আগের পর্ব
লাইজুর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল ইশরাতের ঘটনা শুনে। সে কি বলে উঠবে বুঝে উঠতে পারছে না। এই কারনে ইশরাত মনমড়া হয়ে থাকে। সে এখন কি উপদেশ দিবে ?
“তোর বাবাকে বলেছিস, যে তুই রাজী না?”
“না, আমাদের কথা শুনলে তো। আব্বা তো আম্মার কথাও কানে নেন না।”
“তো কি করবি?”
“জানিনা, আমার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কি করব তার দিশে খুজে পাচ্ছি না।”
“রেহান ভাই জানে?”
“না জানলে তো তারও মাথা নষ্ট হয়ে যাবে, গত কয়েকদিন যাবত তো ওর ফোনও ধরছি না আমি।”
“জানি, এই জন্যি রেহান ভাই আমকে জিজ্ঞেশ করেছে তোর কথা,” এই বলে লাইজু জানালার দিকে তাকাল। তাদের স্কুলের পাশেই কলেজ, সেখানে রেহান ভাই পড়ে। রেহান ভাই ইশরাতের বয়ফ্রেন্ড, বাংলা কথায় তার প্রেমিক।
দুইদিন আগে রেহান লাইজুর কাছে এসে ইশরাতের কথা জিজ্ঞেশ করে। সে জানায় বেশ কয়েকদিন যাবত ইশরাত তার ফোন ধরছে না, এমন কি দেখাও পর্যন্ত বন্ধ। সে লাইজুর কাছে জিজ্ঞেশ করে যে ইশরাতে সমস্যা কি, সে দেখাও করে না আর ফোনও ধরে না। এ নিয়ে সে অনেক দুশ্চিন্তায় আছে।
আসলেই রেহান ভাই দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে। তার ধারনা ইশরাত কোনো সমস্যা মধ্যে আছে,নাহলে সে তাকে এড়িয়ে চলত না। আসলেই সে অনেক বড় সমস্যার মধ্যে আছে। লাইজুর কোনো ধারনাই নাই সে কিভাবে সাহায্য করবে ইশরাতকে।
লাইজু কলেজের দিকে তাকাতে লাগল, যদি রেহান ভাইয়ের সাথে দেখা পায়। কিন্তু নিচতলা থেকে হট্টগোলের আওয়াজ পাওয়া গেল। লাইজু কিছুটা বিরক্ত হল, মাঝে মাঝে কলেজ ছেলেদের ফাজলামি তার কাছে বিরক্তকর লাগে। তার মতে, এত বড় হল তারা তারপরেও বাচ্চাদের মত আচরণ করা শুরু করে। অবশ্য স্কুলেও কম নাই এই ধরনের ছেলে-পেলেদের।
ফর্সামত ছোটখাট এক স্যার এসে পড়ল। সে এক ক্লাসরুমে ঢুকে পড়ল, তারপর হট্টগোল বন্ধ হয়ে গেল। স্যারও একটু পড়ে বের হয়ে আসল, স্যারের সাথে এই কলেজের ছাত্র, মনে হয় রানা নাম হবে তার। সে স্যারের সাথে কি যেন কথা বলছে।
লাইজুর আগ্রহ ছিল কি কথা হচ্ছিল দুজনের মধ্যে, কিন্তু তার ছোট বোন এসে পড়ায় সেটা বিঘ্নিত হল। তার ছোট বোনের সাথে একটা ছেলেও এসেছে, সে বিরক্তির চোখে দুজনের দিকে তাকাল।
*
রাতুল খুবই মনোযোগের সাথে তার পাশের জনের খাতা থেকে বাড়ীর কাজ তুলে নিচ্ছে। গতকাল রাতে একটা চরম গেমস খেলছিল সে, অবশ্যি কানে হেডফোন লাগিয়ে। আগে একটা ছিল সে ছোট খালা মানে রুনা নিয়ে গেছে, সে মোবাইলের হেডফোন দিয়ে গেমস খেলেছিল, এই কারনে বাড়ী কাজ করা হয় নাই, আর সমাজ ম্যাডাম খুবই ঘোড়েল ধরনের। বাড়ীর কাজ না করলে ‘মুরগী’ বানিয়ে রাখে।
স্কুলে ছেলেরা একপাশে আর মেয়েরা আরেক পাশে বসে। রাতুল অবশ্যই এমনভাবে বসে যেতে তার পাশে মেয়েরা বসে। রাতুলের পাশের বেঞ্চে হৃদি বসে। আগে সে হৃদির প্রতি কিছুটা আগ্রহবোধ করত, কিন্তু এখন আর করে না। তারপরেও তারা এখনো একসাথেই থাকে।
“ওই, রাতুল,” হৃদি রাতুলকে ডাক দিল।
“আমি ব্যস্ত, পরে কথা বলব।”
“মেঘার ব্যাপারে কথা ছিল।”
মেঘা তাদের পাশের ক্লাসে পড়ে। রাতুলে এখন মেঘার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। রাতুল খাতা বন্ধ করে হৃদির দিকে তাকাল।
“তার শখ কি? তার পছন্দের খাবার কি? সে কাউকে পছন্দ করে কিনা?” রাতুল এক নাগাড়ে হৃদিকে প্রশ্ন করে গেল।
হৃদি কিছু না বলে সিনেমার ভিলেনের মত মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “কেন তুমি না ব্যস্ত!”
“আরে ব্যস্ততার খ্যাতা-পুড়ি।”
“একটা মেয়ের সামনে অভদ্র মার্কা কথা, সরি বল।”
রাতুল রাগে নিজের ঠোট কামড়ে ধরল। হৃদি মেয়েটাকে সে চিনতে ভুল করেছিল। ভদ্র চেহারা দেখে মনে হয়েছিল মেয়েটা কিছু বোঝে না, কিন্তু এই মেয়ে তাকে সাতঘাটের পানি খাইয়ে দিয়েছে।
রাতুল বিড়বিড় করে বলে উঠল, “সরি।”
“শুনতে পাই নাই আমি,” হৃদি বলে উঠল।
“কানা শুনতে পাও না নাকি, বলেছি আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ করেন,” রাতুল এবার জোর গলায় বলে উঠল।
“এমনভাবে বললে যেন আমি একটা ফকির।”
হৃদির কথা শোনার পর রাতুল কিছু বলতে যাবে তখন কে যেন বলে উঠল, “ডিস্কো বান্দর আবার শুরু করছে।”
রাতুল এবার চটাং করে দাঁড়িয়ে গেল, “আমাকে ডিস্কো বান্দর বলল কে?”
তখন সামনের বেঞ্চ থেকে একটা ছেলে বলে উঠল, “সারাদিন দেখি তো বান্দরামি করতে, আর আমাদের ক্লাসে আরেকটা বান্দর আছে।”
“আমি বানর না।”
“তোমারে বানর কে বলছে, বলছে তো ডিস্কো বান্দর।”
হৃদির এই কথা শুনে ক্লাসে হালকা হাসির আওয়াজ শোনা গেল, রাতুল চেচিয়ে কিছু বলে বলতে যাবে তখনই সমাজ ম্যাডাম ক্লাসে এসে হাজির। ম্যাডামকে দেখে রাতুলের মাথায় হাত। সে এখনো বাড়িকাজ সম্পুর্ন করে নাই।
ফলাফল একই হল, কিছুক্ষন পর রাতুলকে মুরগী সাজতে হল সবার সামনে। অবশ্য সে একা নয় তার সাথে আর দুজন ছিল।
মিনিট পনের পর যে যার জায়গায় ফিরে গেল। রাতুলের ফর্সা চেহারা পুরো লাল হয়ে আছে মুরগী হয়ে থাকার কারনে। সে কোনোদিকের না তাকিয়ে নিজের বেঞ্চে বসে আছে। সমাজ ম্যাডাম বোর্ডের দিকে তাকিয়ে কোন এক মহাদেশের মানচিত্র আকছে। চক আর বোর্ডের সংঘর্ষে হালকা কিচ কিচ আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না।
অন্যকোনো আওয়াজ না পাওয়া গেলেও, যে ছাত্র-ছাত্রীরা চুপচাপ বসে মানচিত্র আকছে তা নয়। রাতুলের পাশের ছেলেটা খাতায় তাড়াতাড়ি একটা মানচিত্র ছাপ দিয়ে আকা শেষ করে এখন একটা তিন গোয়েন্দার বই নিয়ে বসে আছে। পিছনের দুই ছেলে বেঞ্চে পেন্সিলের দাগ কেটে তিন গুটি খেলছে।
রাতুল এসব কিছু না করে সে চুপচাপ বসে আছে। সে রাগে নয় হতাশায় চুপ করে বসে আছে। ক্লাসের সবাই ডিস্কো বান্দর খেতাব দিয়েছে তারপর সবার সামনে মুরগী হয়ে থাকতে হয়েছে।
“ওই রাতুল মন খারাপ নাকি?”
হৃদি এই কথা শুনে রাতুলের সারা শরীর এবার জ্বলে উঠল। এই ‘চুরাইল’ এর কারনে তাকে আজকে মুরগী হতে হয়েছে। যার কারনে এত ভুগতে হল সে যদি এখন মায়া দেখায় তাহলে গা কিছুটা জ্বলবেই। হুম, গরু মেরে জুতা দান, এটা হবে না, মনে মনে বলল রাতুল। তাকে পাত্তা দিবে না মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিল রাতুল।
“সমাজ ক্লাস শেষ হবার পর আমরা আমার আপুর ক্লাসে যাব,” হৃদির এই কথা শোনার পর, রাতুল বুঝতে পারল এই মেয়ের মনে কোন দয়া মায়া নেই।
“আমি পারব না,” ফিস ফিস করে রাতুল জানিয়ে দিল।
রাতুলের জবাব শুনে হৃদি চোখ বড় করে তার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। সে রাতুলে দিকে তাকিয়ে থাক্ল, রাতুল তার দৃষ্টি সম্পূর্ন উপেক্ষা করে খাতার দিকে মনোযোগ দিল। হৃদি আর কি করবে সেও নিজের খাতার দিকে মনোযোগ দিল।
সমাজ ক্লাস শেষ।
হৃদি আর রাতুল দুজনই স্কুল করিডোর দিয়ে হাটছে। রাতুল নিজে অনিচ্ছায় যাচ্ছে। সমাজ ক্লাস শেষ হতেই হৃদি তাকে বলে তার আপুর ক্লাসে যেতে হবে।
“আমিতো আগেই বলেছি, যাব না।”
“তাহলে সুমনা আপুকে বিচার দিতেই হয়।”
“এখানে সুমনা আপুর কি সম্পর্ক?”
হৃদি একটু কিছুক্ষন চুপ করে তারপর বলল, “আমার আপু মনে হয় কোনো সমস্যায় আছে, আর সসার ক্লাবের সদস্য হিসেবে উচিত আমাদের সাহায্য করা।”
“তুমিই গেলে তো হয়।”
“না হয় না, আমি একা গেলে কিছুই হবে না। সহজ কথা আপু আমাকে পাত্তাই দিবে না।”
“যদি না যাই?”
“সুমনা আপুকে বলে দিব তুমি ক্লাবের ব্যাপারে উদাসহীন, তারপর তো বুঝতে পারছ কি অবস্থা হবে তোমার।”
রাতুলের অবস্থা হল ঢেকি গেলার মত। সে গোমড়া মুখে হৃদির পিছু নিতে বাধ্য হল।
হৃদির বড় বোনের ক্লাসরুমে ঢোকার পর সামনে বেঞ্চে দিকে বসা দুটো মেয়ের দিকে চোখ গেল রাতুলের। হৃদিও সেদিকে যাচ্ছে, এর মধ্যে একজন কিছুটা মনমরা হয়ে বসে আছে, আরেকজন জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা কাছে যেতেই মনমরা মেয়াটা তাদের দিকে তাকাল, হৃদির দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিল আর জানালার দিকে তাকিয়ে থাকা মেয়েটা এবার তাদের দিকে ফিরল, হৃদিকে দেখে তার ভ্রুটা কুচকিয়ে গেল।
*
আমার চার বেঞ্চ সামনে বসা দুইটা ছেলে দেখছি কখন থেকেই তর্ক করছে। ক্লাসের মোটামুটি সবাই বিরক্ত ওই দুইজনের উপর। আমিও ওই দুইজনের উপর বিরক্ত কিন্তু তাদেরকে পাত্তা না দেবারই চেষ্টা করলাম আমি। হাতে রাখা বইয়ের দিকে নজর দিলাম আমি। বেশীক্ষন মনোযোগ দিতে পারলাম না। দুজন প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেছে। সুমনা ওই দুইজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই, ক্লাসে মধ্যে মারামারি থামাও।”
ওই দুইটা সুমনার কথা কানেই নিল না। আমি এবার উঠে ওই দুজনের দিকে দিকে গেলাম। তাদের দিকে তাকিয়ে বললাম, “ক্লাসে মধ্যে মারামারি করে করে না, অন্য সবাই বিরক্তবোধ করছে।”
ওই দুইজন আমার কথা কানে নিলই না। দুজন দুজনের ঘাড় ঝাপটে ধরে আছে, কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না আর জলহস্তীর মত গোত গোত শব্দ করছে। আমি বুঝতে পারলাম এদের কানে এখন কোনো কথা যাবে না। আমি সুমনার দিকে তাকিয়ে বললাম, “কোনো স্যার-ম্যাডামকে ডেকে নিয়ে আসো, এই দুই জলহস্তীকে সামলানো সহজ ব্যাপার হবে না।”
সুমনা আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন চিন্তা করে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
সে চলে যাওয়ার পর আমি দুজনের দিকে তাকালাম, একজনে নেমপ্লেট দেখে বুঝতে পারলাম তার না মনি। দুজনের চেহারা পুরো লাল হয়ে আছে। কিছু একটা করা দরকার এই ভেবে আমি দুজনের নাক চেপে ধরলাম। ফলাফল হল মারাতক্ম, দুজন দুজনকে ছেড়ে দিল তারপর তারা আমরা উপর ঝাপিয়ে পড়ল, একজন আমার গালে চটাস করে থাপড় মারল আরেকজন আমাকে মারল ধাক্কা।
রনি নামের ছেলেটা বলে উঠল, “বেয়াদব ফাজলামি করিস আমাদের সাথে, কানপট্টি গরম করে দিব।”
চুরি তো চুরি তার উপর সিনাজুরি, আমার মাথা গরম হয়ে গেল। দুই মোটকার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।
বেশী না দুইটারে চার-পাচটা থাপর দিতেই সুড়সুড় করে ঠিক হয়ে গেল। ঠিক তখনই সুমনা এসে হাজির সাথে মিজান স্যার। সুমনা আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলে উঠল, “মারামারি থামাতে গিয়ে দেখছি তুমি নিজেই মারামারি শুরু করে দিয়েছ।”
আমি কিছু বললাম না। মিজান স্যার আমার দিকে এসে বললেন, “কি ব্যাপার মারামারি করেছ কেন? তুমি না ক্লাস ক্যাপ্টেন। আসো বাইরে আসো।”
আমি কি বলতে চাই সেটা না শুনে স্যার আমার বাইরে নিয়ে গেলেন। মোটকা দুইটা দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে একটা বাকা হাসি দিল।
“এখন বল কি হয়েছে?”
“ওই দুই জলহস্তী আগে মারামারি শুরু করেছিল…”
“জলহস্তী মানে?”
“মানে ওই দুইজন আগে মারামারি শুরু করেছিল। আমি থামাতে গেলাম তারা আমাকেই মেরে বসল।”
“তাই বলে তুমি মানুষকে জলহস্তী বলবে।”
“কি করব স্যার, তারা একে অপরকে ঝাপটে ধরে গোত গোত শব্দ করছিল। আরেকটু হলে সেটা অশ্লীল পর্যায়ে…”
“তাই নাকি?”
“জ্বী স্যার।”
স্যার আমার কথা শোনার পর কি যেন চিন্তা করলেন তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হুম আচ্ছা আমি দেখছি দুই জল… ছেলেকে আমার টিচারস রুমে নিয়ে এস তুমি।”
“নিয়ে আসব?”
“হ্যা, ক্লাসের মধ্যে মারামারি তারপর ক্লাস ক্যাপ্টেনের গায়ে তোলা, এর উপর…” স্যার চুপ মেরে গেল, “যাও নিয়ে এসো ওদের।”
মিজান স্যারের কথা অনুযায়ী, মনি আর তার সঙ্গীকে আমি ডাকতে গেলাম। তারা দুজন দেখি এখন ভদ্র ছেলের মত বসে আছে। আমি তাদের কাছে গিয়ে বললাম, “স্যার তোমাদের দুজনকে ডেকেছে।”
“কিসের জন্য ?” মনি পাশে বসা ছেলে বল উঠল, তার নাম আসাদ।
“সেটা স্যারকে গিয়ে জিজ্ঞেশ কর,” আমিও কাট কাট করে বলে উঠলাম, “যদি ইচ্ছা না থাকে বলে দাও আমি স্যারকে জানিয়ে দিই।”
“কি বলবে?” মনি এবার বলে উঠল।
“স্যারকে বলে দিব তোমরা আসতে পারবে না, স্যারকে তোমাদের কাছে আসতে বলেছ।”
“আমরা এই কথা কখনও বলি নাই, যাচ্ছি আমরা।”
“চলো তাহলে।”
আমি তাদের দুজনকে স্যারের রুমে নিয়ে গেলাম।
পর পর দুই পিরিয়ড অফ। প্রথমটা এমনি কোনো ক্লাস ছিল না, দ্বিতীয়টা আজকে জীববিজ্ঞান ম্যাডাম আসে নাই, তাই এখন সেটা অফ। আমি রনি আর রিপনকে স্যারের হাতে সমর্পন করে টয়লেটের দিকে ছুটলাম।
দশ মিনিট পর আমি ক্লাসের দিকে গেলাম। টয়লেট থেকে বের হবার পর আমি লায়লা ম্যাডামের সামনে পরে যাই। তিনি আমার দিকে তাকিয় জিজ্ঞেশ করলেন, “মিজান স্যারের কাছে শুনলাম মারামারি করেছ।”
“আরে না, মারামারি থামাতে গিয়েছিলাম, তখন তারাই আমাকে মেরে বসল। তাই আত্মরক্ষার জন্য ওদের হালকা চড়-চাপড় মেরেছি।”
“তাই !?”
“সত্যি,” আমি জোর গলায় বললাম।
“আচ্ছা ভাল, তা একটু টিচারস রুমে এস, আমার বাড়িকাজগুলো সরাতে হবে।”
কি আর করা তখন আমি ম্যাডামের পিছে পিছে গেলাম। যাই হোক এই মহিলাকে না বলা বুদ্ধিমানের কাজ না।
লায়লা ম্যাডামের কাজ সেরে নিজের ক্লাস দিকের যাচ্ছি, ক্লাসরুমের দরজার সামনে দেখলাম রাতুল দাঁড়িয়ে আছে। সে সুমনাকে কি যেন বলছে, সুমনাও উত্তেজিত হয়ে তার কথা শুনছে। ব্যাপার কি?
আমি তাদের কাছে যেতেই রাতুল উল্টো দৌড় দিয়ে বলল, “মামা টিফিন পিরিয়ডে কথা হবে, এখন আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে।”
“রাতুল কি বলে গেল?” আমি সুমনার দিকে ফিরে জিজ্ঞেশ করলাম।
“আমরা আমাদের প্রথম কেস মানে সমস্যা পেয়ে গেছি,” আমার দিকে বৃদ্ধা আংগুল তুলে গুডলাক চিহ্ন দেখিয়ে সুমনা বলে উঠল।
*
আমরা আমাদের চিরাচরিত জায়গায় বসে আছি। আমাদের সবাই আছে এর সাথে সাথে আর দুজন যোগ হয়েছে। দুজনই মেয়ে, একজন আবার হৃদির বড় বোন। এদের দুজনকে দেখে আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল কোথায় যেন দেখেছি।
আমাদের মাঝে এখন নিরবতা বিরাজ করছে। কিভাবে কথা শুরু করবে কেউ সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। সুমনাও উশখুশ করছে, বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। রুপার ক্ষেত্রেও একই কথা। তাদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে আমাকে দিয়েই শুরু করতে হবে। নির্জনতো আগেও মতই আছে আর সজল, তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক মজায় আছে। আমাদের অবস্থা তার কাছে বেশ উপভোগ্য মনে হচ্ছে। নুশরাত চোখ বুজে নিজের টিফিন বক্স থেকে খারা খেয়ে যাচ্ছে।
আমি রাতুলের দিকে তাকালাম, সে বিষদৃষ্টি নিয়ে হৃদির দিকে তাকিয়ে আছে। হৃদি সেটা না দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আরে বাপ কেউ কথা শুরু করো, আমি মনে মনে বলে উঠলাম।
তখনই ভদ্র চেহারা মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি ওইদিন যে তাক দেখিয়ে দিয়েছিলেন সেখানে অনেক ভাল বই ছিল।”
তখনই আমার এই দুজনের কথা মনে পড়ে গেল। আমি ভদ্র চেহারার মেয়েটার দিকে তাকালাম। বাঙ্গালীদের সাধারন চেহারা বলতে যা বুঝায় তার সব বৈশিষ্ট্য এই মেয়েটার মধ্যে বিদ্যমান। একটা আলাদা যে জিনিষ মেয়েটার মধ্যে আছে সেটা হল, তার চোখটা মায়াবী আর হাসিটা অনেক সুন্দর। যদিও আমার সামনে সে হালকা মুচকি হেসে কথা বলেছে।
“শুনে ভাল লাগল, তা তোমাদের মধ্যে কার কি যেন সমস্যা আছে?”
আমার কথা শোনার পর, ভদ্র চেহারার মেয়েটা চেহারাটা মনে কালো হয়ে গেল।
আমার কথার জবাব দিক তার পাশের জন, “ইশরাতের বাবা ইশরাতের জন্য বিয়ে ঠিক করেছে।”
হুম মেয়েটার নাম ইশরাত। আচ্ছা ‘রাত’ যে মেয়ে নামের পিছনে আছে তারা কি একই ধরনের হয় নাকি! যেমন আমাদের নুশরাত, তার চোখ আর হাসি দুটোই অনেক সুন্দর। নুশরাত অবশ্য ইশরাতের চেয়ে সুন্দরী। ওই কথা বাদ যাক, মেয়েটা কি সমস্যা নিয়ে এসেছে, বিয়ে?
আমার চোখে প্রশ্ন দেখে তার পাশের জন বলে উঠল, “হ্যা, বিয়ে ঠিক করেছে। এর সমস্যার সমাধান কি?”
মেয়েটা এমন ভাবে কথা বলল যেন আমরা সমস্যা সমাধানের হাড়ি সাজিয়ে বসে আছি। আসলে আর দিয়ে দিলাম!
“বাপ কে যেয়ে বলো, আমি বিয়েতে রাজী না,” আমি ঠাস করে বলে উঠলাম।
মেয়েটা আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে থাকল। ভাল কথা মেয়েটার নাম এখনো জানি না আমি।
“তোমার নাম কি এখনো জানাও নি,” নুশরাত বলে উঠল।
“আমি লাইজু, হৃদির বড় বোন।”
“ও আচ্ছা, আমি নুশরাত, আমার ডান পাশের জন সুমনা আর সুমনার পাশের জন নির্জন। বাম পাশে রুপা, তার পাশের জন সজল, আর আমাদের উল্টো পাশে যে বসে আছে তার নাম রানা।”
“ ‘মাসুদ রানা’ ?”
“না, রেদোয়ান হক রানা,” আমি বলে উঠলাম।
এবার গলা খাকারি দিয়ে রুপা বলে উঠল, “তা তোমাদের সমস্যারকথা বল।”
“আগেই তো বলেছি, ইশরাতের বিয়ে ঠিক করেছে তার বাবা। ইশরাত সেই বিয়েতে রাজী না।”
লাইজুর এই কথা শোনার পর সবাই চুপ হয়ে গেল। আসলে এই বিষয়ে নিয়ে তেমন কোনো কথা বলা যায় না। আঠারো বয়সের নিচে মেয়েদের বিয়ে আমাদের দেশে নিষধ করলেও এখনো অনেক জায়গায় আঠারো নিচে মেয়েদের বিয়ে অনেক ধুমধাম করে আয়োজন করা হয়।
“পরিবারের সবাই কি রাজী?” আমি ইশরাতের দিকে তাকিয়ে জিগেশ করলাম।
“আম্মা কিছু বলছে না, আর আব্বাও আম্মার কথা কানে তুলে না।”
“মানে তুমি বলতে চাচ্ছ। তোমার আব্বাই সব ব্যাবস্থা করেছেন নাকি?”
“হ্যা, আব্বার কথায় ছেলে ডাক্তার। আমাকে প্রথম দেখায় সে পছন্দ করে ফেলেছে। আর আব্বার কথা হল এমন ছেলে সহজে পাওয়া যাবে না, অনেক বড় ঘরের ছেলে নাকি সে।”
“তুমি কি বল?” এবার সুমনা জিজ্ঞেশ করে উঠল। এতক্ষন সে চুপ করে ছিল।
“আমি প্রস্তুত না, আমার একটা স্বপ্ন আছে, আমি সেটা পূরন করতে চাই,” ইশরাত বলে উঠল, “ছেলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বিয়ের পরেও তারা আমাকে পড়াশোনা করতে দিবে, আমার ধারনা ইন্টার পাশ পর্যন্ত।”
মেয়েটার দূরদৃষ্টি মনে হয় অনেক ভাল। মেয়েটার প্রতি আমি একটা শ্রদ্ধা অনুভব করলাম কিন্তু এখানে আমাদের কিছু করার নেই। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে, তাও আমার পরিবারের থেকে। বর্তমানে নারী স্বাধীনতা, নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য গুটি কয়েক মহিলা মুখে ফেনা তুলে ফেললেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। একটা মেয়ে নিজের মত করে থাকবে সেটা অনেকেই মেনে নিতে পারে না। আমাদের গুরুজনদের মতে মেয়েরা পূর্নাঙ্গ হলেই বিয়ে দিয়ে দাও পরে বয়েস হয়ে গেলে পাত্র খুজে পাওয়া যাবে না।
আর আমরা ছেলেরাও কম না, কচি জিনিষ ছাড়া আমাদের চলে না। তিরিশ বছরের লোককে দেখা যায় আঠারো বছরের মেয়ে খুজতে। তাদের মতে কম বয়সী মেয়ে হলে অনেক ভাল হয়।
ঘন্টার আওয়াজে আমার হুশ ফিরল, সবাই দেখলাম সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। কারো মুখ কোনো কথা নেই। সুমনাও কেমন জানি চুপ মেরে গেছে, কিন্তু টিফিন পিরিয়ডের আগ পর্যন্ত সে উত্তেজিত ছিল। তার চেহারা দেখে ভালভাবেই বোঝা যায় সে এখন দিশেহারা বোধকরছে।
“তোমার বাবা কে বলে দেখ,” সুমনা বলে উঠল।
“লাভ হবে না, আব্বা খুব কড়া মেজাজের মানুষ। উনার কথা ঠিক মত পালন না হলে উনার মাথা একদম নষ্ট হয়ে যায়।”
“তোমার মা?”
“আম্মার কথা আব্বা কানেই নেন না, তিনি যা বলেন সেটাই। আম্মাও মুখ বুজে সব সহ্য করেন। মামারাও থাকলে ভালো হত কিন্তু তারা এখন উমরাহ হজ্ব করতে গেছেন।”
ইশরাতের কথা শোনার পর সুমনার মুখ এবার অন্ধকার হয়ে গেল। সে কিছু না বলে মাথা নিচু করে হাটতে লাগল। নির্জন সুমনার দিকে একবার তাকিয়ে তারপর আমার দিকে তাকাল। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা বলতে চায়। আমি পাত্তা না দেয়াই ভাল মনে করলাম।
আমি যখন ইশরাতের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, সে বিড়বিড় করে বলে উঠল, “যদি আম্মা ছোট বেলার মত জেদী হত তাহলে কিছু একটা করা যেত।”
“তোমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?”
আমার এই হঠাৎ প্রশ্ন শুনে ইশরাত চমকে গেল। সে আমার দিকে গোলগোল চোখে তাকিয়ে রইল। তার চেহারার ভাব দেখে বোঝা গেল, আছে।
“সে কি জানে?”
আমার এই প্রশ্নের জবাবে সে মাথা নাড়াল। না জানিয়ে ভালো করেছ, মনে মনে বললাম আমি।
“তোমার আম্মা কি খুব রাগী ধরনের মহিলা?”
আমার তাল ছাড়া প্রশ্নে পড়ে মেয়েটা মনে হয় কিছুটা দিশেহারা হচ্ছে। সেটা চোখে মধ্যে ফুটলেও চেহারার মধ্যে সে আনছে না। আসলেই মেয়েটা অনেক শক্ত ধরনের, একে হজম করা অনেক কঠিন হবে।
“আমি আম্মাকে কোনোদিন রাগতে দেখি নাই, তবে শুনেছিলাম ছোটবেলায় সে নাকি অনেক জেদী ছিল,” ইশরাত বলতে থাকল, “আমার মামারা প্রায়ই বলত আমার আম্মা নাকি বিয়ের পর কেমন জানি নরম হয়ে গেছে।”
“হুম,” এই বলে আমি চুপ করে গেলাম।
ইশরাত আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, মনে হয় আরো প্রশ্নের আশা করছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন করা শেষ হয়ে গেছে। এবার খেয়াল করলাম আমরা সবার পিছনে আছি। আমাদের সামনে নুশরাত, সজল আর রুপা তিন জনে কি যেন নিয়ে তর্ক করছে। নির্জন আর সুমনা চুপচাপ হাটছে। সবার সামনে রাতুল লাইজু নামের মেয়েটাকে কি যেন বলেছে, লাইজু রাতুলের কথা শুনছে আর আমার দিকে তাকাচ্ছে, একই কথা যায় হৃদির ক্ষেত্রেও। কি জানি কি কথা বলছে আমার নামে?
*
“তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তোমার মামা কিছু একটা করতে পারবে,” লাইজু বলে উঠল।
“পারবে যদি তার ইচ্ছা হয়,” রাতুল বলে উঠল, “আমিতো আমার সাথে আছি অনেক দিন চিনি ওকে।”
“আমারও মনে হয় উনি পারবে,” হৃদি বলে উঠল, “উনাকে দেখলেই বোঝা যায়।”
হৃদির এই কথা শুনে মুখটা কিছু হলেও কুচকালো রাতুল। সে ভাবল হৃদির কথা কানে না নেয়াই ভাল। তারা যখন স্কুলের কাছাকাছি আসল তখন লাইজু ইশরাতের খোজে পিছনে তাকাল দেখল, সে আর রানা একসাথে আসছে। ইশরাত যখন লাইজুর কাছে আসল লাইজু তখন বলল, “কিরে কি প্রশ্ন কথা বলছিলি ওই ‘মাসুদ রানার’ সাথে।”
“কিছু না খালি প্রশ্ন করছিল।”
“কি প্রশ্ন?”
“আমার বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা, এটা।”
ইশরাতের এই কথা শুনে লাইজুর চোখ কুচকে গেল। সে ওই বড় ভাইটাকে দেখে মনে করছিল কিছুটা ভদ্র হবে সে। আসলে ভদ্র না ছাই, চেহারা একটু ভাল দেখে মেয়েদের সাথে একটি লাইন মারার চেষ্টা করছে।
“আচ্ছা তাহলে আমরা ক্লাসে চলে গেলাম,” রাতুল এই বলে তাদের দিকে হাত নাড়িয়ে চলে গেল। হৃদি মনে হয় কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই রাতুল অনেক দূরে চলে গেল।
“মনে হয় কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না, ” লাইজু বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল তারপর হৃদির দিকে তাকিয়ে বলল, “কই তোদের ক্লাবতো কিছুই করতে পারল না। খালি নামে আছে এই ক্লাব।”
লাইজুর কথাটা পিনের মত করে বিধল হৃদির গায়ে। সে এর প্রতিবাদ করল না, শুধু বিড়বিড় করে বলল, “দেখ ওরাই কিছু না একটা কিছু করবেই।”
*
ডেস্কে মাথা পেতে চোখ বুজে ছিলাম। গুন গুন করে হালকা কথার আওয়াজ কানে আসছিল আমার। এইরকম গুনগুন আওয়াজ চলতে থাকলে একসময় হয়তো আমি ঘুমিয়ে যাব। আহ! কি শান্তি। আসলে ভরপেট খাওয়ার পর এক ধরনের আলসেমি এসে পড়ে।
ধাম!
আমার ডেস্কের উপর কিছু পড়ার আওয়াজ হল। দেখলাম সুমনা তার খাতা রোলের মত করে রেখে সেটা দিয়ে আমার ডেস্কে বাড়ি মেরেছে। ইদানিং দেখছি সুমনা একটা খাতা এভাবে রোল করে বেতের মত করে নিয়ে ঘুরে, আজকে যখন দুই জলহস্তী মারামারি করছিল সুমনার হাতে এটা ছিল। আমি নাক না গলালে এই অস্ত্র দুই জলহস্তীর পিঠে পড়ত।
“একটা বুদ্ধি দাও,” সুমনা বলে উঠল তার সাথে রুপা আর নুশরাতও ছিল।
আরে আমি কি বুদ্ধির গাছ নাকি যে বলল আর একটা বুদ্ধি দিয়ে দিব। আর কিসের বুদ্ধি দিব আমি?, মনে মনে আমি এত কথা বললেও, আমি তাদের সামনে বললাম, “কিসের বুদ্ধি?”
“কিভাবে ইশরাতে বিয়ে ভাঙ্গা যায়,” সুমনা বলে উঠল।
কি মারাত্মক কথা। আর সে এটা এমন ভাবে বলল যেন কিছুই না, এক লহমায় শেষ করে দেয়া যায়।
“আমি কিভাবে এই বুদ্ধি দিব, আমার কোনো ধারনাই নেই…”
আমার কথা শেষ না হতেই নুশরাত বলে উঠল, “স্ক্যামিংয়ে তুমি ওস্তাদ।”
“স্ক্যামিং কি?”
“কূটবুদ্ধি।”
“আমি আবার কূটবুদ্ধি করলাম কবে?”
“ওই ভুলে গেছ,” রুপা বলে উঠল, “ক্লাস ক্যাপ্টেন নির্বাচনের সময়, সবাইরে ঘোল খাইয়েছ।”
“সেটাতো…”
“কোনো কথা নয়,” সুমনা তার রোল করা খাতা আমার নাকের দিকে তাক করে বলল।
রুপা আরো কি যেন বলতে চেয়েছিল তখন ক্লাসে আক্কাস স্যার এসে পড়েলন। যাক আজকে আমাকে বাচিয়ে দিল। স্বস্তির শ্বাস ফেলতে যাব তখন নুশরাত বলে উঠল, “এই ক্লাস পর্যন্ত সময় দিলাম, কিছু একটা বের কর নাইলে এমন সাইজ দিব যে বারোটা বাজি বাজি করেও বাজবে না।”
ভয়ানক একটা হুমকি দিয়ে গেল। কোনো মেয়ের কাছে আমি এমন হুমকি পাই নাই আমি। একটা ঢোক গিলতে বাধ্য হতে হল আমাকে।
ঘন্টাখানেক পর।
আমি রাতুলের ক্লাস রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। জানালা দিয়ে দেখলাম রাতুল সগর্বে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন দেখছি তার দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসছে। মেয়েদের সংখ্যাটাই একটু বেশী। ভাগ্নের এই দুরবস্থা দেখতে তেমন একটা খারাপ লাগছে না কিন্তু বেশীক্ষন সেটা দেখার সৌভাগ্য হল না।
রাতুল আমাকে দেখেই বের হয়ে আসল, “কি খবর মামা, তুমি এখানে?”
“কাজ আছে,” এই বলে আমি একটা হাতে বানানো খাম তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে, “এই চিঠি তুই ইশরাতের কাছে দিবি।”
রাতুল আমার দিকে একটা ফাজিল মার্কা হাসি দিয়ে বলল, “কি মামা লাভ লেটার নাকি?”
“উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করবি না, যা বলছি তাই করবি।”
“এত কষ্ট করে যাব একটু চা পানি পাব না।”
ইচ্ছা হল পিঠে মধ্যে দুইটা ধাম ধাম করে কিল বসিয়ে দেই। কিন্তু লোহার কাজ লোহা দিয়েই সারতে হবে, “তোর খাটের নিচে একটা কার্টনে মনে হয় কিছু গেমসের ডিভিডি আছে, আপি মনেহ্য সেটার খোজ জানে না।”
আমার এই কথা শোনার পড় রাতুলের মুখে কিছুটা হলে আতংক দেখা গেল, সে খাটের নিচে একদম কোনায় একটা কার্টনে কিছু গেমসের ডিভিডি রেখেছে। আর সেটা অসম্ভবের খাতায় গেলেও আপির চোখ সেটা এড়িয়ে গেছে।
রাতুলের আতংক কাটতে সময় লাগল না, “আমি যদি খালাকে বলি তুমি আজকে একটা মেয়ে কে লাভ লেটার দিয়েছ তখন।”
“বলতে পারিস, তবে মনে রাখিস এইটা বলবি আর তুই ল্যান্ডমাইনে পা রাখবি,” আমি একটু থেমে, “আর এটা আমি না সুমনা পাঠিয়েছে।”
“আরে দূর এটা আগে বলবে তো, সুমনা আপু হলে আমি নাচতে নাচতে যাব। দাও।”
সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে চিঠি নিতে যাবে তখন আমি বলে উঠলাম, “আর শোন এটা কিন্তু আর কারো কাছে বলবি না, এমনকি হৃদির কাছেও না।”
“কেন, এটা আমাদের ক্লাব থেকেই তো দেয়া হয়েছে?” রাতুল একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেশ করল।
“হ্যা, তবে এটা আমি, সুমনা, ইশরাত… আর তুই ছাড়া আর কাউকে জোড়ানো যাবে না,” আমি একটু থেমে বললাম, “যদি আর কারো সামনে মুখ খুলিস আমার কিছু করা লাগবে না সুমনাই সব করবে।”
একটা ঢোক গিলে রাতুল চিঠিটা হাতে নিল, সে একটু সামনে গিয়ে আবার থেমে গেল। আমার কাছে ফিরে এসে বলল, “আচ্ছা সুমনা আপুর নাম দিয়ে ইশরাত আপুর কাছে লাভ লেটার পাঠাচ্ছ না তো।”
মজনুর মাথায় খালি লাভ লেটার, লাভ লেটার করে। এবার আর সামলাতে পারলাম না মাথার মধ্যে হালকা একটা গাট্টা মেরে বললাম, “মাথায় কি গোবর নাকি? পছন্দ হলে আমি নিজে গিয়ে লাভ লেটার দিতাম, তোর মত উল্লুকের কাছে আসতাম না।”
“তাহলে তুমি যাও,” সে রাগ করে আমার দিকে চিঠি বাড়িয়ে দিয়ে বলল।
“যাই সুমনার কাছে, বলি তুই রাজী না আর সে এসে তোর…”
“যাচ্ছি আমি।”
“ও ভাল কথা, ওরা যদি আমার খোজ করে তাহলে বলবি, তুই আমার খোজ জানিস না।”
“কেন?” রাতুল এবার ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেশ করল, পুরোনো সন্দেহ আবার ফিরে এসেছে।
“কারন আমি কলজে পালিয়েছি, বোমা মারলেও এই কথা বলবি না।”
“এত আমার লাভ।”
“কালকে যে গেম বের হয়েছে সেটার ডিভিডি পাবি।”
“ওকে।”
এই বলে রাতুল ইশরাতের ক্লাসে গেল। আমিও আমার গন্তব্যের পথে গেলাম, সুমনারা আমার খোজে বের হয়ে গেছে মনে হয়।
*
বিকেলে কিনে আনা গেমস নিয়ে খেলতে খেলতে কোন সময় যে সন্ধ্যা হয়ে হয়ে গেছে সেটা রাতুল টের পায়নি। প্রায় সাতটা বাজে, ছোট খালার আসার সময় হয়ে গেছে। সে কম্পিউটার বন্ধ করল, ছোটখালা কম্পিউটার ছাড়া দেখলে তার বারোটা বাজিয়ে দিবে।
এতক্ষন কম্পিউটারের সামনে বসে থেকে তার মাথা ধরে গেছে। সে নিজের রুম থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক রানার খোজে তাকাল। ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখতে পেল সেখানে একটা প্লেট সাজানো আছে। প্লেট তুলে দেখল নুড্যলস তৈরী করা আছে, তার পাশে গ্লাসের নিচে একটা টুকরো কাগজ। সেখানে লেখা আছে, ‘আমি নিচে আছি দরকার লাগলে ডাক দিবি’।
রাতুল কাগজ দলা করে ওয়েস্টবিনে ফেলে দিল তারপর নুড্যলসের প্লেট হাতে নিয়ে সে বারান্দার দিকে গেল। সে আকাশের দিকে তাকাল, আস্তে আস্তে মেঘের পরিমান বাড়ছে। দুই একদিনের মধ্যে বৃষ্টি হবে, মনে মনে বলে উঠল রাতুল।
সে এবার নিচের দিকে তাকাল, দেখল রানা মোবাইল ফোনের কার সাথে কথা বলছে। ভাবভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে কারো সাথে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলছে। তিনতলা থেকে শনা যাচ্ছে না কি বলছে সে।
“কার সাথে এত জরুরী কথা বলছে মামা,” এই বলে রাতুল এক চামস নুড্যলস নিজের মুখে নিয়ে চিবোতে লাগল।
*
ইশরাত নিজের বুকে একটা ফু দিল। বড়সড় একটা কাজ করতে যাচ্ছে সে যা সে জীবনে করতে চায়নি। বিকালের দিকে রেহানের সাথে সে দেখা করেছিল। তারপর সে রেহানকে সব বলে দেয়। সব শোনার পর রেহান রেগে যায়, তাকে আগে জানানো হয় নি কেন।
জানালে কি হত, এই প্রশ্নটা ইশরাত করেছিল।
রেহানের জবাব ছিল, সে পুরুষ মানুষ কিছু একটা ব্যাবস্থা করে ফেলত সে।
এটা শোনার পর ইশরাত হেসে উঠেছিল। তার হাসি দেখে রেহান রাগ করতে গিয়েও রাগ করতে পারেনি, ফলে সে হেসে উঠে।
ইশরাত এবার তার পরিকল্পনার কথা বলে, তার বাবা যে ব্যাবস্থা নিয়েছে তাতে এই চরম পন্থা না নিয়ে কোনো উপায় নেই। ইশরাতের পরিকল্পনা শুনে একটা ঢোক গিলে উঠল রেহান।
“যদি এটা ঠিক মত না হয় তাহলে, যদি ধরা খাও?” রেহান জিজ্ঞেশ করে উঠল।
“জানিনা কি হবে, তবে চেষ্টা করতে তো দোষ নাই,” ইশরাত বলল।
“তাহলে আজকে রাতেই?”
“হ্যা, আজকে রাতেই,” ইশরাত জোর গলায় বলল।
বড়সড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিল ইশরাত, তারপর এগিয়ে গেল নিজের সব থেকে বড় সাহসী কাজে।
*
দ্বিতীয় পিরিয়ড শেষ। স্যার মাত্র বের হয়ে গেল। সুমনা এন্ড কোং এর হাতে এক দফা ঝাড়ি খেয়েছি কালকে না বলে চলে যাওয়ার কারনে। তারা রাতুলকে খুজেছিল, পায়নি। তাদের আগমন সংকেত পেয়ে মনে হয় সেও আমার পথ ধরেছিল।
ম্যাথ স্যারের পিছনে পিছনে সুমনা চলে গিয়েছিল, উদ্দেশ্য আজকে ল্যাবের শীট গুলো আনতে। বাকী দুজন আমার দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছে, ভাব এমন সুমনা আসুক তারপ সেকেণ্ড রাউন্ড চালাবে আমার উপর। এরপর আক্কাস স্যারের ক্লাস নাহলে আমি অনেক আগেই পগার পাড় হয়ে যেতাম।
“কোথায় ওই বেয়াদব,” ষাড়ে মত গলায় কে যেন চেচিয়ে উঠল। সবাই দেখলাম চমকে গেল। এতক্ষন যে হালকা গুঞ্জন হচ্ছিল সেটা থেমে গেল।
“কই ওই বেয়াদব যে আমার মেয়েকে কু-বুদ্ধি দেয়,” আবার সেই ষাড়ের মত গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, “কোথায় রেদোয়ান হক রানা, কই সে? ইবলিশের বাচ্চা আজকে তাকে কাচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলন আমি।”
এটা শোনার পর আমি ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে আসলাম। বের হওয়ার আগে আমি টের পেলাম সবার দৃষ্টি আমার উপর। রুপা আর নুশরাত আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নির্জনের চেহারা দেখে বোঝা যায় সেও কিছুটা হতভম্ভ হয়ে গেছে।
“কই, ওই রেদোয়ান হক রানা নামের ছেলেটা কইইই~”
ক্লাসরুম থেকে বের হতেই দেখলাম, মোটাসোটা এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। রাগে চেহারা লাল হয়ে আছে, আর ঘামে ভিজে গেছে। তার পিছনে একটা মহিলা জড়োসড়ো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
“কই সেই ছেলে যে আমার মেয়েকে কু-বুদ্ধি দিয়েছে, কই সে?”
এই বলে মোটাসোটা লোকটা আমার দিকে তাকাল।