বাংলাদেশ, এক রহস্যময় ভূখণ্ড, যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূলসূত্রেই রয়েছে ঐক্য। কিন্তু এই ঐক্যের স্থায়িত্ব কতটুকু? ইতিহাস বারবার আমাদের দেখিয়েছে, এদেশে ঐক্য প্রায়শই স্বার্থসিদ্ধির একটি কৌশল। স্বার্থ পূরণ হয়ে গেলে, ঐক্যের সেই দৃঢ় ভিত্তি ধসে পড়তে সময় লাগে না।
ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ একটি সর্বজনীন ঐক্যের অনন্য নিদর্শন। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর মতবিরোধ ঐক্য ভেঙে দেয়। একইভাবে ১৯৯০-এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বৃহত্তর ঐক্য দেখা গেলেও, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর বিভেদের শুরুর ইতিহাস সবাই জানি।
স্বার্থকে কেন্দ্র করে ঐক্য
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুগে যুগে সাময়িক ঐক্যের পেছনে একটি বিশেষ ধারা কাজ করেছে। যখনই জাতীয় স্বার্থের বিষয় ওঠে, তখন নেতা-নেত্রীরা ঐক্যের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে তা বেশিরভাগ সময়ই থাকে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত লাভ নিশ্চিত করার জন্য। দলীয় রাজনীতি, কর্পোরেট স্বার্থ এবং প্রভাবশালী শক্তিগুলোর ছত্রছায়ায় এই ঐক্যগুলো জন্ম নেয় এবং ভেঙে যায়।
সামাজিক এবং ধর্মীয় পরিমণ্ডলেও একই প্রবণতা
শুধু রাজনীতি নয়, সামাজিক এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রেও এই ব-দ্বীপে ঐক্য টিকে থাকে সাময়িক স্বার্থ মেটানোর জন্য। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় কিংবা অন্য কোনো বিপর্যয়ের সময় আমরা ঐক্যের একটি আদর্শ চিত্র দেখি, কিন্তু সংকট কাটিয়ে উঠলে আবার বিভক্তির চাকা ঘুরতে শুরু করে।
সমস্যার কারণ
এই সমস্যার মূলে রয়েছে নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাব এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক মানসিকতা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কোনো নেতা বা গোষ্ঠী দেখা যায়নি যারা দীর্ঘমেয়াদে সার্বিক জাতীয় ঐক্য স্থাপন করতে পেরেছেন। রাজনীতিবিদদের অপরিপক্বতা, আমজনতার অসচেতনতা, এবং বাহ্যিক প্রভাব এই চক্রকে অনবরত চালিয়ে যাচ্ছে।
ঐক্যের স্থায়িত্বকাল স্বার্থসিদ্ধির আগ পর্যন্ত একটি অপ্রিয় সত্য যা এদেশের ইতিহাসে ঘুরেফিরে আসছে। তবে, এই বাস্তবতাকে অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজন সমষ্টিগত সচেতনতা, জাতীয় ঐক্যের জন্য নিরপেক্ষ নেতৃত্ব এবং একটি দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার মধ্যেই রয়েছে সমস্যার সমাধান। অন্যথায়, এই ব-দ্বীপে ঐক্যের এমন ক্ষণস্থায়ী চিত্র দেখে যেতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২১