সংবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি: (১৪)
মৌলিক অধিকার: শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ :
সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৬ ধারা থেকে ৪৭ক ধারা পর্যন্ত মৌলিক অধিকার সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলির মতই এই মৌলিক অধিকারের বিবরণগুলি পড়লে মনে হবে আপনি পৃথিবীর কোন দেশে না বরং স্বর্গে বসবাস করছেন।
যখন কোন অধিকারের সাথে কোন শর্ত যোগ করা হয় তখন সেটা আর অধিকার হিসাবে গণ্য হয় না। মৌলিক অধিকারের সাথে যেকোন শর্ত যোগ করার পর সেটা আর মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য হয় না; সেটা হতে পারে বিশেষ কোন অধিকার।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার শিরোনামে যে সব অধিকারের কথা উল্লেখ্য করা হয়েছে তার প্রত্যেকটির সাথে এক বা একাধিক শর্ত যোগ করা হয়েছে। ফলে এইগুলিকে মৌলিক অধিকার বলে ঘোষণা করা হলেও এইগুলি প্রকৃতপক্ষে মৌলিক অধিকার নয় বরং রাষ্ট্রের কৃপায় কিছু বিশেষ অধিকার।
শুরুতে একটি হাস্যকর মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ করতে চাই।
৩০ ধারায় বলা হয়েছে, "রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদন ব্যতীত কোন নাগরিক কোন বিদেশী রাষ্ট্রের নিকট হইতে কোন খেতাব, সম্মান, পুরস্কার বা ভূষণ গ্রহণ করিবেন না।"
পাঠকের কাছে প্রশ্ন, এটা কি কোন মানুষের মৌলিক অধিকার? এটা কি ধরণের মৌলিক অধিকার? তাছাড়া কোন কিছু করা যাবে না, এটা কি ভাবে মৌলিক অধিকার হয়? অনুরূপ ভাবে ৪৫ ধারাও কোন অধিকার না বরং একটি নিষেধাজ্ঞা।
সংবিধান প্রণেতাদের লিগ্যাল জুরিসপ্রুডেন্স সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকার কারণে "অধিকার", "কর্তব্য", ও "দায়িত্ব" এর পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেন নাই। তিনটা ভিন্ন ভিন্ন বিষয় তবে একটার সাথে অন্যটির সম্পর্ক আছে।
উদাহরণ হিসাবে মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত কয়েকটি ধারা আলোচনা করলেই মৌলিক অধিকারের নামে শুভঙ্করের ফাঁকি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
২৮ ধারায় বলা হয়েছে, "...বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।"
২৯ ধারায় বলা হয়েছে, "...রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।"
৩৬ ধারায় বলা হয়েছে, "...জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ- সাপেক্ষে।"
৩৭ ধারায় বলা হয়েছে, "...আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে"
৩৮ ধারায় বলা হয়েছে, "...আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে"
৩৯ ধারায় বলা হয়েছে, "...আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে"
৪০ ধারায় বলা হয়েছে, "...আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে"
৪১ ধারায় বলা হয়েছে, "...আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে"
৪২ ধারায় বলা হয়েছে, "...আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা নিষেধ-সাপেক্ষে"
৪৩ ধারায় বলা হয়েছে, "...আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ-সাপেক্ষে"
৪৭ ধারায় বলা হয়েছে, "...তাহা হইলে অনুরূপ আইন এই ভাগে নিশ্চয়কৃত কোন অধিকারের সহিত অসমঞ্জস কিংবা অনুরূপ অধিকার হরণ বা খর্ব করিতেছে, এই কারণে বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে নাঃ"
"রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না" এই কথার অর্থ হচ্ছে মৌলিক অধিকার হিসবে যা বর্ণনা করা হয়েছে তার বিপরীতধর্মী যেকোন আইন রাষ্ট্র প্রণয়ন করতে পারবে। কোন শক্তি এই ধরণের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন প্রণয়নে রাষ্ট্রকে বাধা দিতে পারবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্র মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী যেকোন আইন প্রণয়ন করতে পারবে। যদিও ২৬ ধারায় বলা হয়েছে যে রাষ্ট্র মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবে না। আর যদি করেও ফেলে তা বাতিল হয়ে যাবে। চমৎকার বৈপরীত্য।
"জনস্বার্থে": রাজনীতিতে জনস্বার্থ একটি অস্পষ্ট, ভাসাভাসা ও আবছা শব্দ। জনস্বার্থ বলতে আসলে কি বুঝায় তা নির্ভর করে ক্ষমতাসীন সরকারের স্বার্থের উপর। সরকার তার বিরোধীদেরকে দমন করার জন্য মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী যেকোন আইন প্রণয়ন করে বলতে পারে জনস্বার্থে এই আইন প্রণয়ন করা হল।
"যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ": যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধের সংজ্ঞা কি? সবার যুক্তি তো একরকম হবে না। কোন যুক্তি বা কার যুক্তি গ্রহণ করা হবে? তাছাড়া কোন অধিকারকে যদি যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ দিয়ে সীমিত করা হয় তাহলে সেই অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য করা যায় না।
সংবিধানের ৩৯ ধারায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হয়েছে। পরক্ষণেই মনে হয়েছে যে প্রজাদের তো অনেক কিছুই তো দিয়ে দেয়া হল। এতটা দেয়া ঠিক হবে না। তাই ইচ্ছা মত শর্ত আরোপ করা হল। বলা হল, "রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে"
"রাষ্ট্রের নিরাপত্তা" বলতে কি বুঝায় তা সংজ্ঞায়িত করা হল না। ফলে যেকোন সরকার তার বিরোধী মতবাদকে দমন করার জন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অজুহাতে যেকোন ব্যক্তির অধিকার কেড়ে নিতে পারবে।
"বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক" এর মত হাস্যকর শর্ত আরোপ করে বাক স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারকে হরণ করা হয়েছে। এই কথাকে যদি সত্য বলে ধরি তাহলে কার্যত কোন বিদেশী রাষ্ট্রের সমালোচনা করা যাবে না। কারণ এই সংবিধানের মূলনীতি এবং পররাষ্ট্র নীতিতে বলা হয়েছে পৃথিবীর সব রাষ্ট্র বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র।
"জনশৃঙ্খলা" এটাও একটি অস্পষ্ট, ভাসাভাসা ও আবছা শব্দ। যেকোন সরকার যেকোন আন্দোলনকে জনশৃঙ্খলার পরিপন্থী ঘোষণা করতে পারে।
"শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে", "আদালত-অবমাননা", "মানহানি" এবং "অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা" এইগুলি সম্পর্কে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি ও ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতে সুস্পষ্ট আইনের বিধান আছে। অর্থাৎ এই সংবিধান প্রণয়নের ১০০ বছরেরও আগে এই সংক্রান্ত আইন বলবৎ আছে।
কতক্ষণ আর চালাকি বা প্রতারণা করে চলা যায়? তাই ৪৭ক ধারা আর রাখঢাক না করে মৌলিক অধিকারের মুখোশ ছুড়ে ফেলে দিয়ে একেবারে উলঙ্গ ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, "...তাহা হইলে অনুরূপ আইন এই ভাগে নিশ্চয়কৃত কোন অধিকারের সহিত অসমঞ্জস কিংবা অনুরূপ অধিকার হরণ বা খর্ব করিতেছে, এই কারণে বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে নাঃ"
এই ধারার সরল অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, এতক্ষণ মৌলিক অধিকারের নামে যা যা বলা হল, তার সাথে অসামঞ্জস্য বা অধিকার হরণ বা খর্ব করে কোন আইন প্রণয়ন করলে সেটা বাতিল হবে না। অর্থাৎ সংবিধানে মৌলিক অধিকার বলে যাই বলা হউক না কেন, এটা কিতাবের বিষয়। রাষ্ট্র ইচ্ছা করলেই মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী যেকোন আইন প্রণয়ন করতে পারবেন।
মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র, ১৯৪৮ এর সাথে তুলনা করলে বুঝতে পারা যাবে মৌলিক অধিকার সব সময় শর্তহীন। এই ঘোষণাপত্রে মোট ৩০টি ধারা আছে। উদাহরণ হিসাবে কয়েকটি উল্লেখ করছি।
"সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাঁদের বিবেক এবং বুদ্ধি আছে; সুতরাং সকলেরই একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে আচরণ করা উচিৎ।"
"জীবন, স্বাধীনতা এবং দৈহিক নিরাপত্তায় প্রত্যেকের অধিকার আছে।"
"কাউকে অধীনতা বা দাসত্বে আবদ্ধ করা যাবে না। সকল প্রকার ক্রীতদাস প্রথা এবং দাসব্যবসা নিষিদ্ধ করা হবে।"
"কাউকে নির্যাতন করা যাবে না; কিংবা কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না অথবা কাউকে এহেন শাস্তি দেওয়া যাবে না।"
"আইনের সামনে প্রত্যেকেরই ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের অধিকার আছে।"
এইগুলি কয়েকটা উদাহরণ। লক্ষ্য করলে দেখবেন অধিকারগুলি নির্জলা শর্তহীন।
জনরাষ্ট্র ভাবনা-১৮