কোন কিছুর গ্রহণযোগ্যতার চেয়ে যা সঠিক তা দিয়ে শুরু করুন।
[Start with what is right rather than what is acceptable.]
এটা ফ্রাঞ্জ কাফকার একটি বিখ্যাত উক্তি। কাফকার এই কথার দ্বারা বুঝাতে চেয়েছেন যে মানুষকে তার সামাজিক নিয়মের চেয়ে নৈতিক নীতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সমাজে প্রচলিত নিয়ম না মেনে, নীতি নৈতিকতা দিয়ে চলতে গেলে সামাজিক স্থিতাবস্থা নষ্ট হতে পারে, এমন কি, মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যাশাকেও অস্বীকার করতে হতে পারে।
১. "সঠিক" এর আসল অর্থকে উপলব্ধি করা:
কাফকা "সঠিক" বলতে আইন বা সামাজিক নিয়ম মেনে চলার চেয়ে আরো গভীর অর্থ বুঝিয়েছেন। তিনি "সঠিক" বলতে নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক ধারণাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সঠিক বলতে এমন কাজকে বুঝায় যা ন্যায্য, যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং উচিত কাজ এবং যে কাজটি নৈতিকভাবে উপযুক্ত। সঠিক কাজটি মানুষের বিবেকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে এবং কাজটি দ্বারা অন্য মানুষের মঙ্গল, উপকার, এবং কল্যাণ হতে হবে। এই সব উপাদান থাকলেই কাজটিকে সঠিক হিসাবে বিবেচনা করা হবে।
২. "গ্রহণযোগ্য" থেকে "সঠিক" কাজটিকে আলাদা করা:
অন্যদিকে "গ্রহণযোগ্য" ধারণাটি দ্বারা এমন কাজকে বোঝায় যা সাধারণত সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য বা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দ্বারা অনুমোদিত বলে বিবেচিত হয়। অনেক সময় দেখা যায় সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্য নিয়ম নীতি গুলি সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অবদান রাখে। কিন্তু সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য সব নিয়ম নীতি সবসময় নৈতিকভাবে উপযুক্ত অথবা ন্যায্য, যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত বা উচিত নাও হতে পারে। এমন কি "গ্রহণযোগ্য" সামাজিক নিয়ম নীতি অনেক সময় অন্যায্য, পক্ষপাতদুষ্ট বা এমনকি ক্ষতিকারক হতে পারে।
৩. যা সঠিক তার পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস:
কাফকা এই কথার দ্বারা এটাও বলতে চেয়েছেন যে মানুষ যা সঠিক বলে বিশ্বাস করে তার পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস থাকতে হবে। কারণ সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্য নিয়ম-নীতির বিরুদ্ধে নৈতিকভাবে সঠিক নীতির পক্ষে দাঁড়ানো একটা কঠিন কাজ। বাহ্যিক চাপ সত্ত্বেও নৈতিকভাবে উপযুক্ত মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়ানোর মধ্যেই প্রকৃত সততা নিহিত। এমনকি বিরোধিতা বা উপহাসের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করা এবং যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত বিশ্বাসকে রক্ষা করার ইচ্ছা পোষণ করা প্রয়োজন।
৪. মনোগত নৈতিকতার জটিলতাগুলি নিরসন করা:
যদিও কাফকা সঠিক এবং গ্রহণযোগ্য নীতিমালাগুলির মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য দেখাতে চেয়েছেন, কিন্তু একই সাথে নৈতিকতার জটিলতাগুলিকেও স্বীকার করেছেন। মানুষ তাদের লালন-পালন, অভিজ্ঞতা, ধর্ম এবং সাংস্কৃতিক পটভূমিতে সঠিক এবং ভুলের মানদণ্ড ঠিক করে। তাই বিভিন্ন সমাজের মানুষ সঠিক এবং ভুল সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। এই মনোজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি (সাবজেক্টিভিটি) সার্বজনীন নৈতিক মান নির্ধারণ করাকে বাস্তবে চ্যালেঞ্জিং করে তুলতে পারে।
৫. সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতার ভূমিকা:
সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা বলতে এমন একটি অবস্থা বুঝায় যে নৈতিক ব্যবস্থাগুলি প্রতিটা মানুষের নিজ নিজ সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের সাথে আপেক্ষিক। এই ধারণাটা মেনে নিলে কাফকার কথাটি বাস্তবে প্রয়োগ করা অনেক কঠিন এবং জটিল। এক সংস্কৃতিতে যা সঠিক বলে বিবেচিত হয় তা অন্য সংস্কৃতিতে অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। এই অবস্থায় সর্বজনীন নৈতিক নীতি এবং উদ্দেশ্যমূলক নৈতিক বিচারের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দেয়।
৬. কাফকার বাণীর গুরুত্ব:
উপরে উল্লেখিত জটিলতা সত্ত্বেও কাফকার বার্তা মানুষের সঠিক করণীয় সম্পর্কে একটি শক্তিশালী এবং প্রাসঙ্গিক নির্দেশনা দেয়। এটি মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে মানুষ তার নিজস্ব নৈতিক মানদণ্ড দ্বারা কাজ করার জন্য দায়বদ্ধ। এমনকি যদি নিজস্ব নৈতিক মানদণ্ড অনুসারে কাজ করতে যেয়ে সামাজিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তা হলেও। নৈতিক কাজটি করতে যেয়ে সমাজের স্থিতাবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। মানুষকে তার নৈতিক বিশ্বাসের পক্ষে দাঁড়াতে এবং আরও ন্যায্য এবং নৈতিক বিশ্ব তৈরি করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে কাফকার এই কথা উৎসাহিত করে।
শেষকথা:
কাফকা এই কথার মাধ্যমে মানুষকে সঠিক কাজের এবং মানুষের নৈতিক পটভূমিকে সক্রিয়ভাবে গঠন করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি মানুষকে সঠিক এবং গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্বের মোকাবিলা করার জন্য, সামাজিক রীতিনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এবং সততা ও প্রত্যয়ের সাথে কাজ করার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। এটি করার মাধ্যমে মানুষ বিশ্বে এমন একটি অবদান রাখতে পারে যেখানে সঠিক এবং গ্রহণযোগ্য নীতিমালাগুলো একত্রিত হবে। একই সাথে নৈতিক নীতিগুলি মানুষের ক্রিয়াকলাপের মূল চালিকা শক্তি হবে এবং প্রতিটি কাজে ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা বিরাজ করবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ ভোর ৬:৩১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



