ্রাণীর ক্ষতি করা আইনত অপরাধ। তাই, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে কর্তৃপক্ষ।

হে সহৃদয় মানুষ, তুমি কোন পক্ষে যাবে?

‘দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো, কোন পক্ষে যাবে’?

সাপ! হে ভয়ানক সুন্দর! ক্ষমা করো! আর জন্মে তুমি মানুষের পেটে মানুষের বাছা হয়ে জন্ম নিও গো সুন্দর।

মা মনসা, তুমি দয়া করো। এই নিদানের দিনে যে খেয়েছে তোমার সন্তানেরে তারে তুমি খেয়ো না গো।

মা মনসা, তুমি দয়াময়ী, নিজেরে দিয়েছো তুলে আহার করে সন্তানের মুখে। যেমন দিয়েছেন মা, নিজের চুলগুলোরে সন্তানের খাদ্য করে।

রাজারা খাদ্য দেয় না। আইন দেয় শুধু। রাজারা খাদ্য দেয় না। শুধু নীতি কপচায়। তুমি মা, নিজেরে বানিয়ে আহার বাঁচিয়েছে সন্তানেরে। নিশ্চিত জানি, তোমারই মুখে দুধ তুলে দিতে বাজারে মা বিকিয়েছেন চুল।

আইন! ‘দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো, কোন পক্ষে যাবে’?

রাষ্ট্র! ‘দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো, কোন পক্ষে যাবে’?

মানুষ! ‘দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো, কোন পক্ষে যাবে’?

“একদিকে বিত্তবান,
অন্যদিকে বিত্তহীন ক্ষুধার্ত মানুষ ।
একদিকে পূঁজিবাদ,
অন্যদিকে সাম্যবাদী শান্তির সমাজ ।
ইতিহাস সাক্ষী দ্যাখো, অনিবার্য এ লড়াই- কোন পক্ষে যাবে?”

এই মহামারীতেও মওকা পেয়েছে তস্করের দল। চুরির মচ্ছব লেগেছে। দু’পয়সার চোরেরা চাল লুটছে। আর ডাকাতেরা বড় বড় অফিসে বসে পুকুর চুরি করছে। সর্বোচ্চ সুরক্ষাদানকারী মাস্কের নামে ডাক্তার আর সাস্থ্যকর্মীদেরকে ডাকাতেরা ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুকূপে।

সাপ খাওয়া মানুষকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হে পুলিশ, হে আইন, হে রাষ্ট্র, দেখো ‘চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়’।

খদ্দের খুঁজতে মুখে রং মেখে বেরিয়েছে যে রাতের রাণী তার হাতে হাতকড়া পরানোর আগে তাকে কাজ দাও। হোটেল থেকে আটক মেয়েদের ছবির নিচে ‘অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত’ লিখে ফলাও করে পত্রিকায় প্রচার করার আগে, সামাজিক যোগ সাজশে লুটেপুটে নিয়েছে যারা তাদের ছবি প্রচার করো। ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’-এর দায়ে হাতকড়া দেবার আগে সামাজিক কাজ দাও। খাদ্য দাও। ওষুধ দাও। মাথা গুঁজবার ঠাই দাও। নইলে দেখিও না আইন। নইলে দিও না বুলি। লিখো না ‘সব কিছু মনে রাখা হবে’। যদি মনে রাখতে চাও তো ‘নিজেকে প্রশ্ন করো, কোন পক্ষে যাবে’?

“তোমার পিতা একজন চাষা, ক্ষেতে লাঙ্গল চালায়
তোমার পিতা একজন শ্রমিক, মিলে গতর খাটায়
তোমার পিতা একজন মজুর, একজন কর্মচারী
তোমার পিতা একজন পিয়ন, রেল শ্রমিক, কেরানি
তোমার পিতা একজন বাস শ্রমিক, বেশ্যার দালাল
তোমার পিতা একজন স্কুল শিক্ষক, রিক্সাওয়ালা-
তোমার পিতার পাঁজরে তোমরা টার্গেট প্র্যাক্টিস করছো...
দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো- কোন পক্ষে যাবে?”

ভিআইপিদের জন্য আলাদা হাসপাতাল হবে, ঘোষণা এসেছে। সোশাল মিডিয়াতে মানুষ বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করছে। ভারতীয় মুসলিম এক কবির প্রতিবাদী কবিতার পংক্তি তুলে দিয়ে বলছে ‘সব মনে রাখা হবে’। কী মনে রাখা হবে? কবে মনে রাখা হবে? কবে মনে রাখা হয়েছিল? কী মনে রাখা হয়েছিল? একলব্যের আঙুল কর্তিত হয়। দ্রৌনাচার্যরা চিরকাল করেন অর্জুনদের আধিপত্যকে সুসংহত করবার নীতিনির্ধারন। কুরুক্ষেত্রের মাঠে লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার। সেই সব সৈন্যর কথা লেখা থাকে না। ভক্তি ভরে আমরা আজও শুনি কৃষ্ণার্জুনের বীরত্ব গাঁথা।

তেমন দিন কবে আসবে গো মা! যেদিন সন্তানের ক্ষুধা মেটাতে নিজেকে বিছিয়ে রাখতে হবে না জঙ্গলে? তেমন দিন কবে আসবে, যেদিন দুধের শিশুর দুধ জোটাতে বেচতে হবে না তোমার মাথার চুল?

ভোর হয়ে এসেছে। পাখি ডাকছে। প্রশান্ত ভোর। বিপর্যস্ত মন। এই ভোর জানে না, অভুক্ত কত সন্তান আজও ত্রানের জন্য দ্বারে দ্বারে হাত পাতবে। এই ভোর জানে না, পাহারাদারের ছাল পরে বসে আছে কত তস্কর। এই ভোর জানে না, সেই ভোর কবে আসবে যেদিন যেকোনো ‘তন্ত্র’ বলতে ‘মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু’। যেদিন উত্তরে-দক্ষিণে-পুবে-পশ্চিমে তাকিয়ে সুকান্তের কবিতার মতন মানুষ বলবে:
“কারা যেন আজ দুহাতে খুলেছে, ভেঙেছে খিল,
মিছিলে আমরা নিমগ্ন তাই, দোলে মিছিল।”

এই ভোর জানে না, তেমন দিন কবে আসবে যেদিন চুল বেচে দুধ আনা মা পাশের জনকে বলবে, ‘সবাই এসেছে, তুমি আসোনিকো, ডাকে মিছিল’। এই ভোর জানে না, তেমন দিন কবে আসবে যেদিন সমবেত মানুষ দেখবে,

“মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা
মানুষ আসতে আছে ফুলবাডী নাগেশ্বরী থিকা
মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান
মানুষ আসতে আছে মহররমের ধুলার সমান
মানুষ আসতে আছে ছিপ ডিঙি শালতি ভেলায়
মানুষ আসতে আছে লাঠি ভর দিয়া ধুলা পায়
মানুষ আসতে আছে বাচ্চাকাচ্চা-বউ-বিধবা বইন
মানুষ আসতে আছে আচানক বড় বেচইন”।
------
২২/০৪/২০

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৭:১৫
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×