২০০১ সালে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আসা হয় চট্টগ্রাম থেকে। আমি তখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি চট্টগ্রাম থেকে। বড় খালুর ভবনে আমরা ভাড়া উঠি। যদিও ছোটবেলা থেকে ঢাকায় নিয়মিত আসা যাওয়া করা হত তার পরও স্থায়ীভাবে বসবাস সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। ঢাকার সবকিছু নতুন, তার উপর বন্ধু বান্ধবহীন, একা একা সব কিছুর সাথে খাপ খাওয়ানো, তার উপর নিয়মিত পেটর অসুখ ছিল গোদের উপর বিষ ফোরা। আব্বার পোস্টিং ছিল বরিশাল, তিনি সেখানেই থাকেন, মাঝেমাঝে ঢাকায় আসেন। বলা যায় অবিভাবকহীন অবস্থায়।
যেই দিনের ঘটনা বর্ণনা দিচ্ছি সেই দিন সিটি কলেজের ফর্ম জমা দেই বহু কস্টে। সারাটা দিন বাসার বাহিরে, অভুক্ত, প্রচন্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে বাসায় আসি। গেইট খোলার জন্য ছোট বোনকে বললে, সে চাবি ছুড়ে দিয়ে চলে যায়। বাসায় ঢুকেই তাকে এর জন্য বকাবকি করি। সে তখন আব্বার কাছে নালিশ করলে, আব্বা আবার আমাকে বকাবকি করেন। আমি রাগের মাথা বাসার থেকে বেড়িয়ে পরি। হন হন করে হেটে তালতলা বাস স্ট্যান্ডে যাই। ভাঙ্গা দেয়াল টপকে পুরাতন এয়ারপোর্ট ঢুকে পরি।তখনও এয়ারপোর্ট এর বাউন্ডরি পুরাতন স্টাইলের, অল্প উচ্চতার খোপ খোপ বিশিষ্ট। যে দিক দিয়ে ঢুকি সেখান থেকে অন্ধকারের মধ্যে হোচট খেতে খেতে রানওয়েকে পৌছাই। মাথা তখন শুণ্য, কোন কাজ করছিল না, কি করবো কিছুই আসছিল না মাথায়। রানওয়ের মাঝে সাদা মার্কিং করা দাগের উপর শুয়ে থাকলাম অনেকক্ষুন। কিছুক্ষন চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখলাম। তখন ফিলসফিকাল চিন্তার খেললো মাথায়, আমি কত ক্ষুদ্র, তারাগুলো কত দূরে, দূরের রাস্তার মানুষগুলো কত ব্যস্ত ভাবে গাড়ি হাকিয়ে চলে, জীবনে কি আছে, উপুর হয়ে শুয়ে সেই একই চিন্তা। এই সময় মনে হল কি যেন আমার সামনে আছে, চমকে তাকিয়ে দেখি শিয়াল এর মত কোন একটা প্রানী আমার ঘ্রান শুকছে। লাফ দিয়ে উঠেই দৌড়, কোন মতে রানওয়ের পাশে যেখানে মার্চপাস্টের সময় ব্যান্ড বাজানো হয় সেই ভবনের এক পাশের মিনারে উঠি বসে থাকি। মাঝে মাঝে উপর থেকে নিচে দেখার চেষ্ঠা করি কিছু আছে কি না।
অনেকক্ষুন বসে থাকার পর সেখান থেকে নেমে সেকেন্ড গেইট বাস স্টপেজ বরাবর যে মেইন গেইট আছে সেখান দিয়ে বেরিয়ে হাঁটতে থাকি বিজয় স্মরনী বরাবর। র্যাংগস ভবন তখনও বিদ্যামান ছিল। মহাখালী যাওয়ার দিকে বিজয় স্মরনীর শেষ মাথায় "বিজয় স্মরনী" নামে একটি ফলক ছিল, সেটার বেদিতে বসে থাকি আর রাতে চলমান গাড়ির মানুষগুলো দেখি। সাই সাই করে গাড়ি গুলো যাচ্ছে সাথে বিকট শব্দে মিউজিক,কি এক অজানা ফুুর্তি তাদের মাঝে বিরাজ করে তারাই জানে।
রাস্তা পার হয়ে নভো থিয়েটারএর সামনে দিয়ে হাঁটতে থাকি। ধীরে ধীরে হেটে সামরিক জাদুঘর ক্রস করার সময় দেখি এক সৈনিক রাইফেল হাতে দাড়িয়ে আছে চুপচাপ। এর পরিবার কই, বাসায় হয়তো বউ আছে, পোলা মাইয়া আছে, আর সে একা একা দাড়িয়ে আছে, কি আছে জীবনে, আহা। এই অসময়ে আবার সেই ফিলসফিকাল চিন্তা মাথায়।
সামরিক জাদুঘরের সীমানার শেষে কোনায় এসে দেখি এক ভ্যান চালক, ফুটপাথে শুয়ে থাকা রমনীর সাথে আদিম ক্রিয়ায় মত্য, সেই সময় রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটি প্রাইভেট গাড়ি থেকে যাত্রী মাথা বের করে চিৎকার করে বলল "মজা?"," মজা?" আর সেই সাথে তার চটুল বিদঘুটে হাসি। ভ্যান চালক লাফ দিয়ে উঠে দৌড়ে তার ভ্যানের কাছে। ভ্যান নিয়ে জোরে চালাতে লাগলো। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি পুলিশ তার কলার ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে এক ভীতকর অবস্থা। একদল আদিম তারনা মেটাতে ব্যস্ত, আরেক দল সেটির যোগান দিয়ে দুপয়সা রোজগার করে পেটের ক্ষুদা নিবারনের জন্য আপ্রাণ চেষ্ঠা আর এর মাঝে পুলিশ তার পকেট ভরায় ব্যস্ত। অদ্ভুত দৃশ্য! অদ্ভুত জীবন। অদ্ভুত সময়।
কোন মতে রাস্তা পার হয়ে উত্তর দিকে আসি। দেখি একটি মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লাল সালওয়ার কামিজ, হালকা সস্তার প্রসাধনি, ঠোটে করা করে লাল লিপস্টিক দেয়া, মাথায় আচঁল টেনে রাখা। আমি প্রচন্ড ভয় পাই। রাস্তা পার হয়ে তালতলার দিকে হাটতে থাকি, মেয়েটিও আমার পিছে পিছে আসতে থাকে। সেই সময় একটি খালি রিক্সা পাই, তাতেই দ্রুত উঠে বাসায় চলে আসি। বাসায় যখন পৌছাই তখন ঘড়িতে ২.৩০ টা বাজে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:০৮