somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতিচারণঃ ঠিকানা

১৭ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১২:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমাদের শহরে গনকপাড়া নামে একটা বাণিজ্যিক এলাকা আছে। পুরাতন ও নতুন অবকাঠামো মিলিয়ে জায়গাটা ব্যাবসা বাণিজ্যের জন্য বেশ জমজমাট স্থান। ব্যাংক, বীমা, গার্মেন্টস, ইলেকট্রনিক্স, ফার্মেসী, হোটেল, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি প্রায় সব ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের হাঁক ডাকে এলাকাটি সারাদিন গম গম করে। স্বাধীনতার আগে গনকপাড়ার কয়েকটি ছোট ছোট চায়ের দোকান খুব বিখ্যাত ছিল। সে সময় এই চায়ের দোকানগুলো শুধু চা আর বিস্কুট বিক্রি করতো। মোষের ঘন দুধ মিশিয়ে উন্নতমানের চা-পাতা দিয়ে তৈরি করা এসব দোকানের চা ছিল খুবই সুস্বাদু। এই চা খাওয়ার জন্য শহরের প্রায় সব এলাকার মানুষ সকাল থেকে রাত নটা দশটা পর্যন্ত দোকানগুলোর সামনে ভিড় জমাতো। দোকানদাররাও ভিড় সামলাতে হিমশিম খেত। স্বাধীনতার পরেও কয়েক বছর এই অবস্থা বজায় ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আমাদের মহল্লার সমবয়সী বন্ধুদের সাথে আমিও নিয়মিত বিকেলবেলা সেখানে চা খেতে যেতাম। তখন আমি কলেজের ছাত্র। সেই ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমি গনকপাড়ার চা (এই নামেই বিখ্যাত) খেতে যাই। তবে এখন আমার এই যাওয়াটা অনিয়মিত হয়ে গেছে। আগের মত আর রোজ রোজ যাওয়া হয়না। হয়তো সপ্তাহে একদিন বা মাসে দু’মাসে একদিন যাওয়া হয়।

চল্লিশ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। দোকানগুলোর মালিক ছিল প্রধানতঃ ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে আসা উর্দুভাষী মোহাজিররা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা অনেকেই পাকিস্তান চলে যায়। রাস্তা চওড়া করার জন্য ভাংচুর হওয়ায় অনেকেই তাদের দোকান হারিয়ে অন্য পেশায় চলে যায়। অনেকে এই চল্লিশ বছরে মারাও গেছে। সর্বশেষ যে দু’তিনটি দোকান ছিল, সেগুলোর এখন বেহাল অবস্থা। চায়ের স্বাদ আর আগের মত নেই। ফলে সেই রমরমা ব্যবসাও আর নেই। আমরা যে দোকানে চা খেতে যেতাম, সৌভাগ্যক্রমে সেটি এখনও টিকে আছে। এই দোকানের মালিক রহমতুল্লাহ মারা যাওয়ার পর তার ছেলে বরকতুল্লাহ দোকানের হাল ধরেছে। সেও প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। বাহাত্তর সালে আমরা যখন গনকপাড়ায় চা খেতে যেতাম, তখন বরকতুল্লাহর বয়স ছিল বার তের বছর। সে তার বাবাকে দোকানের কাজে সাহায্য করতো। তিনটি বড় বড় লাকড়ির চুলার একটিতে বিশাল হাঁড়িতে সারাদিন পানি ফুটতো, একটিতে বড় সসপ্যান ভর্তি ঘন দুধ জ্বাল হতে হতে লাল হয়ে যেতো আর একটিতে ফোটানো পানি ভর্তি বড় বড় তিনটি কেটলি বিরামহীনভাবে রহমতুল্লাহর হাতে ওঠা নামা করতো। টিনের তৈরি বিশাল ট্রেতে করে চা নিয়ে বরকতুল্লাহ দোকানের সামনে ভিড় জমানো খদ্দেরদের কাছে পৌঁছে দিতো। কেউ চাইলে সাথে একটা বা দু’টা নোনতা বিস্কুট। পর্যাপ্ত বসার জায়গা না থাকায় অধিকাংশ খদ্দেরই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খেয়ে চলে যেতো। বরকতুল্লাহর বয়সী একজন কর্মচারী ছোকরাও কাজ করতো দোকানে। রমরমা বেচাকেনা। রহমতুল্লাহর সাহায্যকারী না হলে চলবে কেন? দোকানের কোন সাইনবোর্ড ছিলনা। রহমতুল্লাহর চা বললেই সবাই চিনে ফেলতো।

সেই দোকান এখন চালায় তার ছেলে বরকতুল্লাহ। কিন্তু দোকানের সেই রমরমা দিন আর নেই। লাকড়ির চুলা উঠে গিয়ে একটা মাত্র পাম্প করা কেরোসিনের চুলা জ্বলে। সেই চুলার এক পাশে গরম পানির জন্য একটা আর এক পাশে গরুর দুধের জন্য একটা কেটলি। কনডেনসড্ মিল্কের কৌটাও রয়েছে। তবে অনেকে কনডেনসড্ মিল্কের চা খেতে চায়না বলে কেটলিতে সামান্য কিছু দুধ রাখা হয়।

বরকতুল্লাহ ইতিমধ্যে বুড়ো হয়ে গেছে। তার চুল দাড়িতে পাক ধরেছে। বরকতুল্লাহর বউ ছেলে নাই। বাবা মা তো অনেক আগেই দুনিয়াছাড়া। একজন বাঙালী ছেলেকে পেটে ভাতে কর্মচারী নিয়ে সে দোকান চালায়। চায়ের মান একেবারে জাহান্নামে গেছে। অন্ততঃ তার বাবার আমলের তুলনায়। তবু নস্টালজিয়ার টানে আমি এখনও মাঝে মধ্যে সেই দোকানে চা খেতে যাই আর চা খাওয়ার সময়টুকু বরকতুল্লাহর সাথে গল্প করি। বিস্বাদ চা খাওয়ার পরেও আগের সেই চা খাওয়ার অনুভূতি হয়। গনকপাড়ার চা।

আমি নিজেও বুড়ো হয়ে গেছি। তবু বরকতুল্লাহ আমাকে চিনতে পেরে এখনও সমাদর করে বসায়। গরম পানি দিয়ে ভালো করে কাপ ধুয়ে চা দেয়। ওর চোখের সামনেই দিনে দিনে বুড়িয়ে গেলাম বলে আমাকে চিনতে ওর কখনো ভুল হয়না। আমি জিজ্ঞেস করলে বলে, না স্যার, আপনার বন্ধুদের কেউ আর এখন আসেনা। শুধু আপনিই আসেন।

আচ্ছা বরকত মিয়া, তোমার কি মনে আছে আমরা আট দশ জন বন্ধু মিলে দল বেঁধে আসতাম আর হৈ চৈ করতে করতে তোমার বাবার হাতের চা খেতাম?

বরকতুল্লাহ ম্লান হেসে বলে, মনে থাকবেনা স্যার? খুব মনে আছে। আপনারা চা খেয়ে মাঝে মাঝে আমাকে দু’এক আনা বখশিশ দিয়ে যেতেন। সেসব দিনের কথা কি ভোলা যায়, স্যার?

বরকত মিয়া, তুমি কি এখনও উর্দুতে কথা বলতে পারো?

বোলনা ঠিক সে আতা নেহি স্যার। বিহারী লোগ সব চলে গ্যায়ে। মেরা আপনা তো কোই নেহি। বোলনে কা মওকা কাহাঁ?

তা তুমিও তো ওদের মতো পাকিস্তান চলে যেতে পারতে!
বরকতুল্লাহ এ কথার কোন জবাব দেয়না।

একই প্রশ্ন আর একদিন করায় সে মৃদু হেসে বলে, স্যার আমরা হলাম না ঘরকা, না ঘাটকা। আমার জন্ম তো এ দেশেই। জন্মভূমি ছেড়ে কোথায় যাবো, স্যার? জিনা ইঁহা, মরনা ভি ইঁহা। আমি বাংলাদেশের মাটিতেই মরতে চাই, স্যার। কাঁহি নেহি যানা।

এ বছর একুশের বইমেলা উপলক্ষে আমার একটি উপন্যাসের বিক্রয় কার্যক্রম তদারকির জন্য আমি পুরো ফেব্রুয়ারি মাস ঢাকায় ছিলাম। সেখান থেকে ফিরে মার্চের মাঝামাঝি একবার গনকপাড়ায় চা খেতে যাওয়ার সুযোগ হলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি, বরকতুল্লাহর দোকান বন্ধ। আশেপাশের দোকান গুলোতে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, বরকত মিয়া মারা গেছে। শেষের দিকে তার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ধার দেনা করে চিনি, চা-পাতা আর দুধ কিনে সে দোকান চালাতো। মারা যাওয়ার সময় তার ক্যাশ বাক্সে টাকা পয়সা তেমন ছিলনা। এই গনকপাড়ার দোকানদাররাই চাঁদা তুলে তার দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেছে। টিকাপাড়া গোরস্থানে তার মাটি হয়েছে।

চা না খেয়ে ফিরে আসার সময় রিক্সায় বসে আমার কেন যেন মনে হলো, বরকতুল্লাহ তার স্বজাতির লোকদের মতো হেরে যায়নি। এদেশে জন্মে এদেশের মাটিতেই সে তার চিরস্থায়ী ঠিকানা করে নিয়েছে। হ্যাটস্ অফ টু ইউ, বরকত মিয়া।
************************************************************************************************************************
[ এই গল্পটি সাপ্তাহিক রাজশাহী বার্তার আগস্ট/ ২০১২ সংখ্যায় প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা পড়েননি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম। ]
রি-পোস্ট।
ছবিঃ নেট।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১২:২২
১৪টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×