''না না না! আপনারা যে যেভাবেই বলুন বর্তমান সভ্যতায় বাংগালী নারীর শাড়ি, কোন ভাবেই অখন্ড কোন স্বত্ত্বা তো নয়-ই বরং এর সাথে অনিবার্য অনুষঙ্গ হল ব্লাউজ আর পেটিকোট''-বলেই একটা বিদ্রুপাত্মক হাঁসি হাঁসি হাসেন রজব আলী! রজব আলী মূলত এটা মানতেই নারাজ যে, বাংগালী নারী কোনদিন ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরিধান করেছিল। তার এহেন আজগুবি মন্তব্যে পুরোদস্তুর বিরক্ত হারাধন মন্ডল। রজব আলী লোকটাকে তার খুব একটা পছন্দ নয়, শুধু বন্ধু সংঘে আসতে হয় বিধায় দাঁতে দাঁত চেপে তাকে তিনি সহ্য করে চলেছেন আজ কয়েক বছর। রজব আলীর দিকে না তাকিয়ে গমগমা গলায় বলে উঠেন হারাধন, আরে ভাই! আদি কালে পুরো ভারতবর্ষে সেলাই করা কাপড় পরবার রেওয়াজ ছিল না, তখন লোকেরা সেলাই বিহীন পোষাক-ই পরিধান করত আর এই সেলাইবিহিন অখন্ড বস্ত্র পুরুষের ক্ষেত্রে ‘ধুতি’ এবং মেয়েদের বেলায় ‘শাড়ি’ নামে অভিহিত হত। এত সাধারন বিষয়টা আপনারা কেনো বুঝে উঠছেন না, সেটা আমার মাথাতে কোনভাবেই প্রবেশ করছে না। পরবর্তীতে বয়ন শিল্পের বিকাশ ঘটে, দেশ ভাগ হয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়, সভ্যতার বিকাশ ঘটে তথাপী বাংগালী জাতি বিশেষত নারীরা আর ব্লাউজ গায়ে দিতে পারেনি। দেবেই বা কি করে তখনো তো এই অঞ্চলে তৈরি পোষাক শিল্প গড়ে ওঠেনি! বাংলাদেশে পোষাক শিল্প বিকশিত হল, তারপরেই না নারীদের গায়ে ব্লাউজ উঠল। যত্তসব উদ্ভট মানুষ দিয়া ক্লাবটাকে তো ভরায়া ফালাইছেন!
হারাধনের কথা শেষ হওয়া মাত্র, তাকে সমর্থন দিয়ে তার বিশেষ অনুগত সকাল-সন্ধ্যা অপেরার নাইকা ময়ুরী পুরো হাউসে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, এখন বলেন তাহলে! এই বেলাউস (ব্লাউজ) আপনাদের কে দিয়েছে?
ময়ুরীর লাল টকটকা স্লিভলেস ব্লাউজে চকচকা দৃষ্টি নিবন্ধন রেখে রজব আলী বলে বসে, মাননীয় স্পীকার আমি আবারো স্পীকার হয়ে গেলুম।
বন্ধু আড্ডায় সাহিত্য বিশারদ হিসেবে খ্যাত অভিনাশ পাল মনে মনে প্রমোদ গোনেন। ময়ুরীর প্রশ্নটা বড্ড জটিল! বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডে নারীত্বের এমন সব জটিল প্রশ্নের উত্তর তাকে ভীষন রকম ভাবিয়ে তোলে, আর তাই শেষ পর্যন্ত কোন নারীর সাথে সাত পাকে বাঁধা তার আর হয়ে ওঠেনি বরং নিজেকে সারাটা জীবন সাহিত্য রস আস্বাদনে ব্যাস্ত রেখেছেন। একজন সাহত্যিক হিসেবে ব্লাউজ সংক্রান্ত এই মজমায় তার কিছু একটা বলা দরকার, নচেৎ উহা যে বাংলা সাহিত্যেরই অবমাননা বলে বিবেচিত হইবে! ঈষৎ চোরের ন্যায় ইদিক-উদিক চেয়ে তিনি বলা শুরু করলেন, দেখুন! গুপ্ত যুগের কবি কালীদাস তার ‘কুমারসম্ভব’- এ নারীর যে শাড়ির কথা বর্ননা করেছেন আর চৌদ্দ শতকে কবি চণ্ডীদাস ‘নীল শাড়ি মোহনকারী/উছলিতে দেখি পাশ’- এ যে শাড়ির বর্ননা করেছেন তাতে উভয়েই কিন্তু ব্লাউজের উপস্থিত কোনভাবেই ছিলনা। আর এই ব্লাউজের উপস্থিতি না থাকবার কারনেই তো ‘আক্কেল গুড়ুম’-এ রাজকুমার চন্দ্র লিখেছিলেন, ‘দশ হাত কাপড়ে স্ত্রীলোক লেংটা’ আর তার সাথে সুর মিলিয়ে আমাদের ঠাকুরবাড়ির ছেলে সত্যেনও বলেছিলেন, ‘আমাদের স্ত্রীলোকেরা যেরূপ কাপড় পরে, তাহা না পরিলেও হয়।’ সূতারাং আপনাদের বাদানুবাদের কোন হেতু তো আমি দেখছি না! সমাধান একেবারে হাতের নাগালেই।
উভয়ের বাক-বিতন্ডা যখন তুংগে তখন বন্ধু সংঘের কবি বলে খ্যাত কবি হাসনাইন আলম এগিয়ে এসে বলেন,
এই যে ভায়েরা!
হাত থাকতে মুখে কি?
আর যদি হাতে না পারেন, তবে আসেন ব্লাউজ নিয়ে আজ হতে বছর বিশেক আগে আমার লেখা কবিতা খানা শুনেন!
উপস্থিত সকলে মারহাবা মারহাবা রব তোলে!
কবি হাসনাইন শুরু করলেন,
"বারো হাত শাড়িতে,
সাড়ে তিন হাত নারী!
নারী তুমি
আহা তুমি নারী।"
কবিকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়ে ময়ুরী জিজ্ঞেস করলেন, ঐ মিয়া এইটা বেলাউস নিয়া কবিতা ক্যামনে? কবিতায় তো বেলাউস নাই। কবির তথা কাব্যের এহেন অপমানকে কবি হাসনাইন ঠিক ভালো ভাবে নিতে পারলেন না, বিজ্ঞের মত তিনি বলে বসলেন- আপনে কবিতার বা...ডা বোঝেন! বিশ বছর আগে তো বেলাউস আছিল না খালা! এটা একটা বেলাউস নাই কবিতা! বেলাউস নাই কবিতায় বেলাউস থাকলে ঐডা ক্যামনে বেলাউস নাই কবিতা হয়?
সম্মানিত উপস্থিতি পূনরায় মারহাবা মারহাবা রব তুলে কবি ও তার কবিত্বের প্রশংসা করলেন সত্য কিন্তু মারহাবা না বলে গভীর চিন্তায় রত যে লোকটা ছিলেন সে হল মোঃ ইলিয়াস আলী। আরে মিয়ারা থামেন! - বলে সকলকে থামিয়ে দিয়ে সে বলে ওঠে, কথা তো সেটা না, এখানে প্রশ্ন হলো শাড়ির সাথে ব্লাউজ পরিধান না করলে নারীরা তবে কি পরিধান করত? যার উত্তর আপনারা খোজেন নাই কেউ, কিন্তু অনেক বিশ্লেষন আর গবেষনা করে আমিই একমাত্র সেটা আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছি। সকলে সমস্বরে জিজ্ঞেস করে- কি? ইলিয়াস আলী ছোট্ট করে উত্তর করে, ব্রেসিয়ার! ইলিয়াস আলীর উত্তরে সকলের মুখে বিব্রতির ছাপ পরিলক্ষিত হলেও ময়ুরী রীতিমত জোড়ালো সমর্থন দিয়ে বলে, আমারো তাই মনে হয় ইলিয়াস ভাই! বেলাউস পূর্ববর্তী যুগে ব্রা আর শাড়ির দারুন একটা কম্বিনেশ ছিল। ইস! কি ফ্যাশনেবল ছিল সেই দিন গুলো।
বন্ধু সংঘের পাহারাদার তোরাব আলী হাঁপাতে হাঁপাতে এসে, বাজারে সেনাবাহিনী ঢুকেছে মর্মে খবর দিয়ে চলে যায়। ছোট ক্লাব ঘরটায় রীতিমত ছুটাছুটি শুরু হয়ে যায়। যে যার মত পালাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। ঘরের এক চিপায় দাঁড়িয়ে অস্ফুট স্বরে হারাধনকে বলতে শোনা যায়, গাঁজার কলগুলো লুকিয়ে রেখে যা রে শালারা! নাহলে পরে আবার পয়সা দিয়ে কিনতে হবে।
(ব্লাউজ সংক্রান্ত এই স্যাটায়ারে কোন ভাবেই নারীত্বের অবমাননা সংক্রান্ত কোন প্রচেষ্ঠা করা হয় নাই! 'ব্লাউজ' এখানে রুপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে এবং স্থান, কাল, পাত্র সকল কিছুই কাল্পনিক। তথাপি লেখার বিষয়বস্তু কাউকে কষ্ট প্রদান করে থাকলে আমি আন্তরিক দুঃখিত! ছবি- নেট হতে সংগৃহিত!)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:৫৩