somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ ফাতেমার প্রেম

২৯ শে অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সালিসের রায় শুনে সারা গাঁয়ে হৈ হুলস্থুল পড়ে গেল। একাত্তরের যুদ্ধের পর দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছরে এই গাঁয়ে এমন তোলপাড় আর কখনো হয়নি। চারদিকে চাপা উত্তেজনা। মনা মণ্ডলের দোকানে চায়ের বিক্রি বেড়ে গেল। বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়ায় চায়ের দোকান অন্ধকার। গ্রামের বউ ঝিরা ঘরে বাইরে, পুকুর ঘাটে, কলের পাড়ে ছি ছি করতে করতে মুখের থুতু শুকিয়ে ফেললো। গাঁয়ের একদল অতি উৎসাহী যুবক বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরাতন জুতা স্যান্ডেল সংগ্রহের কাজে নেমে পড়লো।

ঘটনা হলো, পালপাড়ার কুমোর সতীশ পালের ছেলে অশোক পাল গাঁয়ের ক্ষেতমজুর আব্দুল হাকিমের মেয়ে ফাতেমাকে নিয়ে পালিয়েছে। এই প্রত্যন্ত নিরিবিলি গ্রামে এমন ঘটনা এই প্রথম। এর আগে এমন লজ্জার কথা কেউ শোনেওনি, এমন ঘটনা কেউ দেখেওনি। হিন্দু ছেলের সাথে মুসলমান মেয়ে পালিয়েছে। বোমা পড়ার মতোই ঘটনা বটে।

সালিসের হর্তাকর্তারা গম্ভীর মুখে নিজ নিজ মতামত দিলেন। ইউ পি চেয়ারম্যান মোকছেদ আলী বললেন, এই ঘটনা শুধু এই গ্রামের নয়, পুরো ইউনিয়নের মাথা হেঁট করে দিয়েছে। মেম্বার গনি মিয়ার মত হলো, গ্রামের সব নারী পুরুষের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। এর একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। মসজিদের ইমাম সাহেব বললেন, এই ব্যাভিচারের শাস্তি একশো ঘা দোররা। কিন্তু সমস্যা হলো যারা এ কাজ করেছে, তারা তো পালিয়ে গেছে। দোররাগুলো মারা হবে কাকে? শেষে প্রায় দেড় ঘণ্টা বাক বিতণ্ডার পর রায় হলো, যেহেতু ব্যাপারটা হঠাৎ করে ঘটেনি, অশোক ও ফাতেমার মধ্যে গোপনে অনেকদিন ধরে ফষ্টিনষ্টি চলছিল-যা দুই পরিবারের প্রশ্রয় ছাড়া সম্ভব নয়, সেহেতু এটা পরিস্কার যে এদের দুই পরিবার এই ঘটনার জন্য দায়ী। অতএব, দুই পরিবারের দুই মাথা সতীশ পাল ও আব্দুল হাকিমকে শাস্তি পেতে হবে। তাদের শাস্তি হলো পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, পঁচিশ ঘা বেত ( একশো ঘা বেত্রাঘাতে দুই বুড়ো মরে গেলে আরেক কেলেঙ্কারি হবে ), মাথা কামিয়ে মুখে চুনকালি লেপন এবং গলায় জুতার মালা পরিয়ে সারা গ্রামে ঘোরানো।

বয়োঃবৃদ্ধ মুরুব্বিরা এই রায়ে খুব খুশি। কেননা এতে গ্রামের ইজ্জত রক্ষা হবে। ভবিষ্যতে এমন কেলেঙ্কারি করতে কেউ সাহস পাবে না। কিছু মুরুব্বি আমতা আমতা করলেন। কলেজে পড়া দু’একজন যুবক নিচু স্বরে আপত্তিও করলো। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের হাত তালিতে তাদের সেসব দুর্বল প্রতিবাদ ধামাচাপা পড়ে গেল। ঘটনাবিহীন নিস্তরঙ্গ পল্লী জনপদে এমন জবরদস্ত শাস্তি দেখার জন্য সবাই উদগ্রীব। নারী পুরুষ সবার মধ্যে টান টান উত্তেজনা। ছোটখাটো আপত্তি, আরও ভেবে দেখার অনুরোধ সব ভেসে গেল খড়কুটোর মতো।

ছেলে মেয়ের মতো ওদের বাপেরাও যেন পালিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য তাদের আটকে রাখা হলো গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের একটা ঘরে। দরজায় বড় সড় একটা তালা ঝুলিয়ে লাঠি হাতে ঘরের সামনে পাহাড়ায় বসে গেল চার জন উৎসাহী যুবক। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাঁড়ির তলা চেঁছে কালি জোগাড় করা হলো। স্বেচ্ছাসেবীদের গাঁটের পয়সা খরচ করে চুন কেনা হলো। আর পুরাতন জুতা স্যান্ডেল সংগ্রহের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। সতীশ পালের গাই গরু আর আব্দুল হাকিমের রামছাগল হাটে তুলে বিক্রি না করা পর্যন্ত জরিমানার টাকা পরিশোধ করা যাচ্ছে না বলে মানবিক কারণে সামনের হাটবার পর্যন্ত তাদেরকে সময় দেওয়া হলো। তবে অন্য দুটো শাস্তি আজই কার্যকর করা হবে। এই দুটো শাস্তির মধ্যে বেত আগে, না জুতা আগে এই নিয়ে সালিসে বেশ তর্ক বিতর্ক হলো। আগে বেত মারার কারণে আসামীরা হাঁটতে অসমর্থ হয়ে পড়লে জুতার মালা পরিয়ে গ্রাম ঘুরানো সম্ভব হবে না। অতএব সিদ্ধান্ত হলো, জুতা আগে।

সালিসের রায় হবার পর থেকে চারদিকে সাজ সাজ রব। গ্রামের কমবয়সী ছেলেপুলেরা কাঠি লজেন্স মুখে নিয়ে মহা উৎসাহে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্কুলের মাঠে। চারপাশে বাড়িঘরের মেয়েলোকেরা দরজা জানালার ফাঁক দিয়ে ঘোমটার ভেতর থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে স্কুলের দিকে। মুসল্লিরা নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরোবার সময় কটমট করে তাকাচ্ছে সেদিকে। সব মিলিয়ে টান টান উত্তেজনা।

দুই বুড়োকে জুতার মালা পরিয়ে বিকেলবেলা ঘুরানো হবে। তার আগে তাদের মাথা কামিয়ে মুখে চুনকালি মাখানো হবে। বেত একটা জোগাড় করা হয়েছে বটে, তবে সেটা অনেকেরই মনঃপুত হচ্ছে না। প্রাইমারী স্কুলের বাচ্চাদের পেটানোর জন্য মহসিন মাস্টারের এই বেত আনা হয়েছে তার বাড়ি থেকে। অতি ব্যবহারে বেতের অবস্থা করুণ। কর্তব্যকর্মের মাঝপথে বেতের দফা রফা হয়ে যেতে পারে। উদ্যোক্তারা শলাপরামর্শ করে বয়েনউদ্দিনের বাঁশের ঝাড় থেকে গোটা চারেক কাঁচা কঞ্চি কেটে নিয়ে এলো। সেগুলোর শক্ত গিরা দা’ দিয়ে কেটে সাইজ করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো একজন। পাশের গ্রামের শীলপাড়া থেকে নাপিত আনা হয়েছে মাথা কামানোর জন্য। চামড়ার টুকরায় ঘষে ঘষে ক্ষুরের ধার তুলছে মাঝবয়সী নাপিত ঘনা শীল। তার চোখে মুখে কৌতূহল। জীবনে সে বহু মাথা কামিয়েছে, কিন্তু এমন শাস্তির জন্য মাথা কামানো তার জীবনে এই প্রথম। তাই তার উৎসাহের ঘাটতি নাই।

দুপুরের পর স্কুলঘর থেকে আসামীদের হাত বাঁধা অবস্থায় বের করে আনা হলো। স্কুলের উত্তরে পুকুরের পাশে ছাতিয়ান গাছের নিচে মাটির ওপর বসানো হলো ওদের। এখানে ওদের মাথা কামানো হবে। কিন্তু ঘনা শীলের মন খারাপ। দু’জনের মাথা কামানো হবে বলে আনা হয়েছে তাকে। এখন দেখা যাচ্ছে একজনের মাথায় কোন চুলই নাই। সতীশ পালের মাথায় চকচকে টাক। ঘাড় ও কানের ওপর সামান্য ক’টা শণ পাটের মতো সাদা চুল। সে চুল না কামালেও চলে। ঘনা শীল সে কথা বলতেই সবাই খাঁই খাঁই করে তেড়ে এলো ওর দিকে। ওই চুলও চেঁছে ফেলতে হবে। পুরো মাথাসহ আশপাশটা হতে হবে চকচকে নতুন আয়নার মতো। কোন ধানাই পানাই চলবে না। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পানের পিক ফেলে হাসিমুখে কাজে লেগে গেল ঘনা শীল। তার জন্য গ্রামের এক বাড়ি থেকে গোটা চারেক খিলি পান একটা পিরিচে করে সাজিয়ে আনা হয়েছে। নরসুন্দররা পান খায় তা’ সবাই জানে। পানের অভাবে তার কাজে কোন খুঁত হোক তা’ কেউ চায় না। কিন্তু সমস্যা হলো আব্দুল হাকিমের বেলায়। তার মাথা কামানো শেষ করে ঘনা শীল জিজ্ঞেস করলো, ‘দাড়ি কী থাকবে, না ফেলে দেব?’

তাই তো! দাড়ির কথা তো ভাবা হয়নি। আব্দুল হাকিমের মুখ ভর্তি কাঁচাপাকা চাপ দাড়ি। সেগুলো কী রেখে দেয়া হবে, না ফেলে দেয়া হবে এ ব্যাপারে সালিসের কোন নির্দেশ নাই। উদ্যোক্তারা বুঝতে পারছে না কী করা উচিৎ। ঘনা শীলকে অপেক্ষা করতে বলে উদ্যোক্তাদের কয়েকজন চলে গেল মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে। ইমাম সাহেব সমস্যার কথা শুনে নিজেও সমস্যায় পড়ে গেলেন। নবীজির সুন্নত কেটে ফেলা যায় না, আবার রেখে দিয়ে জুতার মালা গলায় পরালে জুতার স্পর্শে সুন্নতের অবমাননা হবে। তা’ ছাড়া গাল ভর্তি চাপ দাড়ি রেখে দিলে গালে চুন কালি মাখানো মুশকিল। দাড়ির ওপরেই চুন কালি মেখে দেওয়া যায়, কিন্তু তাতেও তো সুন্নতের অবমাননা। এই কাজ কখনোই করা সম্ভব নয়। ইমাম সাহেব বুঝতে পারছেন না কী বলবেন। শেষে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত হলো। শাস্তি কার্যকরের জন্য চেয়ারম্যান সাহেব ও সালিসের অন্যান্য লোকজন এলে তখন দাড়ির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।

আব্দুল হাকিমের ছেলে এবং সতীশ পালের বউ তাদের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছে। ছেলেটির বয়স চৌদ্দ পনের হবে। বাপের সামনে ভাতের থালা এগিয়ে দিয়ে চোখ মুছছে সে। সতীশ পালের প্রৌঢ়া বউ স্বামীর সামনে ভাতের থালা রেখে পালাগানের মতো একটানা সুর করে কাঁদছে। আসামীদের হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে। তারা কাঁদতে কাঁদতে ভাত খাচ্ছে। চারপাশ ঘিরে সবাই উপভোগ করছে তাদের ভাত খাওয়ার দৃশ্য।

আসামীদের পাহাড়াদার চার যুবকসহ উদ্যোক্তাদের সবার জন্য খিচুড়ি রান্না করা হচ্ছে। আসামীদের শাস্তি শেষ না হওয়া পর্যন্ত এরা কেউ বাড়ি যাবে না। বিরাট দায়িত্ব। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল ডাল, আলু পটল, হাঁড়ি পাতিল এসব চেয়ে আনা হয়েছে। ছাতিয়ান গাছের নিচে গর্ত খুঁড়ে চুলা বানিয়ে খিচুড়ি রান্না করা হচ্ছে। কাঁচা খড়ির ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার।

আসামীদের খাওয়া শেষ হলে আবার পিছমোড়া করে তাদের হাত বেঁধে স্কুলঘরে ঢুকিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হলো। চার যুবক বসে গেল পাহাড়ায়। আব্দুল হাকিমের ছেলে আর সতীশ পালের বউ বাড়ি না গিয়ে এঁঠো থালা হাতে দূরে বসে নিঃশব্দে কাঁদছে। তাদের কান্নাকাটিকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো সময় নেই কারো। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। কলাগাছের পাতা কেটে আনা হয়েছে। সেই পাতায় গরম গরম খিচুড়ি নিয়ে খেতে বসেছে সবাই। আজাদ নামে আটাশ বছরের এক যুবক ইতিমধ্যেই উদ্যোক্তাদের নেতা বনে গেছে। বি,এ ফেল হলেও গাঁয়ে একমাত্র আজাদই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে। তাই নেতৃত্বটা কব্জা করা তার জন্য কঠিন হয়নি। তা’ ছাড়া গ্রামের সব ব্যাপারেই সে এক পা এগিয়ে থাকে। চেয়ারম্যান মোকছেদ আলীরও সে পেয়ারের লোক। নিজে না খেয়ে অন্যদের খাওয়া দেখভাল করছে সে। এদের সবার খাওয়া শেষ হলে সে খাবে। খিচুড়িতে টানাটানি পড়বে কী না হাঁড়ির ঢাকনা তুলে বার বার পরখ করছে সে। একবার মনে হচ্ছে টান পড়বে, আবার মনে হচ্ছে পড়বে না। বিনে পয়সার খিচুড়ি। সবাই হাতের কব্জি পর্যন্ত মাখামাখি করে খাচ্ছে। এক পর্যায়ে সত্যি সত্যিই খাবার ফুরিয়ে গেল। নেতা আজাদের আর খাওয়া হলো না। কিন্তু তাতে কী? নেতা হলে কত কিছু সহ্য করতে হয়!

কোত্থেকে এক হিজড়া এসে ঘোরাঘুরি করছে স্কুলের মাঠে। এই হিজড়ার অত্যাচারে স্বেচ্ছাসেবীরা অতিষ্ঠ। গ্রামের বাড়ি বাড়ি থেকে চেয়ে আনা জুতা স্যান্ডেলের স্তূপ থেকে একজোড়া স্যান্ডেল তুলে নিয়ে নিজের পায়ে পরে সারা মাঠ ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। স্বেচ্ছাসেবীদের কারো কারো গালে হাতের তালু দিয়ে হাল্কা করে চাঁটা মেরে বলছে, ‘যাহ্‌, তোরা সব নিম মরদ। লাইলী মজনু পালিয়ে গেল তো তোদের ক্যানে ঘুম নাই?’
নেতা আজাদ এসে কঞ্চিপেটা করে হিজড়ার পা থেকে স্যান্ডেল খোলালো। তারপর সে নির্দেশ দিতেই একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে হৈ হৈ করে তাড়া করলো হিজড়াকে।

গ্রামের একমাত্র কবি স্বঘোষিত ‘কাব্যরত্ন’ ইমান আলী এস এস সি। মাধ্যমিক পাশ করার পর থেকে সে তার নামের শেষে এস এস সি টাইটেল ব্যবহার করে। সালিসের রায় হবার পর পরই সে স্কুলের বারান্দায় বসে ‘ফাতেমার প্রেম’ নামে একটা কবিতা লিখে ফেলেছে। এখন সেই কবিতা নিয়ে সে অনেকক্ষণ থেকে নেতা আজাদের পিছে ঘুর ঘুর করছে। তার উদ্দেশ্য হলো শাস্তি প্রদান অনুষ্ঠানে কবিতাটি পাঠ করা। এ জন্য নেতার অনুমতি চাই। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে কবিতাটি পড়ে দেখার সময় পাচ্ছে না নেতা। এমন একটা ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে তো যেন তেন ফাউল কবিতা পড়ার অনুমতি দেওয়া যায় না। কাব্যরত্নের কাব্য প্রতিভায় গ্রামের লোকের আস্থা কম। কিন্তু কাব্যরত্নের ক্রমাগত ঘ্যানর ঘ্যানর শুনতে শুনতে এক সময় বিরক্ত হয়ে তার কবিতাটা পড়তেই হলো নেতাকে।

কবিতার শীর্ষে একটি সংখ্যাঃ ৭৮৬ তারপর কবিতার শিরোনামঃ ফাতেমার প্রেম
হায় ফাতেমা, তুমি কেন আজ এই বাজে কাজ করলে?
প্রেমের তরে সব ছেড়ে আজ পালের নায়ে চড়লে!
ইমান আলীর স্টিমার ছিল, দেখলে না তা’ একবারও
সময় তোমার হলো না হায় আমার দিকে দেখবারও
হায় ফাতেমা...........................

আর পড়ার ধৈর্য হলো না নেতার। ফাতেমা একটু আলটপকা গোছের মেয়ে ছিল বলে নেতা আজাদ নিজেও সামান্য দুর্বল ছিল তার প্রতি। কিন্তু তাই বলে ইমান আলীর মতো হাফ ম্যাডও............! ছি ছি ছি। কবিতার কাগজটা টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলে দিল নেতা। বললো, ‘এসব কী লিখেছ তুমি? এইগুলা কী এসব অনুষ্ঠানে পড়া যায়? তুমি পাবনা মেন্টালে গিয়ে ভর্তি হও। আহাম্মক কোথাকার!’
কবিতা ছিঁড়ে ফেলা আর ইমান আলীর কলিজা ছিঁড়ে ফেলা একই কথা। ব্যথায় মুখটা কুঁচকে গেল তার। কাগজের টুকরা গুলো মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে মন খারাপ করে চলে গেল সে। নিজেকে সে এই বলে সান্ত্বনা দিল যে কবিতা সবাই বোঝে না।

পাটের রশি দিয়ে জুতার মালা গাঁথার কাজ শেষ হয়েছে। ছেঁড়া ফাটা পরিত্যক্ত সব জুতা স্যান্ডেল। তবে তার মধ্যে দু’এক জোড়া পরার মতোও আছে। আসামীদের গ্রাম প্রদক্ষিন শেষে এগুলো ফেরত দেবার শর্তে চেয়ে আনা হয়েছে। কাঁচা কঞ্চিগুলোর গায়ে শর্ষের তেল মেখে আরও মসৃণ করা হচ্ছে। যারা বেত্রাঘাত করবে, তাদের নামের লিস্ট তৈরি করা হচ্ছে। অনেকেই এ কাজে অংশ নিতে চায়। কিন্তু নেতা আজাদ যাদের নাম বলছে তাদের বাইরে কারো নাম লেখা হচ্ছে না। স্কুলের বারান্দার সামনে তিরপল খাটিয়ে চেয়ার টেবিল সাজানো হচ্ছে। চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য গদিওয়ালা কাঠের চেয়ার, অন্যান্যদের জন্য প্লাস্টিকের।

ঠিক এই সময় উপজেলা সদর থেকে দুটো মোটর সাইকেলে চড়ে দু’জন এনজিও কর্মী ও একজন মহিলা সাংবাদিক এসে হাজির। তাদের চোখ মুখ পাথরের মতো শক্ত। এখানে কী ঘটছে সে বিষয়ে তারা জানতে চায়। কোত্থেকে খবর পেয়ে এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসে তারা হাজির হলো কে জানে! মোবাইলের যুগে এই এক জ্বালা। কোন কিছুই আর চাপা থাকছে না।
নেতা আজাদ ও অন্যান্যদের সাথে কথাবার্তা বলে সাংবাদিক ও এনজিও কর্মীরা স্কুল ঘরে গেল। সেখানে ঘরের তালা খুলিয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় সতীশ পাল ও আব্দুল হাকিমকে স্কুলের বারান্দায় এনে তাদের ছবি তুললো মহিলা সাংবাদিক। ছবি তোলা নিয়ে নেতা আজাদের সাথে সামান্য বাক বিতণ্ডা হলো তার। ছবি কার অনুমতিতে তোলা হলো—আজাদের এই নেতাসুলভ প্রশ্নে সাংবাদিকের পাল্টা প্রশ্ন, ‘অনুমতি কার কাছে নিতে হবে?’ নেতা আজাদ সন্তোষজনক জবাব দিতে না পেরে গাঁইগুঁই করে থেমে গেল। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। একটা মিনি টেপ রেকর্ডার অন করে আসামীদের সাথে কথা বলা শুরু করলো সাংবাদিক ও এনজিও কর্মীরা।
‘আপনাদের হাত বাঁধা কেন?’
উত্তর নাই।
‘আপনার মেয়েকে নিয়ে ওনার ছেলে পালিয়েছে?’
এবারও উত্তর নাই।
‘আজ সকালে এ ব্যাপারে গ্রামে সালিস হয়েছে?’
‘কারা সালিস করেছে?’
‘সালিসে কী রায় হয়েছে বলুন।’
সতীশ পাল ও আব্দুল হাকিম দু’জনেই চুপচাপ। তারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে প্রশ্নকর্তাদের দিকে।
‘দেখুন, আমরা একটি মানবাধিকার সংস্থার লোক। আমাদেরকে সব খুলে বলুন। কোন ভয় নাই। প্রয়োজন হলে থানা পুলিশের সাহায্য নিয়ে আপনাদের মুক্ত করা হবে। কেউ আপনাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এখন বলুন কারা সালিস করেছে আর সালিসের রায় কী?’
ভয়ার্ত চোখে প্রশ্নকর্তাদের দিকে তাকিয়ে আছে দুই বুড়ো। দু’জনের কারো মুখে টুঁ শব্দ নেই।
‘আপনাদের পালিয়ে যাওয়া ছেলে মেয়ের বয়স কত?’
নেতা আজাদ ভীষণ রেগে গেল। বললো, ‘ওদের বয়স দিয়ে আপনাদের কী কাম?’
‘আপনি বলতে পারবেন ওদের বয়স কত?’ এবার নেতা আজাদকে সাংবাদিকের সরাসরি প্রশ্ন।
‘জানি না।’ নেতার কথায় স্পষ্ট বিরক্তি।
‘আপনি কী এদের হাত বেঁধেছেন?’
‘জি না।’
‘কে বেঁধেছে জানেন?’
‘জি না, জানি না।’
‘সালিসে চেয়ারম্যান সাহেব ছাড়া আর কে কে ছিল? আপনি নিজে ছিলেন কী?’
‘জি না।’
নেতা আজাদের উত্তর শুনে উপস্থিত সবার মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। নেতা আজাদ রণে ভঙ্গ দিচ্ছে এবং নিজের চামড়া বাঁচানোর চেষ্টা করছে সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। সকালে হলো সালিস, আর বিকেল হতে না হতেই সব কিছু কেমন বদলে যাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে ফিস ফিস করে কথাবার্তা বলে কেউ কেউ সটকে পড়লো। অন্যেরা চোখে মুখে ভয় নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো নিজ নিজ জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

মহিলা সাংবাদিক ইতিমধ্যে নেতা আজাদের ছবি তুলে জনতার ছবি তোলার আয়োজন করছে। লোকজন হাত দিয়ে চেহারা আড়াল করে একে একে কেটে পড়তে লাগলো। দশ মিনিটের মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেল মাঠ। নেতা আজাদও গায়েব। শুধু আব্দুল হাকিমের ছেলে আর সতীশ পালের বউ কাঁদো কাঁদো মুখে বসে আছে মাঠে। তারা থাকবে, না চলে যাবে বুঝতে পারছে না। ছবি তোলার জন্য মহিলা সাংবাদিককে পীড়াপীড়ি করছে হিজড়া। তার একটা ছবি তুলে দিতে হবে। সাংবাদিকের সাথে সাথে এনজিও কর্মীরাও বিব্রত। তারা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে মোটর সাইকেলে চেপে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো। শুধু হাত বাঁধা অবস্থায় দুই বুড়ো বসে রইল স্কুলের বারান্দায়।

এক ঘণ্টা পর থানার দারোগা হযরত আলীর নেতৃত্বে পিক আপে চড়ে ছয়জন পুলিশ এসে হাজির। এই দারোগার স্ত্রী কয়েকমাস আগে আর এক দারোগার সাথে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে হযরত আলীর কথাবার্তা একটু আউলা ঝাউলা। দুই ছেলের মা এভাবে তার স্বামী সন্তান ফেলে পালিয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। স্ত্রী শোক কাটিয়ে উঠলেও হযরত আলীর কথাবার্তা চলাফেরার কোন সিরিয়াল নাই। থানা থেকে বেরিয়ে কখন কী কাজে যাচ্ছেন ঠিকঠাক মনে রাখতে পারেন না। এক তদন্তে বেরিয়ে আর এক তদন্ত করে আসেন। দোকানে চা খেয়ে ভুল করে চায়ের দাম দিয়ে দেন। এরকম ভুলভাল তার লেগেই থাকে।

পিক আপ থেকে নেমে ফাঁকা মাঠে হযরত আলী ভীষণ হম্বিতম্বি শুরু করলেন। মাঠের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত অহেতুক হাঁটাহাঁটি করে স্কুলের বারান্দায় আসামীদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। হাতের ছড়ি সাঁই সাঁই করে শূন্যে ঘুরিয়ে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে ব্যাটা তোরাই সেই দুই চোর?’
সতীশ পাল ও আব্দুল হাকিম আরও জড়োসড়ো হয়ে পরস্পরের গা ঘেঁসে বসলো। সেপাইদের একজন বললো, ‘স্যার, এটা তো চুরির কেস না। ওসি স্যার বলছিলেন একটা সালিসে নাকি এদের...............।’
‘শাট আপ!’ হযরত আলী দারোগা ধমক দিয়ে বললেন, ‘গ্রামের লোকজন হাত বেঁধে বসিয়ে রেখেছে এদের। আর তুমি বলছো এরা চুরি করেনি! আসামীর হয়ে সাফাই গাইছো তুমি? এর মধ্যেই মাল খেয়ে ফেলেছ?’
‘এসব কী বলছেন স্যার?’ প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম হলো সেপাইটির।
‘স্টপ! ফুল স্টপ! একদম কথা বলবে না। আমি নিজে পুলিশ, আর তুমি আমাকে পুলিশ চেনাচ্ছো?’

ভুরু কুঁচকে চোখের কোনা দিয়ে আব্দুল হাকিমের ছেলে আর সতীশ পালের বউকে দেখে ফেলেছেন হযরত আলী। সেপাইদের তিনি ইঙ্গিত করলেন ওদের ধরে আনার জন্য। দু’জন সেপাই গিয়ে ধরে নিয়ে এলো ওদের। হযরত আলী ছড়ি হাতে ওদের চারপাশে দু’বার চক্কর দিয়ে এসে ফৌজি কায়দায় বুক টান করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁত দিয়ে আঙ্গুলের নখ খুঁটতে লাগলেন তিনি। মনে হচ্ছে এই বালক আর আধবুড়ো মহিলাটি তার জন্য বিরাট সমস্যা সৃষ্টি করেছে। তারা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে হযরত আলীর দিকে। সেপাইরাও তটস্থ। দারোগা সাহেব স্ত্রী শোকে মাথা আউলা মানুষ। কখন কী করেন বুঝা মুশকিল।

নেতা আজাদ পালিয়ে গিয়ে ইতিমধ্যে মোবাইল ফোনে ঘটনা জানিয়ে দিয়েছে চেয়ারম্যান সাহেবকে। শাস্তি প্রদান অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য চেয়ারম্যান সাহেব তার লোকজন নিয়ে রওনা হয়েছিলেন। নেতা আজাদের ফোন পেয়ে তিনি অট্টহাসি দিয়ে বললেন, ‘অমন দু’চারটা সাংবাদিক আর এনজিওর লোক আমার পকেটে থাকে, বুঝলি? ওসব নিয়ে মাথা ঘামাস না আজাদ। সব কিছু রেডি করে ফেল। আমরা আসছি।’
‘কিন্তু ওরা চলে যাওয়ার পর পুলিশ এসেছে।’
‘পুলিশ? পুলিশ কেন আবার এর মধ্যে? ওরা কখন এলো?’
‘ওই তো বললাম না এনজিওর লোকেরা চলে যাওয়ার পর পুলিশ এসেছে। আমরা দূর থেকে ফলো করছি ওদের।’
‘তো পুলিশ কী করছে ওখানে?’ জোঁকের মুখে লবন পড়ার মতো দুর্বল কণ্ঠস্বর চেয়ারম্যান সাহেবের। এই পুলিশ জাতটা বড় ঠ্যাঁটা। ছাই দিয়ে রশি পাকায়।
‘ওরা স্কুলের বারান্দা থেকে আসামীদের গাড়িতে তুলেছে। এখন দেখা যাচ্ছে ওরা সতীশের বউ আর হাকিমের ছেলেকে হ্যান্ডকাফ দিয়ে গাড়িতে তুলছে।’
‘কী বলছিস তুই?’
‘যা দেখছি তাই বলছি চেয়ারম্যান সাহেব। সেপাইরা জুতার মালা দুটো কোলে নিয়ে বসে আছে পিক আপে। মনে হয় আলামত হিসাবে জব্দ করেছে।’
‘বলিস কী? আচ্ছা, ইমাম সাহেব কোথায়?’
‘উনি পালিয়েছেন। গ্রামের বেশির ভাগ পুরুষ মানুষ পালিয়ে গেছে। আমরা শুধু চার পাঁচজন সাহস করে এখনো আছি। মহসিন মাস্টারের বাড়ির পেছনে রান্নাঘরের টালির ছাদে উঠে দূরবীন দিয়ে সব দেখছি।’
‘দূরবীন? দূরবীন কোথায় পেলি?’
‘গত বছর চড়কের মেলায় লটারি খেলে পেয়েছি।’
‘দাম কত রে? সব পরিস্কার দেখা যাচ্ছে?’
‘দাম তো জানি না। হাঁ, পরিষ্কারই তো দেখছি।’
‘আচ্ছা, তুই ফোন রাখ।’ চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, ‘আমি থানায় যাচ্ছি। দেখি কী করা যায়। দেশটা তো এখনো মগের মুল্লুক হয়ে যায়নি।’

সন্ধ্যের পর থানায় হাজির হয়েছেন চেয়ারম্যান মোকছেদ আলী। ওসির চেম্বারে বসে আছেন তিনি। এনজিওর সেই দুই কর্মী ও মহিলা সাংবাদিকও হাজির। এদিকে দারোগা হযরত আলী চেম্বারের মেঝের ওপর চিত হয়ে চোখ বুঁজে শুয়ে আছেন। পুরাতন মৃগী রোগে মূর্ছা গেছেন তিনি। সেপাইদের চামড়ার বুট জুতা তার নাকে ধরে শোঁকানো হচ্ছে। ওসি সাহেব আশ্বাস দিচ্ছেন পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। হলোও তাই। হযরত আলী জ্ঞান ফিরে পেয়ে একদম সুস্থ মানুষের মতো ওসি সাহেবের পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। চেয়ারম্যান সাহেবের লোকজন থানার বারান্দায় গুণ্ডাপাণ্ডার মতো মুড নিয়ে ঘোরাফিরা করছে।
সতীশ পাল, আব্দুল হাকিম ও তার ছেলে থানার পুরুষ হাজতে বসে নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে। মহিলা হাজতে সতীশ পালের বউ গরাদের শিক ধরে মাথা নিচু করে সুরেলা গলায় কাঁদছে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে ফেন্সিডিল ব্যবসায়ী এক মহিলা বার বার বিরক্ত করছে তাকে, ‘কয় বোতল নিয়া ধরা খাইছেন খালা? কন না ক্যান?’

‘আপনারা বলছেন ওদের ছেলে মেয়ে প্রেম করে পালিয়ে যাওয়ায় গ্রাম্য সালিসে বিচার করে ওদেরকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল সেখানে?’ ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন ওসি সাহেব।
একজন এনজিও কর্মী বললো, ‘জি হাঁ।’
‘কিন্তু আমার এস আই সাহেব বলছেন ওরা জুতা চুরি করেছে। তাই গ্রামের লোকজন ওদের পাকড়াও করে হাত বেঁধে বসিয়ে রেখেছিল।’
‘ইয়েস! দে আর জেনুইন জুতাচোর।’ একজন সেপাইকে জুতাগুলো আনার জন্য ইশারা করলেন হযরত আলী। বললেন, ‘হযরত আলী প্রমান ছাড়া কোন কেসে হাত দেয় না।’
সেপাই জুতার মালা গুলো নিয়ে এলে ওসি সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘এতগুলো জুতা স্যান্ডেল চুরি হলো, অথচ একটা বাড়ির লোকও টের পেল না? এটা কেমন কথা?’
‘স্যার।’ হযরত আলী মুচকি হেসে বললেন, ‘বাড়ি থেকে তো চুরি করেনি ওরা। মুসল্লিরা যখন নামাজ পড়ছিল, তখন মসজিদের বারান্দা থেকে জুতাগুলো চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছিল হারামজাদারা। দেখতে পেয়ে গ্রামের লোকজন ওদের ধরে ফেলে। কী সোলেমান, ঠিক কী না?’
জুতার মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেপাই সোলেমান খুব কষ্টের সাথে মাথা নেড়ে সায় দিল।
মহিলা সাংবাদিক বললো, ‘আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে এস আই সাহেব। আমাদের কাছে যা ইনফরমেশন আছে, তাতে এটা জুতা চুরির কোন কেসই না। ওই যে সতীশ পালকে দেখছেন, ওর ছেলের সাথে আব্দুল হাকিমের মেয়ে পালিয়ে যাওয়ায় গ্রামের লোকেরা সতীশ পাল আর আব্দুল হাকিমকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করছিল। চেয়ারম্যান সাহেব সালিস ডেকে বিচার করেছেন। ওনাকেই জিজ্ঞেস করুন না।’
চেয়ারম্যান সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, ‘আপনি কোন্ সালিসের কথা বলছেন, বলুন তো। আমার ইউনিয়নে একুশটা গ্রাম। প্রতিদিনই একটা না একটা সালিসে আমাকে যেতে হয়। মারামারি, পিটাপিটি, বউ তালাক, হিল্লা বিয়ে, আইল কাটা, কলা চুরি, গরু চুরি সালিসের কী শেষ আছে? আমরা সালিসে এসব মীমাংসা করে দেই বলে থানায় মামলা মোকদ্দমা কম হয়। তা’ না হলে ওসি সাহেবরা বাথরুমে যাওয়ার সময় পেতেন না। কী ওসি সাহেব, ঠিক না?’
ওসি সাহেব বললেন, ‘তাহলে আপনি বলছেন এরকম কোন সালিস হয়নি?’
‘আমার তো মনে পড়ছে না।’

এই সময় হযরত আলী দারোগা চেয়ার ছেড়ে উঠে হাজত ঘরের সামনে গিয়ে কষে ধমক লাগালেন আসামীদের, ‘এই ব্যাটা, তোরা চুপ করে আছিস কেন? জুতা চুরি করেছিস কী না ওসি স্যারকে বল।’
পঁচিশ ঘা বেত, পাঁচ হাজার টাকা ফাইন আর মুখে চুনকালি মেখে জুতার মালা পরে গ্রামে ঘোরার চেয়ে মসজিদের জুতা চুরির অভিযোগ কবুল করে এক মাস জেল খেটে আসা অনেক ভালো। জুতা তো আর তারা সত্যি সত্যিই চুরি করেনি। গ্রামের সবাই সেটা জানে। মিথ্যে মামলায় সাজা হলে তারা বরং গ্রামের লোকের কাছে সহানুভূতিই পাবে। অশোক আর ফাতেমার ব্যাপারটাও ধামাচাপা পড়ে যাবে। ভিলেজ পলিটিক্সের এসব হিসাব নিকাশ হযরত আলী দারোগা তাদেরকে আগেই বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই সতীশ পাল ও আব্দুল হাকিম হযরত আলীর ধমক খেয়ে সমস্বরে চিৎকার করে বললো, ‘হাঁ স্যার, আমরা জুতা চুরি করেছি।’
চুরির দায়ে স্ত্রী পুত্রসহ সতীশ পাল ও আব্দুল হাকিম পরদিন সকালে কোর্টে চালান হয়ে গেল। আলামত হিসাবে জুতা স্যান্ডেল গুলো বস্তায় ভরে কোর্টের মালখানায় জমা দেওয়া হলো।

ওসি সাহেব হযরত আলী দারোগাকে ডেকে বললেন, ‘এখন সাক্ষী সাবুদ জোগাড় করে মামলার চার্জশীট তৈরি করেন।’
হযরত আলী একগাল হেসে বললেন, ‘এসব নিয়ে আপনি একদম ভাববেন না স্যার। মামুলি জুতা চুরির মামলা। ও আমি সব ম্যানেজ করে নেব।’ তারপর ওসি সাহেবের কানের কাছে মুখ নিয়ে হযরত আলী ফিস ফিস করে বললেন, ‘ভাবতে পারেন স্যার, আসল ঘটনায় কেস হলে কী ভয়ানক অবস্থা হতো। গ্রামসুদ্ধ সব লোককে আসামী করতে হতো। চেয়ারম্যান, মেম্বার, মসজিদের ইমাম সবাইকে এনে ঢোকাতে হতো গারদে। তার ওপর হিন্দু মুসলমান সেন্টিমেন্ট। দাঙ্গা লেগে গেলে সামাল দেওয়া মুশকিল হতো। এসপি ডিআইজির কাছে কৈফিয়ত দিতে দিতে জান বেরিয়ে যেত। চাকরি করাই.........।’
‘স্টপ! প্লিজ স্টপ!’ চাকরি চলে যাওয়ার কথা শুনলে ওসি সাহেবের মাথা ঠিক থাকে না। তবে পরে তিনি ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলেন হযরত আলীর কথাই ঠিক। বিরাট ঝামেলা থেকে বেঁচে গেছেন তিনি। গ্রামের লোকজনও বেঁচে গেছে মামলা মোকদ্দমা থেকে।
আর সতীশ পাল ও আব্দুল হাকিম তাদের বউ ছেলে নিয়ে এক মাস পর জামিনে মুক্ত হয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ওপরওয়ালাকে ধন্যবাদ। শুধু মাথা কামানোর ওপর দিয়ে গেছে। ভাগ্যিস এই থানায় পাগলা দারোগা হযরত আলী ছিল।

এসব ভালো মনে হচ্ছে না শুধু এনজিওর সেই দুই কর্মী ও মহিলা সাংবাদিকের। তাদের মন খারাপ। নির্যাতিত মানুষ সত্যি কথা বলতে ভয় পায়, এর চেয়ে মন খারাপের বিষয় আর কী হতে পারে?
************************************************************************************************************************* রি-পোস্ট।
ছবিঃ নেট।

সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ১:২২
১৮টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×