দক্ষিণ আফ্রিকা হামাস-ইসরায়েল সংঘাতের বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি আর্জি পেশ করেছে। ইতোমধ্যে দুই পক্ষের শুনানি শেষ হয়েছে। মামলাটি এখন চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় আছে। সাধারণ ভাবে মামলার বিষয়বস্তু বুঝার জন্য এই লেখা।
মামলার আর্জিতে উল্লেখিত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান যুক্তি সমূহ:
১. জেনোসাইড কনভেনশনের লঙ্ঘন:
দক্ষিণ আফ্রিকা যুক্তি দেয় যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের পদক্ষেপ, বিশেষ করে গাজায় গণহত্যা বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন দ্বারা সংজ্ঞায়িত একটি অপরাধ।
২. আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) কর্তৃক প্রদত্ত আগের রায়গুলি ইসরাইল কর্তৃক মেনে চলতে ব্যর্থতা:
দক্ষিণ আফ্রিকা দাবি করেছে যে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) আগের রায়গুলি ইসরাইল মেনে চলেনি। উদাহরণ হিসাবে বলা হয়, ২০০৪ সালের এক রায়ে দখলকৃত পশ্চিম তীরে একটি প্রাচীর ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, যা ইসরাইল কার্যকর করে নাই৷
৩. ইসরাইল ক্রমাগত ভাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করছে:
পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজা সহ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের চলমান দখলদারিত্ব আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অবৈধ।
৪. ইসরাইলের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং জবাবদিহিতার জন্য আহ্বান:
দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) কে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের তদন্ত শুরু করার এবং আন্তর্জাতিক আইনের সম্ভাব্য লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি করার জন্য অনুরোধ করে।
দক্ষিণ আফ্রিকা কর্তৃক আনিত অভিযোগগুলির বিরুদ্ধে ইসরাইলের জবাব:
১. ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করার কোনো সুনির্দিষ্ট অভিপ্রায় নেই:
গণহত্যা কনভেনশনের অধীনে গণহত্যা প্রমাণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে কোন জাতীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায় থাকতে হবে। ইসরাইল যুক্তি দিচ্ছে যে ফিলিস্তিনি জাতীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার কোনো অভিপ্রায়কে ইসরাইলের নাই। তারা যুক্তি দেয় যে তাদের ক্রিয়াকলাপগুলি বেসামরিক লোকদের লক্ষ্য করে নয়, বরং হামাসকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হচ্ছে। তারা চেষ্টা করছে যাতে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা হ্রাস করা যায়।
২. অস্তিত্বের হুমকির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা:
ইসরায়েল দাবি করে যে হামাসের চলমান রকেট হামলা এবং অন্যান্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা হিসাবে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ইসরাইলের পদক্ষেপগুলি ন্যায়সঙ্গত। হামাসের এই হামলাগুলিকে ইসরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের হুমকি বলে তারা মনে করে।
৩. ঘটনা ও প্রেক্ষাপটের ভুল বর্ণনা:
ইসরায়েল দাবি করে যে দক্ষিণ আফ্রিকা সংঘাতের জটিল বাস্তবতাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে। সহিংসতা উস্কে দিতে এবং বেসামরিক লোকদেরকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে হামাসের ভূমিকাকে দক্ষিণ আফ্রিকা উপেক্ষা করেছে।
৪. আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করা হচ্ছে:
ইসরায়েল দাবি করে যে সামরিক অভিযানগুলি আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মেনে করা হচ্ছে এবং বেসামরিক ক্ষতি কমানোর জন্য সমস্ত সম্ভাব্য সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
৫. "দখল" পরিভাষা প্রত্যাখ্যান:
ইসরায়েল পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় তার উপস্থিতি বর্ণনা করার জন্য "দখল" শব্দটিকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে। তারা যুক্তি দেয় যে এই অঞ্চলগুলি আগ্রাসনের মাধ্যমে নয়, বরং প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে দখল করা হয়েছিল। তাই প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের মাধ্যমে দখলকৃত অঞ্চলগুলি আইনি সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না। ইসরাইলের যুক্তি হচ্ছে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা আগ্রাসন চালিয়ে কোন জায়গা দখল করে নাই। তারা আজ পর্যন্ত কোন আক্রমণ আগে শুরু করে নাই বরং প্রথমে তাদের উপর আক্রমণ হয়েছে। তারা আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়ে বিভিন্ন অঞ্চল দখল করেছে। তাই এটাকে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় "দখল" বলা যাবে না।
৬. আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে:
ইসরায়েল যুক্তি দেয় যে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়েরকৃত মামলাটি শুনানির জন্য এই আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এর এখতিয়ারের অভাব রয়েছে। কারণ বিরোধটি এই আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত।
আদালতের এখতিয়ার ব্যাপারে ইসরাইলের যুক্তিসমূহ:
(ক) বিরোধের অভাব:
ইসরায়েলের মতে ইসরায়েল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে কোন প্রকৃত আইনি বিরোধ নেই। দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরাইলের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার কোনো পূর্বপ্রয়াস ছাড়াই মামলাটি দায়ের করেছে। গণহত্যা কনভেনশনের বিধান অনুসারে এই ধরণের অভিযোগ দায়ের করার আগে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করা একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসাবে গণ্য করা হয়।। ইসরাইল যুক্তি দেখায় যে দক্ষিণ আফ্রিকা তার রাজনৈতিক এজেন্ডাকে বাস্তবায়ন করার জন্য সত্যিকারের আইনি বিরোধ ছাড়াই এই মামলাটি করেছে।
(খ) জেনোসাইড কনভেনশনের বাইরের বিষয়:
ইসরায়েল দাবি করে যে গাজার কথিত ঘটনাগুলি জেনোসাইড কনভেনশনের বিধানগুলির মধ্যে পড়ে না। তারা যুক্তি দেয় যে গণহত্যা কনভেনশনটি এমন কাজগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যা একটি জাতীয়, জাতিগত, বর্ণগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার লক্ষ্য পরিচালিত হয়। পক্ষান্তরে গাজায় তাদের কর্মকাণ্ড হল একটি অ-রাষ্ট্রীয় সত্তা (non-state entity) হামাসের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা।
(গ) অস্থায়ী ব্যবস্থার অনুপযুক্ত ব্যবহার:
চূড়ান্ত রায় প্রকাশিত হওয়ার আগে ইস্রায়েলকে গাজায় তার সামরিক অভিযান বন্ধ করার নির্দেশ চেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) কাছে অস্থায়ী বা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার জন্য অনুরোধ করেছিল। ইসরায়েল যুক্তি দেয় যে এই ধরনের পদক্ষেপগুলি কেবলমাত্র সেই ক্ষেত্রেই প্রদান করা যায় যে যেখানে চরম জরুরি অবস্থা এবং অপূরণীয় ক্ষতি স্পষ্ট প্রতীয়মান। কিন্তু এই ক্ষেত্রে এই অবস্থা বিদ্যমান নয়। তাছাড়া এই ধরণের আগাম আদেশ দিলে মূল মামলার রায় প্রভাবিত হবে।
[তথ্য যাচাই, গবেষণা এবং বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেয়া হয়েছে।]
সূত্র: আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) ওয়েব সাইট, The South African, The Times of Israel, Al Jazeera
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১১:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



