আমার বাবা ছিলেন হত দরিদ্র মানুষ।
আমাদের স্কুলের বেতন ছিল দুই টাকা। সেটি দেয়ার সামর্থ্য ভদ্রলোকের ছিল না। এর বদলে আমার বাবা রাত জেগে চিঠি লিখতেন। স্কুলের হেড স্যার বরাবর। সেই চিঠিতে বাংলাদেশে বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বর্ণণা করতেন। চিঠির ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন মনীষীর উক্তি ঢুকিয়ে দিতেন। যেমন, তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দেবো, শিক্ষা সুযোগ নয় অধিকার- ইত্যাদি । চিঠির ভাষা হতো অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। সেই জোরালো চিঠির বদৌলতে আমরা দুই ভাই প্রতি বছর বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ পেতাম। আমার ছোট ভ্রাতার ধারণা অবশ্য ভিন্ন। ওর মতে আমরা ফার্স্ট, সেকেন্ড হতাম বলেই এই সুযোগ এমনিতেই পেতাম। এর পেছনে চিঠির কোনও কেরদানি নেই।
স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে সবাই টিফিন বক্স খুলে মজার মজার টিফিন খেতো। আমরা হা করে খানিকক্ষণ চেয়ে দেখতাম। স্কুলের পাশেই ব্রাদার্স ইউনিয়ন মাঠ। সেই মাঠ পেরুলেই আমাদের বাসা। টিফিন আওয়ারে আমরা সমুদ্রের মতো বিশাল সেই মাঠ রোদের মধ্যে পার হয়ে বাসায় ফিরতাম। ভাত খেয়ে আবার সুবোধ বালকের মতো স্কুলে যেতাম।
আমার বাবা সরকারি একটা ছোটো চাকরি করতেন। পানি উন্নয়ণ বোর্ড। কেরানি ছিলেন। খুব সম্ভবত ভীতু মানুষ ছিলেন বলেই ঘুষ খাওয়ার সাহস করতেন না। একবার এক কান্ড হলো। তখন এরশাদের আমল। সরকার থেকে কি একটা সুযোগ দেয়া হলো জমি বা অন্যকিছু কেনার জন্য। একটা নির্দিষ্ট এমাউন্টের টাকা জমা দিলো অফিস থেকে ১০,০০০ টাকা দেয়া হবো। বাবা সেই সুযোগ কাজে লাগালেন। এরপরের ঘটনা লটারি জেতার মতো। বাবা ১০,০০০ টাকা পেলেন। আমাদের জীবন একদম বদলে গেল।
টিফিন আওয়ারে আমরা স্কুল থেকে বেরিয়ে দেখতাম বাবা স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাত ভর্তি কেক, পেস্ট্রি, কোল ড্রিংক। আমরা তিন বাপবেটা স্কুলে বসে অন্য ছেলেদের দেখিয়ে দেখিয়ে টিফিন খেতাম। বাবা প্রতিদিন টিফিন আওয়ারে অফিস পালিয়ে গাদাখানেক খাবার নিয়ে আসতেন। আমরা বসে বসে খেতাম। আহ, কি মধুর ছিল সেই দিনগুলি। এইভাবে মাসখানেক চলার পর বাবার টাকা ফুরিয়ে গেলো। আমাদের পিতাপুত্রের ”মধুচন্দ্রিমার” করুণ সমাপ্তি ঘটলো। আবার সেই শো শো রোদ্দুরে মাঠ পার হয়ে বাড়ি ফিরে ভাত খাওয়া। ভরা পেটে স্কুলে যাওয়া। সেই টাকা দিয়ে বাবার জমি কেনা হয়নি। পুরোটাই আমরা টিফিন খেয়ে উড়িয়েছি।
আমার মেয়ে রশ্মি একবার অদ্ভুত একটা বায়না ধরেছিলো। আকাশের চাঁদ তাকে এনে দিতে হবে। ওর মা হেসেই অস্থির।
আমি রশ্মিকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম, দেখি কি করা যায়।
মেয়েকে নিয়ে বাসার ছাদে গেলাম। চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে বিকট তিনটি লাফ দিলাম। আমার কণ্যা হেসেই অস্থির। ওর চাঁদ না পাবার কষ্ট চলে গেলো।
বাবারা সবসময় ধনী। কোনও বাবা হেডস্যারের কাছে চিঠি লেখে, কোনও বাবা চাঁদের দিকে তাকিয়ে লাফ মারে।
মানুষ দরিদ্র হয়, কিন্তু বাবারা কখনো দরিদ্র হয় না।
বাবারা বড়লোক। ধনের দিক দিয়ে না হোক, মনের দিক দ্রিহিত)
(সংগৃহীত)