somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহামারীর দিনগুলি-৯: বেছে নিন আপনার পক্ষ

২৪ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৭:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জীবন আর মৃত্যু। মাঝখানে ব্যবধান কতখানি? মৃত্যু কি দৈত্যের রূপ ধরে আসে? সহৃদয় স্বর্গের দূত কি আসে ঐশ্বরিক ডানায় ভর দিয়ে?


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রাণভয়ে ইঁদুরের মত পালিয়ে আছে আনা ফ্রাঙ্কের পরিবার। আনার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিল যেই দেবদূত, তাদের কোনো ডানা ছিল না। আশ্রয়দাতার বাড়ির বর্ধিতাংশে তারা লুকিয়েছিল। অবিশ্বাসের দিনগুলোতে।


আনাদের জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে ছিল একটা বইয়ের তাক। আশ্রিতদের দরজাটা আড়াল করতে নেয়া হয়েছিল বুকশেলফের কৌশল। অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। তারা ধরা পড়েছিল। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দুয়ারে দাঁড়িয়েছিল যে যমদূত, দেখতে সেও ছিল মানুষেরই মত।


অবিশ্বাস ও দ্বিধায় ভরা দিন। এমন দিনেই আসে বেছে নেবার প্রশ্ন। কেউ আশ্রয় দেয়। কেউ গোপনে শত্রু শিবিরে পৌঁছে দেয় আশ্রিতের খবর। একই ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। ঘটেছে ৪৭-এ, ৭১-এ।


চয়েস। বেছে নেবার স্বাধীনতা।


ঈশ্বরের দায়মুক্তিও এখানে। বেছে নেবার স্বাধীনতা দিয়ে ঈশ্বর পেয়েছেন ইনডেমনিটি। সকল দায় পাপিষ্ঠের। প্রভু দিয়েছেন বেছে নেবার স্বাধীনতা। শিকারীর হাতে দিয়েছেন ছুরি। সামনে দিয়েছেন শিকার। দিয়েছেন স্বর্গ ও নরক। দিয়েছেন সংবিধান। চয়েস আপনা-আপনা। যার যার মনপছন্দ।


‘নোয়াহ’ সিনেমাটা মজার। ছুরি হাতে উন্মত্ত নোয়াহ। খুনের নেশায় অপ্রতিরোধ্য। হাতে খঞ্জর। সামনে দূর্বল শিকার। তার হাতেই জীবন, মরণ। কোনটাকে বেছে নেবে সে? কোনদিকে হৃদয়ের ইশারা?


ইবলিশের কাহিনীটাও বেছে নেবার। বেছে নেবার আগে আছে আরেকপক্ষের ‘ব্রিচ অফ কমিটমেন্ট’। কথা দিয়ে রাখেননি মালিক। নব প্রেমের দিকে ঝুঁকেছেন। ভঙ্গ করেছেন অঙ্গিকার। চয়েস ম্যাটার্স। চুক্তিনামা ভেঙ্গে পড়লে থাকে শুধু আত্মসমর্পণ অথবা বিদ্রোহ। দুনিয়াবী মালিকেরাও একই রকম। প্রশ্নকারীর জন্য নির্ধারিত অনিবার্য পতন।


তবু, চয়েস ম্যাটার্স। ইচ্ছের ডানা স্বর্গীয় পাখার চেয়েও শক্তিমান। তেমনটিই ঘটে ‘উইংস অফ ডিজায়ার’ সিনেমায়। মর্তের দরিদ্র নারীর প্রেমে পড়ে মানুষের জীবনের স্বাদ নিতে তার খুব সাধ হয়। সে স্বর্গীয় দূত। আছে ঐশ্বরিক ডানা। হায় প্রেম! ডান খসিয়ে মানবীয় ভঙ্গুরতা বেছে নেয় দেবদূত। কৃষ্ণ মেয়ের প্রেমের জেরে পরিবার পরিত্যাগ করে যায় আধুনিক রাজারকুমার।


চয়েস ম্যাটার্স।


চয়েসই মানুষে মানুষে গড়ে দেয় মূল ফারাক। সে কথাই বলা হচ্ছে
‘পরমের সাথে কথোপকথন-১: সাধু ও শয়তান’ কবিতায়। আমার চতুর্থ বইয়ে থাকা কবিতার আলাপচারিতাটা এরকম:


“—সাধু কে?
—যিনি জানেন পৃথিবীতে পাপ-পূণ্য বলে কিছু নেই।

—শয়তান কে?
—যিনি জানেন পৃথিবীতে পাপ-পূণ্য বলে কিছু নেই।

—সাধু ও শয়তানে তবে ফারাক কোথায়?!
—ফারাক কি হয় জানায়? না। তা নয়।
ফারাক রচিত হয় কর্ম-চিন্তায়।

পাপ-পূণ্য নেই জেনেও যিনি ন্যায় মনে চলেন তিনিই সাধু
আর পাপ-পূণ্য নেই জেনে যিনি ক্রুর হেসে
ধুন্দুমার উড়িয়ে চলেন বিজয় কেতন তিনিই শয়তান।”


নায়ক ও খলনায়ক হতে পারে একই গুরুর শিষ্য। হতে পারে একই পথের যাত্রী। নায়ক ও খলনায়ক উভয়ই মারতে ও মরতে প্রস্তুত। উভয়ই সাহসী। তবু, নায়ক কেন খলনায়ক নয়? খলনায়ক কেন নয় নায়ক? কারণ তাদের চয়েস। নায়ক মরতে ও মারতে প্রস্তুত অন্যের কল্যাণার্থে। তাই, ডাকাত হয়েও দয়ার সাগর রবিনহুড।


জীবনে পক্ষ বেছে নেয়ার প্রসঙ্গ আসে। সময়ে সময়ে আসে বেছে নেবার জরুরত। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের মানুষ বেছে নিয়েছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে রাজায় রাজায় ভাগ হয়ে পাণ্ডব ও কৌরব পক্ষে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে যোগ দিয়েছিল রথি ও মহারথীরা। বাংলার মানুষ পক্ষ বেছে নিয়েছিল ১৯৭১-এ।


বেছে নেবার সময় আসে। এই মহামারীকালে পৃথিবীর বিভক্তি প্রকট হয়েছে। পৃথিবীর সব দেশে বিভক্তি স্পষ্ট। একপক্ষে, মানুষের ক্ষুধার্ত মুখ, রোগাক্রান্ত জীর্ন শরীর। আরেক পক্ষে, অনিয়ন্ত্রিত পুঁজি ও মুনাফালোভী সমাজ ব্যবস্থা।


রাষ্ট্রের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে কর্পোরেশান্স। রাষ্ট্রের মাথায় জনতার কল্যাণের চেয়েও ‘তন্ত্র’ বড় হয়ে ওঠেছে। এখনি সময়।


“গোল হয়ে আসুন সকলে,
ঘন হয়ে আসুন সকলে,
আমার মিনতি আজ স্থির হয়ে বসুন সকলে”।


অভাবের তাড়নায় যে মা চুল বেচে দুধ কিনে আনছেন, তার ঘরে কেন দুধ নেই, কেন তার শিশুর খাদ্য জোটাতে বিক্রি করতে হলো চুল, আসুন এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবি। করোনার কারণে চুল বেচে দুধ কেনার যে খবর বেরিয়েছিল গণমাধ্যমে তা সত্য নয় বলে দাবী করেছে কর্তৃপক্ষ। সত্য উদঘাটনকারীরা বলছেন, করোনাজনিত অভাব শুরু হবার আগেই মা চুল বেচেছিল। দুধ কিনেছিল।


আসুন, আজ এক্ষণে স্থির হয়ে বসি। ভাবি। কেন এক মায়ের ঘরে দুধ নেই। শিশুর জন্য দুধ কেনার দায় কার? অভুক্ত শিশুর জন্য কার কাছে দুধ চাইবে মা?


বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন নয়াচীনে। ১৯৫২ সালে। তখন তিনি ৩২ বছর বয়সের টগবগে তরুণ। নয়াচীনের কল-কারখানা-কৃষি-সমাজ-শ্রমিক-সরকার-ব্যবস্থা পরিদর্শন করে লিখেছিলেন ভ্রমণকাহিনী। কাহিনীতে তিনি লিখেছেন: "না খেয়ে থাকতে থাকতে একদিন ব্যারাম হয়ে মারা যায়। আমরা বলি অসুখ হয়ে মারা গেছে। কিন্তু না খেতে না খেতে যে ব্যারাম হয়, তারপর মারা যায়, একথা আমাদের দেশে বলে না। কারণ সরকারের থেকে খবর নিলে জানা যায় যে, না খেয়ে মরে নাই, ব্যারাম হয়ে মারা গেছে। যদি কেউ না খেয়ে মরার খবর দেয় তবে তার কৈফিয়ত দিতে কাজ সারা হয়ে যায়। আর যদি কোনো খবরের কাগজে প্রকাশ হয়, তবে কাগজআলার কাগজটা দেশের নিরাপত্তার নামে বন্ধ করে দেওয়া হয়। [...] আমাদের দেশে মানুষ না খেয়ে মারা গিয়েছে এই খবরটা বন্ধ করার জন্য অথবা প্রতিবাদ করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা হয়। নয়াচীনে এরকম খবর রটলে সরকার এর খোঁজ নেয় কী জন্য লোকটা মারা গেছে। কতদিন না খেয়ে ছিল। জমিজমা কী পরিমাণ আছে? এইরকম ঘটনা যেন আর ভবিষ্যতে না হয়। এই না খেয়ে মরার জন্য লোকাল কর্মচারীদের কৈফিয়ত দিতে হয়, আর আমাদের দেশে এই ঘটনা প্রকাশ হওয়ার জন্য কৈফিয়ত দিতে হয়। [...] লোকে না খেয়ে মরছে না, মরছে পুষ্টির অভাবে। পুষ্টির অভাব হয় কেন? এই কৈফিয়ত কে জিজ্ঞাসা করে?”


আজ আর কারো কাছে কৈফিয়ত চাওয়ার নেই। আজ নিজেদেরই কৈফিয়ত দেওয়ার দিন। দেশ আপনার। কৈফিয়তও আপনিই দেবেন।


দরিদ্র মায়ের ঘরে জন্ম নেয়া শিশুর খাদ্য কেন জুটছে না? কেন তাকে বেচতে হচ্ছে মাথার চুল? নিরন্নের ঘরে খাদ্য জোগাতে আপনি কী করেছেন? অচলায়তনকে টিকে থাকতে বা ভাঙতে আপনার অবদান কতটুকু?


মহামারীতে পৃথিবীর দেশে দেশে হাজারে-হাজার মানুষ মরছে। পৃথিবীর দেশে দেশে অসুস্থ মানুষের পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মত জেগে আছে চিকিৎসাকর্মীরা। আর এই দেশে জেলায়-জেলায় বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা অঘোষিতভাবে বন্ধ। কেন সাধারণ রোগীরা হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মরছে? কেন নকল মাস্ক দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর সৈনিক চিকিৎসকদের পাঠানো হয়েছে করোনা চিকিৎসায়? কেন স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবনকে করা হয়েছে বিপন্ন? এই মহামারীরকালে খেতে না পেয়ে গলায় দড়ি দিচ্ছে অবোধ কিশোরী। অথচ এই নিদানেও ত্রানের চাল চুরি করে তস্কর। কোনো ব্যবস্থা একদিনে ক্ষয়ে যায় না। একদিনে বদলে যায় না। কোনো অচলায়তন একদিনে তৈরি হয় না, একদিনে কাটেও না।


“গোল হয়ে আসুন সকলে
ঘন হযে আসুন সকলে
আমার মিনতি আজ স্থির হয়ে বসুন সকলে”।


মানুষের এই চরম দুর্দিনে কাউকে দোষারোপ নয়, এখন নিজেদেরই কৈফিয়ত দেবার পালা। এখন নিজেদেরই চয়েস করার পালা। বেছে নিতে হবে পক্ষ। মানুষের মুক্তি অথবা শোষণ। বেছে নিতে হবে স্বর্গীয় ডানা অথবা পতন।

-----
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৫:৫১
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×