এপ্রিলের ঘটনা।
আমার সদ্য MBBS পাস করা ডাক্তার বউ ইন্টার্ন হিসেবে মিটফোর্ড হাসপাতালে জয়েন করার ২দিন পরই করোনা আক্রান্ত রোগীর তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নেবার ফলে মিটফোর্ডে করোনা ছড়িয়ে পড়ে।
ইন্টার্নশীপে জয়েন করার ৩ দিনের মাথায়ই তাকে ঘরে ফিরতে হয়। তবে সঙ্গত কারনেই মনে ভয় বা সন্দেহ থেকেই যায় যে ইতিমধ্যে তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে পরেছেন কি না। এরই মধ্যে জানতে পারলাম তারই অন্য ২ ক্লাসমেট যারা কি না ওই রোগী'র চিকিৎসা যে ডিপার্টমেন্টে চলছিলো সেখানেই কর্মরত ছিলো এবং তারা পজেটিভ আসে। তাছাড়া আমার বউ'এর তখন হালকা জ্বর থাকার কারনে তার ভয়টা বেশী'ই ছিলো। আমি বিভিন্নভাবে তাকে অভয় দেবার চেষ্টা করলেও তা কাজ করছিলো না। তিনি হালকাভাবে বলতে চাইছিলেন যে আমাদেরও করােনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। ওনার হাসপাতালে ডিউটি করার কারনে, আর আমার ওনার সাথে বসবাস করার কারনে।
এভাবেই কাটলো প্রায় ৮দিন।
ওনার হালকা জ্বর ছাড়া আর কোন উপসর্গ ছিলো না, তাছাড়া আমার কোন ধরনেরই কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। তাই আমি বলতে চাইছিলাম: ৮ দিন পার হয়ে গেছে, কিছু থেকে থাকলে এতদিনে কিছু না কিছু প্রকাশ পেতোই।
আমি করোনা পরীক্ষায় ভিত ছিলাম এই ভেবে যে যদি আমাদের করোনা না থেকে থাকে, তবে যদি পরীক্ষা করতে গিয়ে হাসপাতাল থেকেই না আক্রান্ত হয়ে পরি!
সত্যি বলতে এই ভয়টা ওনার মধ্যেও ছিলো, তাই মন থেকে উনিও চাইছিলেন না বাইরে যেতে।
২১ এপ্রিল বিকাল, আমার ঠিক উপরের তলায় বসবাস করা বয়ষ্ক বাড়িওয়ালী (যারা কি না আমার মামা'র ফুফু শাশুরী, মানে সম্পর্কে আমার নানু) এবং ওনার পূত্রবধু যারা কিনা প্রায়ই আমার ঘরে গল্প করেতে বা বিভিন্ন কারনে এসে থাকেন, তারা আমার ঘরে আসলেন।
তিনি প্রেশার মাপলেন এবং শারীরিক কন্ডিশন নিয়ে আলাপ করলেন এবং আমাদের টোনা-টুনির সংসার নিয়ে গল্প করে গেলেন।
ওনারা চলে যাবার পর আমার বউ এবার জোর দিলেন, বললেন আমাদের টেস্ট করা প্রয়োজন।
নানু এলো, ওনার ডায়েবেটিজ, ওনার এবং নানার দুজনেরই হার্টের প্রবলেম আছে, আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার তাদের জন্য।
অন্তত তারা সতর্ক হতে পারবে।
তাছাড়া আমাদের পাশে থাকা মামা'র বাড়িও প্রায়ই যাওয় হয়, আবার তারাও আমার বাসায় আসেন, যেখানে মামার'ও ডায়েবেটিজ রয়েছে, তাদের জন্যই আমাদের পরীক্ষা করা জরুরী।
এবার মনস্থির করলাম যে আমরা পরীক্ষা করাবো।
এপ্রিলের ২২ তারিখ।
তখন মিটফোর্ডে পরীক্ষা হলেও যেহেতু মিটফোর্ড ইতিমধ্যে সংক্রমিত, তাই আমার ওয়াইফ বললেন পিজি'তে পরীক্ষা করাবেন।
প্রায় সব বিষয়ে পূর্ব পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে পছন্দ করা আমি ভাবলাম ভোরে চলে যাবো, যত তারাতারি যাবো, তত মানুষ কম থাকবে, তত রিস্ক কম।
ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে ৬টার মধ্যে বের হয়ে পরলাম, পৌনে ৭টা নাগাদ আমরা পিজিতে পৌছে গেলাম।
তবে পরিকল্পনার উপাদানগুলির মধ্যে ইম্পর্টেন্ট যে উপাদানটি বিবেচনায় আনতে ভুলে গিয়েছিলাম তা হলো হসপিটালে টেস্ট আসলে কয়টা থেকে শুরু হয়!
গিয়ে দেখি টেস্ট শুরুই হবে ৯:৩০ থেকে, তার মানে আমরা প্রায় পৌনে ৩ঘন্টা আগে চলে গিয়েছি!
তবে এত আগে গিয়েও দেখলাম সিরিয়াল বেশ লম্বা, আমাদের সামনে প্রায় ৫০-৬০ জন।
বউকে বোঝালাম যে আগে এসে ভুল করিনি, কষ্ট হলেও একটু পরে লাইন আরও বড় হয়ে যেতো (বউয়ের কাছে পরিকল্পনার ইজ্জত বাঁচানোর চেষ্টা আর কি)।
পৌনে ৯টার দিকে একজন হ্যান্ডমাইক দিয়ে বললেন লাইনে ডাক্তার-নার্স থাকলে তারা যেন সামনে আলাদা লাইনে চলে যায়, যাদের আগে টেস্ট হবে।
আমার বউ বললেন তুমিও চলো, আমি বললাম: কিন্তু আমিতো ডাক্তার বা নার্স কোনটাই নই!
তিনি বললেন সমস্যা হবে না, কিছু বলবে না, চলো।
কিন্তু আমি বললাম না, সমস্যা নাই, তুমি যাও, এটা ভালো দেখায় না।
আমার সাথের বসবাসের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝলেন আমি যাবার নই, তাই তিনি চলে গেলেন।
কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন আমি নিতিবান! অতি সৎ, যিনি কিনা সামান্ন প্রিফারেন্স প্রাপ্তির সুযোগটুকুও নিতে চান নি!
আসলে তেমন কিছুই নয়।
বলতে পারেন আমার চক্ষু লজ্জাটাই বেশি, মাঝে মাঝে এটাকে অতি বেশীই মনে হয়। আমি যাইনি যদি আমাকে লাইন থেকে বের করে দেয়! যদি কেউ কিছু বলে! যদি কেউ বাঁকা চোখে তাকায়!
যাই হোক, বউ চলে যাবার পর সামনে পেছনে অনেকেই থাকার পরও একা অনুভব করছিলাম।
লাইনে দাড়িয়েই কতজনকে দেখছিলাম কিভাবে পরে এসেও লাইনের মাঝে ঢুকে পরার নির্লজ্য অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।
২জনের সাকসেসফুললি ঢুকে পরার দৃশ্যও চোখে পরলো।
আমার ইমিইডিয়েট পেছনে দাড়ানো ৩ জন একই পরিবারের।
২ ভাই এবং তাদের বাবা।
ছেলে দুটোর হুজুর টাইপের লেবাস মানে মুখ ভড়া দাড়ি ও পাঞ্জাবি পড়া থাকলেও তারা চিরাচরিত হুজুর ছিলেন না। কথা-বার্তায় স্মার্ট, এবং বোঝাই যাচ্ছিলো তারা হয়তোবা ভার্সিটি পড়ুয়া কেউ হবেন। মাস্ক পড়া থাকলেও বোঝা যায় তারা দেখতেও সুশ্রী।
অন্য আরেকজনের লাইনের ভেতরে ঢুকে পরার সময় তারা প্রতিবাদ করলেন।
তাদের মধ্যে বড়জন ওই ব্যাক্তিকে বললেন: "আপনি এটা করতে পারেন না, আমি খেয়াল করেছি আরও অন্তত ২জন এভাবে ঢুকেছেন, তাদের কিছু বলিনি, তবে যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়"।
তাদের প্রতিবাদের সময় ভাষা বা শব্দ চয়ন শুনে তাদেরকে ভদ্রও মনে হলো।
এরই মধ্যে সেই হ্যান্ডমাইকওয়ালা আবার বলে গেলেন যাতে আমরা মিনিমাম ৬ফিট দূরত্ব নিয়ে দাড়াই।
সবাই ঢিলেঢালাভাবে তা করছিলেন।
এরই মধ্যে সেই দুই ভাই আরও তৎপর হলেন, উদ্যোগ নিলেন লাইন ঠিক করার, মিনিমাম দূরত্ব ঠিক করার।
ওই ভাইদের মধ্যে ছোট ভাইটি পেছন থেকে এসে আমার সাথে এক্সিডেন্টালি ধাক্কা খেলেন, আমার বা হাত এবং কাধের সাথে।
তিনি সরি বললেন, আমি মুচকি হেসে মাথা নেড়ে 'ইটস ওকে' বোঝালাম।
কিন্তু মনে মনে ঠিকই বিভিন্ন কথা মাথায় উকি দিচ্ছিলো।
কে জানে! তিনি যদি করোনা আক্রান্ত হয়ে থাকেন?!
এখানে যারা টেস্ট করতে এসেছেন, কেউ নিশ্চই শখে আসেনি! কোন না কোন ভাবে সম্ভাবনা বা শারীরিক অস্বস্তি থেকেইতো এসেছেন!
ক্রমেই চিন্তা ঘনিভুত হচ্ছিলো।
সিদ্ধান্ত নিলাম কথা বলতে হবে।
আগে কথা না বলা চিরাচরিত স্বভাব থেকে বের হয়ে কথা শুরু করলাম।
#কোথায় থাকেন আপনারা?
-টিকাটুলি।
#ও, যাত্রাবড়িতেতো সংক্রমন বেড়েছে, তাহলেতো টিকাটুলি যাত্রাবাড়ির কাছেই, রিস্ক অনেক।
-হ্যাঁ, আল্লাহ্ মাফ করুক সবাইকে। আপনি টেস্ট কেন করছেন? আপনাদের এলাকায় ধরা পড়েছে?
#না, ওয়াইফ ডাক্তার, মিটফোর্ডে ডিউটি করেছে, নিশ্চিত হবার জন্য টেস্ট করাচ্ছি। আপনারা কেন এসেছেন?
-আমার বড়ভাই ও দাদু পজেটিভ, হসপিটালে আছেন, তাই দেখতে এসেছি।
#কোন কিছুকি ফিল করেন? কোন সমস্যা হচ্ছে?
-ইদানিং মাথা ঝিমঝিম করছে, মনে হয় শরীরও ব্যথা করছে, আর অস্বস্তি লাগছে, হয়তো ভয় থেকে, নিশ্চিত হবার জন্য এসেছি।
(মনে মনে) লা হাওলা ওয়ালা....
কি বলছে এই ছেলে! মুখ দিয়ে আর কিছু বের হলোনা। কলিজার পানি শুকিয়ে যাবার অবস্থা! এই ছিলো কপালে!
যে ভয় পাচ্ছিলাম সেটাইকি হতে চললো? যেখানে বাঘের ভয়...
#আপনার আর আপনার এই ভাইয়ের কি অবস্থা?
-আমরা এখনো টেস্ট করাইনি, এই প্রথম এলাম। বাবা আগে করেছিলো, নেগেটিভ এসেছে, ডক্টর বললো আবার পরীক্ষা করতে, তাই এসেছে।
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে পকেটে থাকা হেক্সিসল স্প্রে'টা বের করে বাম দিকে অর্থাৎ যেখানে ধাক্কা লেগেছিলো পুরো হাত কাপড়ের উপর স্প্রে করলাম। বোতলের ৭০% শেষ করে ফেললাম, তাও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।
ইতিমধ্যে লাইন সামনে যেতে শুরু করেছে, সামনে আগাচ্ছি আর ভাবছি কি করা উচিৎ, কি করতে পারি!
বয়স অনুযায়ী কনফিডেন্স ছিলো যে হয়তোবা হলেও মরে যাবোনা, আর মরে যাবার ভয়ও পাচ্ছিলাম না।
হচ্ছিলো শুধু সবার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবার ভয়, অন্য সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবার ভয়, অন্য সবাই আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করবে সেই দৃশ্য দেখার ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছিলাম।
যখন লাইন প্রায় শেষের দিকে, একটু পরেই ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করবো, তখন ভাবলাম ওদের যথেষ্ট ভদ্র'ই দেখেছি, কথা-বার্তায় লজ্যিক্যাল মনে হয়েছে, তারা হয়তো ব্যপারটা ইজিলি'ই নিবে।
# ভাই কিছু মনে করবেন না, যেমনটা আপনিও বোঝেন, পরিবেশটা আসলে ওরকমই। আমি কি আপনার ফোন নাম্বারটা পেতে পারি?
আপনি জানেন করোনা খুব ইজিলি ছড়িয়ে পরে, জানিন কার কি অবস্থা, আমিও পজেটিভ হতে পারি, আপনিও হতে পারেন।
যেহেতু আমরা কয়েক ঘন্টা একসাথে দাড়িয়ে ছিলাম, এমনটা হতেই পারে যে আমাদের থেকে থাকলে তা এরই মধ্যে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে থাকতে পারে।
যখন রেজাল্ট দিবে, আমি জেনে নিবো যে আপনার কি অবস্থা ছিলো, আমিও জানাবো যে আমার কি অবস্থা।
আল্লাহ্ না করুন যদি আপনি পজেটিভ এসে থাকেন, তাহলে আমি না হয় আবারও ১০ দিন পর আবার চেক করবো।
আর যদি আপনি নেগেটিভ ও আমি পজেটিভ থাকি, তবে আপনিও ১০ দিন পর আবার চেক করে নেবেন।
প্রত্যাশিতভাবেই উনি ব্যপারটি সহজেই নিলেন, এবং ওনার ফোন নাম্বার আমাকে দিলেন এবং আমারটাও উনি নিলেন।
রাত ৮টার দিকে আমাদের দুজনেরই 'নেগেটিভ' রেজাল্ট এর ম্যাসেজ এলো।
সাথে সাথেই ফোন দিয়ে জানতে পারলাম ওনার বাবা এবং ভাইয়ের নেগেটিভ রেজাল্ট এসেছে, ওনারটা তখনও আসেনি!
কলিজা আরেক দফা শুকালো!
কারন যেমনটা শুনেছিলাম, পজেটিভ হলে রেজাল্ট খানিকটা দেড়ি করে আসে!
অবশেষে রাত ৯:৩৫ এর দিকে তিনি ফোন দিয়ে জানালেন ওনারও করোনা নেগেটিভ এসেছে।