লোহিত সাগরের শিপিং রুটে হুথির হামলা চীনের অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি জটিল অবস্থা তৈরি করেছে। কারণগুলি নিম্নরূপ:
অর্থনৈতিক প্রভাবসমূহ:
বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে:
লোহিত সাগর বিশ্ব বাণিজ্য বিশেষ করে তেল এবং এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে পণ্য চলাচলের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র পথ। সুয়েজ খাল লোহিত সাগরকে ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত করেছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ চোকপয়েন্ট এবং আফ্রিকা মহাদেশ চারপাশ ঘুরে যাওয়ার চেয়ে অনেক সংক্ষিপ্ত একটা পথ। হুথি হামলার ফলে এই পথে জাহাজ চলাচলে বীমা খরচ এবং শিপিং বিলম্ব বেড়ে গেছে। এরফলে চীনা আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এতে চীনের ক্ষণভঙ্গুর অর্থনীতি আরো চাপের মধ্যে পড়েছে।
সরবরাহ চেইন সমস্যা:
নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে জাহাজ চলাচলে বিলম্ব এবং পুনরায় নতুন রুট নির্ধারণ করার ফলে চীনের জটিল সরবরাহ শৃঙ্খলকে মারাত্মক ভাবে ব্যাহত করছে। এতে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি হচ্ছে এবং ভোক্তাদেরকে বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হবে। কবিড মহামারীর পর থেকেই চীনের সাপ্লাই চেইনে সমস্যা দেখা দিয়েছিল, এখন নতুন করে হুতি হামলায় চীনের এই সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। চীনের সাপ্লাই চেইনে সমস্যার কারণের শিল্পোন্নত দেশগুলি আরো জোরেশোরে বিকল্প বাজার খুঁজবে।
কূটনৈতিক দ্বিধা:
ভারসাম্যপূর্ণ জোট:
মধ্যপ্রাচ্যের জটিল এবং নোংরা রাজনীতিতে প্রবেশের পর এটা চীনের প্রথম পরীক্ষা। ইয়েমেনি সংঘাতের প্রধান খেলোয়াড় সৌদি আরব এবং হুথিদের সমর্থনকারী ইরান উভয়ের সাথেই চীনের সুসম্পর্ক রয়েছে। সম্প্রতি কালে চীনের মধ্যস্থতায় ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে একটি সমঝোতা ছুটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটাকে চীনের বিরাট কূটনৈতিক বিজয় হিসাবে দেখা হয়। চীনের ধারণা ইরান সৌদি বিরোধ বোধ হয় একটা ভূরাজনৈতিক বিষয়। কিন্তু চীনের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব হচ্ছে না যে ইরান-সৌদি বিরোধ শুধুমাত্র ভূরাজনৈতিক বিরোধ না, এটা দুইটি কট্টরপন্থী ধর্মীয় মতবাদের মধ্যে একটা ধর্মীয় বিরোধ। কোন ধর্মীয় বিরোধে একই সাথে উভয় পক্ষের বিজয় অর্জন সম্ভব না, যেটাকে ইংরেজিতে বলে উইন উইন সিচেআসন। ধর্মীয় বিরোধে একপক্ষ সম্পূর্ণ নির্মূল হবে আরেক পক্ষ সম্পূর্ণ বিজয়ী হবে অর্থাৎ জিরো সাম গেইম।
এইরকম পরিস্থিতিতে চীন যদি হুথিদের কঠোরভাবে নিন্দা করে বা কোন ব্যবস্থা নেয় তাহলে ইরান ক্ষুব্ধ হবে। আবার যদি হুতিদের বিরুদ্ধে কোন কিছু না বলে নীরব থাকে তাহলে নিজের অর্থনীতির ক্ষতি হবে এবং সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবে। তাছাড়া সমুদ্র নিরাপত্তার প্রতি চীনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ বাড়তে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে বাণিজ্যের স্বার্থে পৃথিবীর সব দেশ সমুদ্র পথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়।
গোলযোগপূর্ণ নৌপথে বাণিজ্য:
আগেই উল্লেখ করেছি ইয়েমেনি সংঘাত জটিল ধরণের। এর কোনো সহজ সমাধান নেই। ইয়েমেনি সংঘাত কেন এত জটিল তা বুঝার জন্য ইয়েমেনের দেড় হাজার বছরে ইতিহাস অধ্যয়ন করতে হয়। উদাহরণ সরূপ বলা যায় ফিলিস্তিন নিয়ে বিক্ষোভ করলেও সৌদিদের হাতে নিহত ২৪ হাজার ইয়ামেনী নিয়ে মুসলিমরা নীরব থাকে। ইয়েমেনের ভিতর ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে কিন্তু জটিলতার কারণে কেউ মুখ খুলছে না। এই রকম পরিস্থিতিতে কোন পক্ষ নেওয়া বা হুতিদের উপর জোরপূর্বক হস্তক্ষেপের পক্ষে কথা বলা পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা হতে পারে। এতে চীনের পক্ষে এই জলসীমা দিয়ে নৌচলাচল করাই অসম্ভব করে তুলতে পারে।
চীনের সম্ভাব্য কৌশল:
কূটনীতির জন্য চাপ দেওয়া:
চীন ইয়েমেনে যুদ্ধরত পক্ষগুলির মধ্যে সংলাপ এবং উত্তেজনা কমাতে উৎসাহিত করতে তার কূটনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগাতে পারে। তবে এতে সাময়িক লাভ হলেও দীর্ঘ মেয়াদে কোন লাভ হবে না। চীনকে এইসব প্রচেষ্টা শুরু করার আগে খুলাফায়ে রাশেদীন, উমাইয়া খিলাফত, আব্বাসীয় খিলাফত, মামলুক সালতানাত, উসমানীয় সাম্রাজ্য, সাফাভিদ সাম্রাজ্য ইত্যাদি শাসন আমলের সংঘাত সংঘর্ষের ইতিহাস, জটিলতা, এবং মূল কারণগুলি জেনে নিতে হবে।
সামুদ্রিক সহযোগিতা:
ইতোমধ্যে আমেরিকার নেতৃত্বে ১২টি দেশ এই নৌপথের নিরাপত্তার জন্য যৌথ ভাবে টহল দিচ্ছে। আমেরিকা ইতোমধ্যে চীনকে এই যৌথ টহলে তাদের সাথে শরিক হতে আহবান জানিয়েছে। নানা সমীকরণ, জটিলতা ইত্যাদি কারণে চীন সরাসরি আমেরিকার আহবান প্রত্যাখ্যান করলেও কিভাবে যৌথ টহল বা তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে লোহিত সাগরকে সুরক্ষিত করার জন্য অন্যান্য দেশের সাথে কাজ করা যায় তার পথ খুঁজছে। চীন চিন্তা করছে এই সংঘাতে কোনো পক্ষ না নিয়ে শুধু নিরাপত্তা উদ্বেগ মোকাবেলার জন্য কাজ করা যায় কি না। তবে চীনের এই কৌশল বাস্তবে সম্ভব নয়। কারণ নিরাপত্তার জন্য হুতি হামলা মোকাবেলা করার মানেই হচ্ছে হুতিদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া। এতে মধ্যপ্রাচ্যে খেলাধুলা করার চীনের শখ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে।
বিকল্পে পথের সন্ধান করা:
লোহিত সাগরকে সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ করা সম্ভব না হলে চীন বিকল্প স্থলপথের সন্ধান করবে। বিকল্প পথ এখনো ব্যয়বহুল এবং সময় সাপেক্ষ। ইউরোপে পণ্য পরিবহনের জন্য এই অস্থির অঞ্চলের উপর নির্ভরতা কমাতে চীন স্থল করিডোর বা আর্কটিক শিপিং সম্প্রসারণের মতো বিকল্প বাণিজ্য রুটগুলি অন্বেষণ করতে পারে।
শেষ পর্যন্ত এই ঘূর্ণাবর্ত অতিক্রম করার জন্য চীনকে অর্থনৈতিক স্বার্থ, কূটনৈতিক বিবেচনা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য আনতে হবে। চীন যেভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে তার প্রভাব চীনের অর্থনীতি এবং বৃহত্তর বিশ্ব সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করবে।
এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে পরিস্থিতি অত্যন্ত অনিশ্চিত এবং জটিল এবং এর কোন সহজ উত্তর নেই। এখানে প্রদত্ত তথ্য চীনের চ্যালেঞ্জগুলি এবং তাদের মোকাবেলার সম্ভাব্য বিকল্পগুলি বোঝার জন্য একটি সূচনা বিন্দু মাত্র।
[তথ্য যাচাই, বিশ্লেষণ এবং অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেয়া হয়েছে।]
সূত্র: Newsweek, Oman Observer, Yemen News Agency (SABA) ইত্যাদি
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১২:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



