somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ একটি জাল নোটের আত্মকাহিনী

০৬ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমি একশো টাকার একটি বাংলাদেশী জাল নোট। বাংলাদেশী হলেও আমার জন্ম কিন্তু পাকিস্তানে। এক বছর আগে সে দেশের এক শহরে একটি দোতলা বাড়ির ওপর তলার এক ঘরে আমার জন্ম। সে ঘরের দরজা জানালা সব সময় বন্ধ থাকে। ভেতরে বসে তিন চারজন লোক আমাদের জন্ম দেয়। সেখানে কম্পিউটার, স্ক্যানার, প্রিন্টারসহ অত্যাধুনিক আরও অনেক যন্ত্রপাতি ও কেমিক্যাল নিয়ে তারা কাজ করে। আমার আরো হাজার হাজার যমজ ভাইয়ের জন্ম হচ্ছে সেই ঘরে। আমার মেজভাই পাঁচশো টাকা ও বড়ভাই হাজার টাকারও জন্ম হচ্ছে সেখানে। আরো আশ্চর্য কি জানেন? রূপি দাদা ও ডলার আংকেলেরও জন্ম হচ্ছে একই ঘরে।

আমার জন্মের মাত্র পনের দিন পর আমার অন্যান্য ভাইদের সাথে প্যাকেটবন্দী হয়ে আমি বাংলাদেশে চলে আসি। ব্যাগের মধ্যে অন্ধকারে পড়ে থাকলেও আমরা যে বিমানে চড়ে আকাশপথে বাংলাদেশে আসছি সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। একজন পাকিস্তানি সুন্দরী মহিলা শাহজালাল বিমান বন্দরের বাইরে অন্য একজন সুন্দরী বাংলাদেশি মহিলার কাছে আমাদের ব্যাগটা হস্তান্তর করে ঢাকার একটি পাঁচ তারা হোটেলে চলে যান।

এরপর নানারকম লোকের হাত ঘুরে আমি এক পাইকারি গরু বিক্রেতার হাতে এসে পড়ি। আমার অন্যান্য ভাইরা এ হাত ও হাত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে তাদের কারো কারো সাথে দেখা হলেও বেশিক্ষণ একসাথে থাকার সুযোগ হয়নি। গরু বিক্রেতার সৌজন্যে অল্পদিনের মধ্যে বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় আমার সফর করা হয়ে যায়। সফরের এক পর্যায়ে আবার ঢাকায় ফিরে এলে মতিঝিলের এক ব্যাংকের লোকেরা কি একরকম যন্ত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে এবং আমাকে আনফিট ঘোষণা করে টাকার বান্ডিল থেকে বের করে দেয়। যে লোকটি আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল, সে আমাকে দু’ভাঁজ করে পকেটে ভরে বাসায় নিয়ে আসে। কিছুদিন তার বাসায় আলমারির মধ্যে থাকার পর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে আমার সাথে আরো একটি কুড়ি টাকার আসল নোট দিয়ে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট কিনে লোকটি কেটে পড়ে। সিগারেট বিক্রেতা ছোকরা পরে বুঝতে পারলেও চাল ডাল তেল লবণ কেনার সময় সে এক মুদি দোকানদারের কাছে আমাকে চালান করে দেয়। দিনশেষে ক্যাশ মেলানোর সময় আমি ঐ দোকানের কর্মচারীদের হাতে ধরা পড়লেও পরদিন আমি কিভাবে কিভাবে যেন বাবুবাজারের এক পাইকারি চালের আড়তদারের হাতে এসে পড়ি। আড়তদার একশো টাকার বান্ডিলের মধ্যে লুকিয়ে আমাকে ব্যাংকে জমা দিতে গেলে ব্যাংকের লোকেরা আমাকে চিনতে পেরে আবার বের করে দেয়।

উপায়ন্তর না দেখে আড়তদার লোকটি তার ঠিকাদার ছোট ভাইয়ের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে আমার একটা গতি করতে বলে। ছোট ভাই আরো এক কাঠি সরেস। রোড এন্ড হাইওয়েজের এক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে ঘুষ দেয়ার সময় একতাড়া নোটের মধ্যে লুকিয়ে আমাকে সে চালান করে দেয়। পরদিন তার ওয়ার্ক অর্ডার পাওয়ার কথা।

কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ওয়ার্ক অর্ডারে সই না করে ঠিকাদারকে মোবাইল ফোনে ডেকে পাঠালেন। টেবিলের ড্রয়ার থেকে আমাকে বের করে নোংরা ফেলার মতো করে ঠিকাদারের সামনে ফেলে দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার সাথে দু’নম্বরি? এই নোটটা এখনই বদলে দেন।’ ঠিকাদার ছেলেটি লাইটের আলোয় আমাকে ভালো করে উল্টে পাল্টে দেখে লজ্জিত হবার ভান করে বলল, ‘সরি, স্যার। আজকাল ব্যাংক থেকেও জাল নোট দিচ্ছে। আমরা কি করবো স্যার বলেন? আমি এখুনি বদলে দিচ্ছি, স্যার।’

এরপর ঠিকাদারের সাইট ম্যানেজারের হাত ঘুরে আমি এসে পড়লাম দৌলতদিয়ার এক পতিতার হাতে। দেহ বিক্রির টাকায় সে পতিতাপল্লীর মুদি দোকানে চাল ডাল কিনতে গেলে দোকানদার আমাকে নিতে রাজি হলনা। পতিতা মেয়েটি কেঁদে কেটে অস্থির। তবে এই পল্লীতে থেকে সে ইতিমধ্যে অনেক ছলা কলা শিখে ফেলেছে। পরদিন মোটাসোটা এক খদ্দেরের কাছ থেকে ফি পাওয়ার পর সে একটা আসল একশো টাকার নোট কৌশলে সরিয়ে ফেলে আমাকে খদ্দেরের হাতে দিয়ে বলল, ‘ফুর্তি করবার আইছেন জাল নোট নিয়া? বদলায়া দ্যান মিয়া!’

মোটা লোকটি সেতুর টোল আদায় করে। অতিরিক্ত ওজনের মালবাহী ট্রাক ছেড়ে দেয়ার জন্য সে ড্রাইভারদের কাছ থেকে চা পানি খাওয়ার পয়সা পায়। নিশ্চয় কোন হারামজাদা ড্রাইভার তাকে জাল নোটটি গছিয়ে দিয়েছে। সে আমাকে পকেটে রেখে পতিতা মেয়েটিকে একখানা আসল নোট দিয়ে মনে মনে বলল, ঠিক আছে, ব্যাটা তোদের টাকা আমি তোদের কাছেই উগরে দেব। দু’নম্বরি কাজে আমিও কম না।

এভাবে সত্যি সত্যিই আমি এক ড্রাইভারের হাতে এসে পড়লাম। ড্রাইভার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসছিল। পথে যাত্রা বিরতির ফাঁকে টিনের ছাউনি দেওয়া এক হোটেলের পেছন দিকের ঘরে এক হিজড়াকে দিয়ে গা মালিশ করিয়ে আমাকে তার হাতে গছিয়ে দিল সে। হিজড়া খুব খুশি। গা মালিশ করে সে পঞ্চাশ টাকার বেশি পায়না। আজ পেয়েছে একশো টাকা। সে আনন্দে ড্রাইভারের দেহের স্পর্শকাতর অঙ্গে আদর করে সুড়সুড়ি দিয়ে দিল এবং নিজের দু’হাতের তালুতে চাটা মেরে আমাকে চুমু দিয়ে ব্লাউজের ফাঁক গলিয়ে তার সমতল বুকের মধ্যে রেখে দিল।

এরপর আবার এক বোকা দোকানদারের হাত ঘুরে আমি চলে এলাম এক প্রাইমারী শিক্ষকের মানিব্যাগে। ভদ্রলোক পরে জাল নোট বুঝতে পেরে দোকানদারকে ফেরত দিতে গেলে দোকানদার ‘আমি দেইনি’ বলে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। অনেক ঝগড়াঝাঁটি করেও যখন কোন কাজ হলনা, তখন ‘ঠিক আছে, এই নোট কিভাবে চালাতে হয় আমি জানি’ বলে প্রাইমারী শিক্ষক নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে আমাকে ক’দিন তার নিজের কাছে রেখে দিলেন। তারপর একদিন ভ্যানগাড়িতে শাক সবজী, পিঁয়াজ রসুন নিয়ে এক হকার তাঁর বাড়িতে এলে তাঁর স্ত্রী শাক সবজী আর পিঁয়াজ রসুন কিনে আমাকে দিয়ে হকারের দাম শোধ করলেন। হকার লোকটা চোখে একটু কম দেখে। আমাকে এপিঠ ওপিঠ উল্টে দেখে হাসিমুখে পকেটে রেখে সে সালাম দিয়ে চলে গেল।

কিন্তু পরদিন ভোরে সে পাইকারি রেটে মাল কেনার জন্য মোকামে গেলে তার মহাজন বলল, ‘জয়নাল, এই জাল নোটটা তুমি পাইলা কই?’
‘জাল নোট!’ আমাকে হাতে নিয়ে প্রায় চোখের সাথে ঠেকিয়ে আবার ভালো করে দেখে জয়নাল বলল, ‘এইডা জাল নোট?’
মহাজন পানের পিক ফেলে হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি আধাকানা মানুষ। কেউ না কেউ চালায়া দিছে। তুমি বুঝবার পার নাই। নোটটা বদলায়া দাও। এরপর থাইকা সাবধানে ট্যাকা পয়সা নিও জয়নাল। দিনকাল ভালো না।’

জয়নাল গরিব মানুষ। বাড়িতে আটটা মুখ। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে শাক সবজী বেঁচে আটটা মুখে ভাতের যোগান দিতে হয় তাকে। আমি জাল নোট শুনে সে কেঁদে ফেলল। মহাজন সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘আরে, তুমি কাঁনতাছ ক্যান্? তোমারে যেমন চালায়া দিছে, তুমিও তেমনি কারো কাছে চালায়া দিবা। দুনিয়ায় কত বোকা লোক আছে না!’
‘না, মহাজন।’ জয়নাল জামার আস্তিন দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘এই কাম আমি করবার পারুম না। আমি ঠকছি বইলা আর একজনরে ঠকাইতে পারুম না। এই নোট আমি অহনই পুড়াইয়া ফেলুম।’

জয়নাল হকারের কথা শুনে আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে গেল। সর্বনাশ! আমাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলবে? গরু ব্যবসায়ী, সিগারেট বিক্রেতা, দোকানদার, আড়তদার, ব্যাংকের লোক, ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার, সাইট ম্যানেজার, টোল কর্মচারী, ড্রাইভার, শিক্ষক এমনকি বেশ্যা ও হিজড়াও এই ব্যাটা হকারের চেয়ে অনেক ভালো ছিল। আমি জাল নোট হলেও ওরা আমাকে মেরে ফেলেনি। আর এই কানা হকার লোকটা কি বদমাশ্! বলছে, আমাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলবে!

আর সত্যি সত্যিই বদমাশটা তাই করলো। পকেট থেকে ম্যাচ বের করে আগুন জ্বালিয়ে আমাকে পুড়িয়ে দিল। আমি পুড়ে সম্পূর্ণ ছাই না হওয়া পর্যন্ত বদমাশটা অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই দেখলো সে দৃশ্য। অথচ কেউ ‘ইন্নালিল্লাহ’ পর্যন্ত পড়লো না।
*****************************************************************************************************************
রি-পোস্ট
ছবিঃ নেট
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:৩৮
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×