‘কবিতা’র সম্পাদক কবি ফরীদ আহমদ রেজার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কবিতাপাঠ, আড্ডা ও কবিতাপত্রের প্রকাশনা-উত্তর মূল আলোচনা উপস্থাপনা করেন সাংবাদিক-সাহিত্যিক কবি মনজুরুল আজিম পলাশ। অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন সম্প্রতি অন্যন্যা সাহিত্য পুরষ্কারে ভূষিত কথাশিল্পী সালেহা চৌধুরী, বর্ষিয়ান সাহিত্যিক কবি অমরনাথ চক্রবর্তী, লেখক-সাংবাদিক ইসহাক কাজল এবং সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরী।
অনুষ্ঠানের শুরুতে উপস্থিত কবিদের স্বাগত জানিয়ে ‘কবিতা’র সম্পাদক ফরীদ আহমদ রেজা বলেন, যারা কবিতা লেখেন তারা সাধারণ কেউ নন। অনুকুরণ করে কবিতা লেখে প্রকৃতি কবি হওয়া যায় না। কবিতা একধরনের দর্শনও। কারণ, কবিরা গভীরভাবে ভেবে নতুন কিছু উপস্থাপন করেন। কবির উপস্থাপনে যদি অভিনত্ব থাকে তিনিই এক সময় বিখ্যাত হন। তিনি উপস্থিত সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে চৈত্র সংক্রান্তি এবং পহেলা বৈশাখকে আমাদের ঐতিহ্য বলে অভিহিত করেন বলেন, কবিরা সমাজের সম্মানিত লোক। সেলিব্রেটিদের মানুষ আগ্রহ নিয়ে জটলা পাকিয়ে দেখে, তারপর ভুলে যায়। কিন্তু কবিদের কবিতা মানুষের মনে চিরজাগরুক থাকে। তিনি বলেন, কবিরা হলেন মানবতাবাদী এবং সকল ফ্যাসিবাদ-বর্ণবাদ বিরোধী। তারপরও নজরুলের মতো কেউ নারীর সমাধিকারের বিষয়ে সোচ্চার হননি। অধিকাংশই নারীকে আনন্দ সামগ্রী হিসেবে চিত্রিত করেছেন। কবিতা মানুষকে মহৎ করে।
অনুষ্ঠানের মূল আলোচক, শিল্প ও সাহিত্য বিষয়ে বিজ্ঞ-সমালোচক কবি মনজুরুল আজিম পলাশ বলেন, শুরুতেই বলে নেয়া ভালো যে, এটি কোনো প্রধান আলোচনা নয়, কেবল পাঠের অনুভূতি আপনাদের সঙ্গে শিয়ার করে নিচ্ছি মাত্র। প্রথমেই বলবো যে, এ ধরণের সাহিত্য আড্ডা চমৎকার - যতো বেশি হয় তত বেশি আমাদের আত্মা খোরাক পায় এবং কবিতাপত্রের ৪র্থ সংখ্যা নিয়ে আমরা এক ধরনের উদযাপনও করতে যাচ্ছি। তবে, নিয়মিত হোক আর অনিয়মিত হোক বলতে গেলে বৃটেনে লিটল ম্যাগ দিন দিন ভালো একটি জায়গায় অবস্থান নেয়ার প্রস্তুতি পর্ব সমাপন করে নিচ্ছে। কবিতাপত্র ৪র্থ সংখ্যা বেশ বিরতী দিয়েই বের হলো। ছোটকাগজের জন্য অনিয়মিত কোনো বিষয় নয়, এই অনিয়মের জন্য যারা চাপে ভোগেন তাদের জন্য সংবাদ হলো, ৫০ বছরের দীর্ঘ বিরতী নিয়েও বৃটেনের মূলধারার লিটেল ম্যাগ বের হবার নজির রয়েছে এবং এই বিরতীর কারণ হচ্ছে, দীর্ঘ ৫০ বছরের মধ্যে কোনো ভালো লেখা তারা পান নাই। এটাই সম্ভবত পৃথিবীতে লিটেল ম্যাগের সবচে দীর্ঘ বিরতী নিয়ে বের হওয়া কাগজ। অতএব কবিতা পত্রের বিরতীর জন্য কারোর চাপে না ভোগলেও চলবে। তিনি বলেন, ছোট কাগজের সবচে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সম্পাদকীয়। সব কিছুর পূর্বে সম্পাদকীয়ই পাঠ করতে চেষ্টা করেন পাঠক। সম্পাদকীয়’র মধ্যদিয়ে কিন্তু লিটেল ম্যাগের তাত্ত্বিক অবস্থান অথবা রাজনৈতিক কিংবা দার্শনিক বা সাহিত্যিক অবস্থানটি প্রকাশ পায়। ফরীদ আহমদ রেজা তার পর্যবেক্ষণ সম্পাদকীয়তেই প্রতিফলিত হয়েছে।
মনজুরুল আজিম পলাশ বলেন, আসলে একটি কাগজের সম্পাদক খুব বেশি কাজ করেন না কিন্তু অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট আবার গুরুত্বপূর্ণ কাজটাই তিনি করে থাকেন। ফরীদ আহমদ রেজা সেইসব গুচ্ছ কবিতার গুরুত্বের কারণটি উল্লেখ করে দিয়েছেন সংক্ষিপ্ত বর্ণনার মাধ্যমে। এতে লেখক ও লেখা চিনতে পারা সহায়কের ভূমিকা রাখে। এই পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এর পূর্বেও তার বিভিন্ন লেখায় আমরা লক্ষ্য করেছি। রেজা ভাইয়ের কিন্তু মারাত্মক পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা রয়েছে, এই অনুভূতিটা আপনাদের সঙ্গে শিয়ার করতে চাই। উল্লেখ্য যে, একবার রেণু আপা সম্পর্কে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়ে একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছিলেন। রেণু আপার সঙ্গে একবার ড্রাইভে লক্ষ্য করলাম, তিনি শাড়ি পড়ে ড্রাইভ করছেন। যখনই একটি ইউ টার্ন দিলেন তখনই রেজা ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। শাড়ি হলো প্রাচ্য আর ইউটার্ন হলো পাশ্চাত্য। মনজুরুল আজিম পলাশ একইভাবে উল্লেখ করেন, এভাবে এই সংখ্যায় আমরা কবি মুজাহিদ শরীফকেও আবিষ্কার করি। সোয়ান্স পয়েমস শিরোনামে তার গুচ্ছ কবিতার সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও তুলে ধরেছেন সম্পাদক। এই কবির উল্লেখযোগ্য অংশ এভাবেই আমাকে ভাবায়Ñ যেনো আমার অপার পৃথিবী/ সহস্র আলোক-বর্ষ জুড়ে/ গ্লানি-প্রেম-ইতিহাসে-ক্রীড়াময়/ যেনো আমি শূন্যতর এক জীবনের শেষে/ এক নিসঙ্গতর দিনের শেষে/ আজন্ম মাধুকরী ...। তিনি বলেন, বিলেতের বাঙালি কবিদের নিয়ে এর পূর্বেও ফরীদ আহমদ রেজা ‘কবিতার পাঁচ রাজপুত্র’ শির্ষক নিবন্ধের মাধ্যমে নিজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত তুলে ধরেছেন। তবে এই সংখ্যাটিতে যথেষ্ট বানান ভুল পাঠককে অনেক বিরক্ত দেবে। চমৎকার একটি প্রচ্ছদের ভেতর কবিতাপত্র ৪র্থ সংখ্যায় অনেক সমৃদ্ধ লেখাও রয়েছে।
মনজুরুল আজিম পলাশ বলেন, আড্ডার মাধ্যমেই অনেক বড় কাজের নজির রয়েছে এবং লিটল ম্যাগ আন্দোলন এখন খুবই ভালো পর্যায়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গল্প, প্রবন্ধের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ান কবিতার অনুবাদসহ বিশ্ব সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কিছু অনুবাদকর্ম এ সংখ্যার প্রকাশনায় স্থান পাওয়ায় ভালো লাগছে। তিনি বিভিন্ন লেখকের লেখার আলাদা আলাদা মূল্যায়নের পাশাপাশি বিলেতের কবিদের সম্পর্কে বলেন, এখানকার বাঙালি কবিরা নিভৃতচারী অথচ বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
‘কবিতা’র নিয়মিত লেখক, কবি ও কথাশিল্পী সালেহা চৌধুরী প্রচ্ছদসহ সন্নিবেশিত সকল বিষয়ের পর্যালোচনা করেন। তিনি ১/২ বছর পরপর এধরনের একটি উন্নতমানের সাহিতিত্যের কাগজ উপহার দেয়ার জন্য সম্পাদককে ধন্যবাদ জানান। তার আলোচনায় ‘কবিতা’ ছাড়াও বিলেত থেকে প্রকাশিত ‘শব্দপাঠ’ এবং ‘ভূমিজ’সহ বিভিন্ন সমৃদ্ধ প্রকাশনার উল্লেখ করেন।
বর্ষিয়ান লেখক, কবি অমরনাথ চক্রবর্তী আয়োজন সম্পর্কে তার উৎফুল্লের কথা জানিয়ে বলেন, আমি এধরনের অনুষ্ঠানে আসি জীবন লাভ করতে। এক সময় বিপ্লবী রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার স্মৃতিচারণের অবতারণ করে অমরনাথ চক্রবর্তী আরো বলেন, বাংলাদেশের কবিরা ক্রমশ তাদের স্বতঃস্ফূর্ত পরিচয় তুলে ধরতে সমর্থ হচ্ছেন। তারা সমকালিন নানা সমস্যা সত্ত্বেও তার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তিনি ‘কবিত’র এসংখ্যার লেখকদের সম্পর্কে বলেন, তাদের লেখায়ও এধরনের যোগ্যতার পরিচয় বহন করছে। তিনি উপস্থিত কবিদের কবিতা পাঠ এবং আবৃত্তি শুনে তার মুগ্ধতার কথা জানিয়ে নিজেও স্মৃতি থেকে একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনান।
লেখক-সাংবাদিক ইসহাক কাজল এ সংখ্যায় পরিচিত পুরনো অনেক লেখকদের লেখা দেখে তার আনন্দ প্রকাশ করেন। তিনি ত্রিশ দশকের কবি বিষ্ণু দে’র বিখ্যাত ক’টি কবিতর লাইনের উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেন, কবিতা মানুষের কথা বলে। কবিতা মানুষের জন্য, রোবট দিয়ে কবিতা হবে না। তিনি ফরাসীসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত কবিদের জীবন এবং সংগ্রামের দিকে ইঙ্গিত করেন নিজেকে রাজনৈতিক অঙ্গনের লোক দাবী করে বলেন, কবিদের সাহচর্য ভালো লাগে। তিনি সিলেটের ৬০ দশকের কিছু উল্লেখযোগ্য লেখকদের নাম উল্লেখ করে আগামীতে তাদের লেখা নিয়ে একটি সংখ্যা করার জন্য সম্পাদকের প্রতি অনুরোধ জানান।
সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরী তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এবারের বইমেলায় প্রকাশিত প্রবাসী লেখকদের নিয়ে একটি সমৃদ্ধ সাময়িকী প্রকাশের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
‘কবিতা’র প্রচ্ছদ শিল্পী মেহেদী হাসান সুমন উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে প্রচ্ছদ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। নববর্ষ বিষয়ে একটি কবিয়ালগাঁথা পড়ে শোনান কবি মুজিবুল হক মনি এবং আবৃত্তি করেন কবি মাজেদ বিশ্বাস।
কবি তাবাসসুম ফেরদৌসের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠিত আড্ডায় কবিদের মধ্যে স্বরচিত কবিতা পাঠে অংশ নেন আতাউর রহমান মিলাদ, কাইয়ুম আবদুল্লাহ, শাহ শামীম আহমেদ, আবু মকসুদ, ফসল আইয়ুব, শাহনাজ সুলতানা, কাজর রশীদ, তাবাসসুম ফেরদৌস, আহমদ ময়েজ, সৈয়দ রুম্মান, শাহ সোহেল, মুহাম্মদ শরীফুজ্জামান প্রমুখ।
সাপ্তাহিক পত্রিকার সৌজন্যে