somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একাত্তরের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে খালেদা জিয়ার ‘একাডেমিক’ আগ্রহ

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত ২১শে ডিসেম্বর বিএনপি সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে ৭১-এর শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলছেন ঠিক কত লাখ শহীদ হয়েছে সেই নিয়ে বিতর্ক আছে। খালেদা জিয়া যে মতাদর্শের রাজনীতি করেন তাতে ৭১- এর শহীদের সংখ্যা তো বটেই, শহীদের ‘সংজ্ঞা’ নিয়েও তাঁর মনে সন্দেহ থাকা স্বাভাবিক। যেমন আমাদের বড় ভাই শৈবাল চৌধূরী (চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্রের পরিচালক)। একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল সাত আট বছর। সে সময়ে শৈবালদার বাবা মা ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে ভারতে চলে যান। যুদ্ধ শেষে তাঁরা নিজেদের বসত বাটিতে ফেরত আসেন বটে, তবে আটজনের বদলে ফেরত আসেন তিনজন। শৈবালদার পাঁচ ভাই বোনই ভারতের শরণার্থী শিবিরে কলেরায় মারা যায়। এই ৫টি হিন্দু শিশুকে কি খালেদা জিয়া ‘শহীদ’ বলে স্বীকার করবেন? আমার তো মনে হয় না। বছর চারেক আগে এক ভারতীয় ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হয়েছিল (তিনি ৬৫ সালে ফরিদপুর থেকে ভারতে চলে যান)। ৭১ সালে ফরিদপুরে থেকে যাওয়া তাঁর বড় ভাই গ্রামের অন্যান্য লোকজনের সাথে পালাতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে মাটিতে পড়ে যান এবং পলায়নপর জনতার পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে মারা যান। এই হিন্দু কৃষককে খালেদা জিয়া শহিদ বলে মানবেন? আমার তা মনে হয় না। আমার স্ত্রীর মেঝ মামা, ৭১-এ কিশোর বয়সী ছিলেন। এপ্রিলের শুরুতে হারিয়ে যান। সেই সাথে তাদের বাড়ির বিহারী দারোয়ানও লাপাত্তা হয়ে যায়। সেই কিশোর আর কখনোই ফিরে আসেনি। এই হারিয়ে যাওয়া কিশোরকে খালেদা জিয়া শহীদ বলে মানবেন? আমার সন্দেহ আছে।

তবে শুধু খালেদা জিয়াও নন, ৭১ এর নিহতের সংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশের নানা সুধী জনও বেশ ‘একাডেমিক’ আগ্রহ দেখাচ্ছেন (যেমন আফসান চৌধুরী বা অধ্যাপক আমেনা মহসীন)। ডেভিড বার্গম্যানও তাঁর ব্লগে একাত্তরের নিহতের সংখ্যা নিয়ে নানা ‘পণ্ডিতের’ বিভিন্ন লেখার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কেউ বলছেন ৫৮ হাজার, কেউ বলছেন ২ লাখ ৫৮ হাজার, কেউ বলছেন ৫ লাখ। এইসব বিভিন্ন সংখ্যার সবই ‘বৈজ্ঞানিক’ সত্য, শুধু ৩০ লাখ সংখ্যাটিই ‘বাড়িয়ে’ বলা। তবে সবশেষে এও বলেছেন যে, ৭১ সালে ‘বিপুল’ সংখ্যায় মানুষের মৃত্যু নিয়ে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই। সন্দেহ যখন নেই, তবে নিহতের ‘প্রকৃত’ সংখ্যা নিয়ে এত বিতং করার কি মানে আছে? মানে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কের বিষয়বস্তু বানিয়ে ফেলা। বাংলাদেশে অনেক বিষয়েই (বিশেষ করে ইসলাম) খোলামেলা আলাপ করা ট্যাবু, তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনই ট্যাবু নেই। বাজারের মেয়েমানুষের চরিত্রের মত মুক্তিযুদ্ধ একটা মনগড়া কিছু লিখলেই সেটা নিয়েই নানা ‘একাডেমিক’ আলাপ জমে উঠে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের বহুল প্রচারিত ভাষণে ‘জিয়ে পাকিস্তানের’ কোন অস্তিত্ব না থাকলেও মধ্য নব্বইয়ে এসে কেউ কেউ তাঁর ভাষণে ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বসিয়ে দেন। এই ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বিতর্কটি ঝিমিয়ে পড়লেও ইদানীংকালে একে খন্দকারের বইয়ের মারফত আবারো আলোচনায় উঠে আসে। জিয়াউর রহমান স্বয়ং নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবী না করলেও ৯০ এর দশকের শুরুতে বিএনপি ক্ষমতায় এসে তাঁকে জোর করে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়ে দেয় এবং এই নিয়েও বিভিন্ন মহলে এখনও অহেতুক আলাপ চলে।

মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে এটুকু বলা যায় যে, কোন দেশের সেনাবাহিনীই ‘মহাসমারোহে গণহত্যা চলিতেছে’ এই জাতীয় ব্যানার লাগিয়ে গণহত্যা করে না। কত লোককে মেরেছে আর কাকে কাকে মেরেছে সেটারও রেজিস্ট্রি খাতায় কোন হিসাব রাখে না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর সময়েও পাকিস্তান বাহিনীও কোন হিসাব রাখেনি। তবে ৯০ হাজার সৈনিককে ইচ্ছামত হত্যা, ধর্ষণ এবং লুটের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। এদের সহযোগী হিসাবে আরও হাজার পঞ্চাশেক বেসামরিক লোকও এই হত্যা, ধর্ষণ এবং লুটের মহোৎসবে নেমে পড়েছিল। নয় মাস ধরে চলা এই মহোৎসবের ফলাফল হচ্ছে ৩০ লক্ষ নিহত, ২ লক্ষ ধর্ষিতা নারী, ১ কোটি শরণার্থী। সে একই সময়ে প্রায় তিন কোটি মানুষ প্রাণ বাঁচানোর জন্য দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়িয়েছেন।

পৃথিবীর অন্যান্য গণহত্যার মতো ৭১ এর গণহত্যারও কোন শুমারি নেই। আর সকল গণহত্যার মত ৭১ এর গণহত্যায় নিহতের সংখ্যাও এস্টিমেটের উপরেই নির্ভরশীল। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে হাজার হাজার লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে, মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে, শেয়াল কুকুরের খাবারে পরিণত হয়েছে। ভারতে চলে যাওয়া ১ কোটি শরণার্থীর মাঝেও কয়েক লাখ পথে বা শরণার্থী শিবিরে মারা গিয়েছেন। তবে গণহত্যার শুমারি না থাকলেও ৭৪ সালের আদম শুমারির ফলাফল বিশ্লেষণ করলে ৪০-৫০ লক্ষ মানুষের স্বল্পতা দেখা যায়। সেই হিসাবে ৭১ এর ৩০ লক্ষ প্রাণহানির যে এস্টিমেট করা হয়েছিল সেটা সঠিক বলেই প্রমাণ হয়।

১৯১৫ সালে আর্মেনীয় গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ১৫ লক্ষ, হলোকস্টে নিহত হয়েছে ৬০ লক্ষ, ৭১-এ নিহত হয়েছেন ৩০ লক্ষ, কম্বোডিয়ায় ৭০ এর দশকে খেমাররুজদের হাতে নিহত হয়েছেন ২০ লক্ষ, এই সবই হচ্ছে এস্টিমেট। তবে এই এস্টিমেট কোন চাল ডালের হিসাব নয়। নিহতের সংখ্যা এস্টিমেট করে নৃশংসতার একটি চেহারা দাঁড় করানো হয়। হলোকস্ট মানেই নাৎসিদের হাতে নিহত ৬০ লক্ষ মানুষ। সংখ্যাটা ৬ লক্ষ হলেও সেটাও গণহত্যাই থাকে। তবে সংখ্যাটিকে আজ ৬ লক্ষ, কাল ১০ লক্ষ, পরশু ১৫ লক্ষ, এই জাতীয় নানা হিসাব দিলে পুরো হলোকস্টের ব্যাপারটাই সন্দেহের মধ্যে পড়ে যায়। আর এভাবে নাৎসিদের পাপের বোঝাও হালকা হতে থাকে।

৭০-এর দশকের শেষের দিকে জেনারেল টিক্কা খান পাকিস্তানে ৭১ সালের নিহতের সংখ্যা নিয়ে জেরার মুখে পড়েন। তিনি দাবী করেন ত্রিশ লক্ষ নয়, ‘মাত্র’ ৩৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। এই ৩৫ হাজার কিন্তু কোন এস্টিমেট নয়। তাঁর মনে হয়েছিল ৩৫ হাজার সংখ্যাটি পাকিস্তানকে সহজে গেলানো যাবে। ৭৪ সালের হামুদুর রহমান কমিশনে এই সংখ্যাটি হচ্ছে ২৬ হাজার। আবার ইদানীংকালে পাকিস্তানের পত্র পত্রিকায় বলা হচ্ছে ৩ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। এত বছরে সংখ্যাটি ২৬ হাজার থেকে ৩ লাখে উন্নীত হবার পেছনে কোন ‘একাডেমিক’ গবেষণা নেই। আছে পাকিস্তানের লোকজনের ‘হজমী শক্তির’ উন্নতি। একাত্তরের পর পর তারা ২৬ হাজারের বেশী সংখ্যা হজম করতে পারতো না, ইদানীংকালে ৩ লাখ পর্যন্ত পারে।

একাত্তরে নিহতের সংখ্যা নিয়ে খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক ‘একাডেমিক’ আগ্রহের মুল বিষয় হচ্ছে পাকিস্তানের হজমী শক্তি নিয়ে তাঁর ব্যাপক সহানুভূতি। এতগুলো বছর তিনি ভাসুরের নাম মুখে আনেননি, বলেছেন ‘হানাদার বাহিনী’, সাম্প্রতিক কালে সাকা মুজাহিদের ফাঁসীতে ভাসুরের দিলে বড় আঘাত লেগেছে। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক বা আর্থিক সমর্থন সেই ভাসুরের কাছ থেকেই আসে, তিনি কিছু না বললে ভাসুরের রাগ আরও বাড়তে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:৩৩
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রোফেসরদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসুন সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করি : প্রধানমন্ত্রী

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১২ ই মে, ২০২৪ ভোর ৪:১০



বিগত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নিজ সংসদীয় এলাকায় সর্বসাধারনের মাঝে বক্তব্য প্রদান কালে উক্ত আহব্বান করেন ।
আমি নিজেও বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক ।
তিনি প্রত্যন্ত অন্চলের দাড়িয়ারকুল গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×