সংবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি: (১৫)
রাষ্ট্রপতি: সোনার পিঞ্জিরায় বন্দী
সংবিধানে রাষ্ট্রপতি শব্দটা ১৬৩ বার ব্যবহার করা হয়েছে। এতে মনে হতে পারে রাষ্ট্রপতি না জানি কত ক্ষমতাধর। ৪৮ ধারাটা আপাতত না পড়ে বাকি ধারাগুলি পড়লে মনে হবে রাষ্ট্রপতি বিপুল ক্ষমতার অধিকারী। কারণ এই রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপ-মন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতি, অস্থায়ী বিচারপতি, অ্যাটর্নি-জেনারেল, নির্বাচন কমিশন, মহা হিসাব-নিরীক্ষক, সরকারী কর্ম কমিশনের সভাপতি ও অন্যান্য সদস্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ প্রদান করেন। রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি অনুসারে তারা স্বপদে বহাল থাকেন।
এই সব গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে নিয়োগ দান ছাড়াও রাষ্ট্রপতির আরো কত ক্ষমতা আছে, যেমন, রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদন ব্যতীত কোন নাগরিক কোন বিদেশী রাষ্ট্রের নিকট হইতে কোন খেতাব, সম্মান, পুরস্কার বা ভূষণ গ্রহণ করতে পারে না; কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে−কোন দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করার এবং যে−কোন দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা; সরকারী কার্যাবলী বণ্টন ও পরিচালনার জন্য বিধিসমূহ প্রণয়ন করার ক্ষমতা; তিনি প্রতিরক্ষা বিভাগের সর্বাধিনায়ক, অধ্যাদেশ প্রণয়ন করার ক্ষমতা; জরুরী-অবস্থা ঘোষণা করার ক্ষমতা; নান ধরণের বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা; এটা সেটা করার কত কি ক্ষমতা। আরো অনেক ক্ষমতার কথা সংবিধানে লেখা আছে। এইগুলি উল্লেখ করা বাহুল্য মাত্র।
এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও একজন রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতা সম্পর্কে হতাশ হয়ে বলে ছিলেন যে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হচ্ছে শুধু কবর জিয়ারত এবং মোনাজাত করা। কিন্তু ৪৮ ধারার বিধান অনুসারে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতাও নাই।
৪৮ ধারার (৩) উপধারায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করেছেন কি না এবং করে থাকলে কি পরামর্শ দান করেছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করতে পারবেন না।
এই ধারাটা সাধারণ ভাবে পড়লে মনে হবে, যাই হউক, বিশাল দুইটি ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে আছে। তিনি ইচ্ছা অনুসারে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে পারবেন। প্রকৃতপক্ষে এই দুইটি নিয়োগের ক্ষমতাও যে তার হাতে নাই, তা পরে আলোচনা করবো।
এই দুইটি ক্ষমতা ছাড়া বাকি ক্ষমতাগুলি কলমের এক খুঁচায় কেড়ে নেয়া হয়েছে, এই বলে যে, এই দুইটি ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে সব কাজের পরামর্শ দিবেন আর রাষ্ট্রপতি সেই পরামর্শ অনুসারে কাজ করবেন। এখানে "পরামর্শ" শব্দটা ভদ্রতা ও শালীনতার খাতিরে ব্যবহার করা হয়েছে। সংবিধানের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুসারে প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী তার নিযুক্ত রাষ্ট্রপতিকে "নির্দেশ" দিবেন আর রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী "নির্দেশ" পালন করবেন।
এইভাবে রাষ্ট্রপতির সব ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার পরও সংবিধান প্রণেতারা নিশ্চিত হতে পারছেন না। তাদের আশঙ্কা যে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী পরামর্শের বাইরে কোন কিছু একটা করে ফেলতে পারেন। তাই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে চূড়ান্তভাবে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য আরো একটি দফা সংযুক্ত করে দিয়ে বলেছেন যে তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করেছেন কি না এবং করে থাকলে কি পরামর্শ দান করেছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।
এই শর্তের দ্বারা এক দিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে চূড়ান্ত ভাবে নিঃশেষ করা হয়েছে, অপর দিকে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করে তাকে একনায়ক স্বৈরাচারে পরিণত করা হয়েছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কর্মকাণ্ডকে অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রপতিকে কি পরামর্শ দিয়েছেন তা জনগণের দৃষ্টির আড়াল করে এই দেশের নাগরিকদের উপর চূড়ান্ত অনাস্থা প্রকাশ করা হয়েছে।
৪৮ ধারায় রাষ্ট্রপতিকে যে দুইটি ক্ষমতা দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা আসলে শুভঙ্করের ফাঁকি। এই দুইটি ক্ষমতা আসলে আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
রাষ্ট্রপতি কি তার ইচ্ছা মত যে কাউকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে পারবেন?
সহজ উত্তর, না, পারবেন না।
৫৬ ধারার (৩) উপধারায় প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের বিধান দেয়া আছে। সেখান বলা হয়েছে, "যে সংসদ-সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হইবেন, রাষ্ট্রপতি তাঁহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন।" অর্থাৎ নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে যে ব্যক্তি সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন পাবে সেই প্রধানমন্ত্রী হবে। এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কাজটা হচ্ছে একটি আনুষ্ঠানিকতা। সহজ কথায় বললে, প্রধানমন্ত্রী কে হবে তা ঠিক করছে সংসদ, রাষ্ট্রপতি নয়।
৪৮ ধারায় রাষ্ট্রপতিকে আরো একটি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেটি হচ্ছে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা। আপাতদৃষ্টিতে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতাটা মৌলিক ও চূড়ান্ত বলে মনে হতে পারে। এমন একটি ধারণা হবে যে এই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা সংসদের পরামর্শ বা অনুমোদনের কোন প্রয়োজন নাই। রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলেই তার পছন্দ মত যে কাউকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে পারেন। বাস্তবিক পক্ষে প্রক্রিয়াগত কারণে রাষ্ট্রপতি সেই ক্ষমতাও প্রয়োগ করতে পারেন না। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পুরা প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। সংবিধানের ৫৫ ধারা অনুসারে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তার কর্তত্বে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়। অর্থাৎ আইন মন্ত্রণালয় যে কাজ করছে তা প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতার একটি অংশ।
উপসংহার:
ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্রের ধারণা থেকে সংবিধান প্রণেতাদের মাথায় এই ধরণের ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রপতি পদের ধারণাটা এসেছে। তবে এই ধারণার পিছনে দুটি মৌলিক ভুল ও অসততা পরিলক্ষিত হয়।
প্রথম ভুল হচ্ছে, ইংল্যান্ডের রাজা বা রানী বংশপরম্পরায় সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই প্রক্রিয়ায় জনগণের কোন ভূমিকা নাই। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত। এক অর্থে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও জনগণের প্রতিনিধি। এই কারণে বাংলাদেশ একটি রিপাবলিক বা জনরাষ্ট্র।
দ্বিতীয় ভুলটি হচ্ছে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করা। ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জন এবং বিদ্রোহী ব্যারনরা মেগনাকার্টা (Magna Carta) দলিল স্বাক্ষর করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ইংল্যান্ডের রাজা তার ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে পার্লামেন্টের কাছে, তথা জনগণের কাছে, হারাতে থাকেন। একপর্যায়ে রাজার ক্ষমতা আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়।
তবে পরিতাপের সাথে বলতে হয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করে একটি কর্তৃত্ববাদী একনায়ক প্রধানমন্ত্রী সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ও অসৎ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতির পদটিকে এই রকম ক্ষমতাহীন করে সৃষ্টি করা হয়েছে।
জনরাষ্ট্র ভাবনা-১৯