আকাশলীনা]
ভাদ্র ১৪১৮ :: আগস্ট ২০১১ :: বর্ষ ০২ :: সংখ্যা ০২
---------------------------------------------------------------------------------
পাঠ-পূর্বক বিজ্ঞপ্তি]
আকাশলীনা- মূলত এটি একটি ছোট পত্রিকা; প্রতি বাংলা মাসের প্রথম সপ্তাহে মুদ্রণ কাগজে প্রকাশিত হয়।
বলা যেতে পারে, সাদা-কালোয় প্রকাশিত এটি আমাদের রঙিন এক স্বপ্নের গল্প!
এখানে মূল পত্রিকার বর্তমান সংখ্যাটি অনলাইন পাঠকদের জন্য সরবারাহ করা হয়েছে। ভালোলাগা-মন্দলাগা বিষয়ে যে কেউই মন্তব্য করতে পারেন...
পত্রিকাটির মুদ্রিত কপি নিয়মিত পেতে চাইলে; ফোন নম্বরসহ আপনিও ঠিকানা লিখে জানান।
আমাদের সম্পাদনা পরিচিতি এবং সরাসরি যোগাযোগ করার ঠিকানা এই লেখার নিচে উল্লেখ আছে।
সকলকে ধন্যবাদ।
-সম্পাদক, আকাশলীনা
-------------------------------------------------------------------------------
মূল পত্রিকা এখান থেকে শুরু-
-------------------------------------------------------------------------------
:: সম্পাদকীয় ::
দেখতে দেখতে কেটে যাওয়া, দীর্ঘ এক বছর আসলেই কম সময় নয়। গত সংখ্যার বর্ষপূর্তির বিশেষ আয়োজন আমাদের এই উপলদ্ধি এনে দিলো। কাছের-দূরের, সকল পাঠকদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে এই ছোটকাগজটি।
নতুন বছরে পর্দাপন উপলক্ষে, আকাশলীনা-র বক্তব্যে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে- মুক্ত প্রাণ, স্বপ্নের সোপান। এই পরিবর্তীত মন্ত্রে আমরা বলতে চেয়েছি যে, সবকিছুর জন্যই সবার আগে প্রয়োজন মুক্তপ্রাণ মানুষের; যে প্রাণগুলো, স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে, তথা সত্যিকারের সঠিক কোনো পথ দেখিয়ে আমাদের নিয়ে যাবে সাফল্যের পথে।
আকাশলীনা-র জামালপুরের বন্ধু-পাঠক বিলকিস লাবনী মুঠোফোনে জানিয়েছেন, এ কথার ভেতর তিনি দারুণ অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
আমরা বলবো- এই-ই আমাদের সার্থকতা, সাফল্য। কাজের মূল্যায়ন।
নিশ্চয় এমনই ছোট ছোট ভালোলাগা আর অনুপ্রেরণার গল্প নিয়ে, আকাশলীনা এগিয়ে যাবে আরো দূরের পথ...
আকাশলীনা-র জন্য ফেসবুকে একটি পেজ আছে; চাইলে, যে কেউ এ পাতাটিতে যোগ দিয়ে নিয়মিতভাবেই আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেন। তারপর, বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে, আকাশলীনা-র দেয়ালে লিখে যান মনের অনুভূতিগুলো... সেরা অনুভূতিগুলো নিয়মিতভাবেই সংকলিত হবে মূল পত্রিকায়।
আকাশলীনা-এর সঙ্গে থাকুন।
ভালো হোক সবার- ঈদ শুভেচ্ছা... []
------------------------------------------------------------------------------
:: ঈদ বিশেষ ::
সাদা শাড়ি, কালো পাড়
আবদুল্লাহ আল ইমরান
হঠাৎ হঠাৎ তিনি আসতেন। নির্দিষ্ট কোনো সময় ছিলো না। আমাদের সুনসান বাড়িতে প্রায়ই তিনি লম্বা সময় কাটাতেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল কিংবা বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি বিপুল আগ্রহে নিজের কষ্টের কথা বলতেন। শোনাতেন পরাজিত মানুষের জীবনদর্শন। শ্রোতা কেবল আমার নিঃসঙ্গ মা। মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গেও মানুষটার দেখা হতো। বয়সী চোখে-মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তিনি বলতেন, ‘কেমন আছো, ভাই?’
অচেনা মানুষের এমন আন্তরিকতায় আমার খুব অস্বস্তি লাগতো। বয়সের ভারে তিনি ঠিকঠাক চলতেও পারতেন না। ছোট্ট লাঠিতে ভর করে ধীর পায়ে হাঁটতেন। তার চলার গতি দেখে ছোট্ট আমি খুব অবাক হতাম। ভাবতাম, রাত নেমে আসার আগেই বুড়িটা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে তো! আমার বিস্ময়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঘোরলাগা কোনো এক কুয়াশার সকালে তিনি ঠিকই আবার হাজির হতেন। সেই চেনা ঢঙে কুশল জানতে চাইতেন।
বয়স্ক মানুষটার পাশে বসে মায়ের মতো কথা বলার তাগিদ অনুভব করিনি কখনো। জানতে ইচ্ছে হয়নি তিনি কোথায় থাকেন, কেমন থাকেন। মাকেই কেবল দেখতাম মানুষটাকে মমতার চদরে জড়াতে। সংসারের টানাপোড়েন সামলে মা তাঁর হাতে তুলে দিতেন মুঠোভর্তি চাল, কখনো এক-আধটা আলু-পেঁয়াজ। এভাবেই ক্রমে ক্রমে তিনি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে ওঠেছিলেন।
যে কোনো উৎসব আর আয়োজনে তিনি দাওয়াত পেতেন। চুপচাপ বসে থাকতেন বাড়ির এক কোণে। ব্যস্ততার ফোঁকর গলিয়ে মায়ের নির্দেশে কেউ খাবার দিয়ে গেলে, মাথা গুঁজে সেই খাবার খেতেন। তাঁর মুখায়বে লেগে থাকতো ক্লান্তি, থাকতো হতাশা। কিন্ত কেনো যেনো আমায় দেখলেই হেসে ফেলতেন। ব্যস্ত হয়ে ওঠতেন কথা বলার জন্য। আমি সহসাই পাত্তা না দিয়ে বেরিয়ে যেতাম। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন আমার চলে যাওয়া পথে।
রোজা এলেই তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। মাকে ফিতরার টাকা জমিয়ে রাখতে দেখতাম। কখনো সে টাকায় শাড়িও কিনতেন। সাদা শাড়ি, কালো পাড়। রোজার শেষের দিকে এসে শাড়ি কিংবা টাকা নিয়ে যেতেন তিনি। নতুন শাড়ি পেয়ে বুড়িটার চোখের ভাষা কেমন হয়, আমার কখনো দেখা হয়নি। অনাগত ঈদের অনন্দে আমরা তখন বিভোর থাকতাম, নয়তো নতুন জামা-কাপড় কেনায় ব্যস্ত। বাড়ি ফিরলে মায়ের কাছে তাঁর আসার খবর শুনতাম। বুড়িটার জন্যে মায়ের এমন মমতা আমাদের কাছে অতিরঞ্জিতই মনে হতো।
খুলনা ছাড়ার আগ পর্যন্ত প্রতি ঈদের সকালেই তাঁকে আমাদের বাড়িতে দেখেছি। ধবধবে সাদা শাড়ি পরে দরজার কোণে বসে থাকতেন। সেমাই খেতেন। আমারা ছোটরা হৈ-হুলোড় করতাম। তিনি মুগ্ধ হয়ে আমাদের আনন্দ দেখতেন। ধীরে ধীরে তাঁকে আর ঐচ্ছিক মনে হতো না।
পড়াশোনার জন্যে বাড়ি ছাড়ার পর আর একবারই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো। সেবারের ঈদে তাঁকে দেখে আমি ভয়ই পেয়েছিলাম। চোখ দুটি কেমন ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলো। অনেক রোগাও হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। চলার গতিও আগের চেয়ে অনেক মন্থর ছিলো। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি পড়ে যাবেন! তবু আমাকে দেখে নিঃশ্বাস টেনে টেনে জানতে চাইলেন, ‘কেমন আছে ভাই, চিনতে পারছো?’
আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। প্রতিত্তুরে বলি, ‘ভালো আছি, আপনি ভালো আছেন বুড়ি মা?’ খুশিতে তাঁর চোখ চকচক করে ওঠে। দ্রুতগতিতে তিনি মাথা ঝাঁকান।
গেলো ঈদে ছোট ভাই আর মায়ের জন্য কেনাকাটা করতে গিয়ে আমার বুড়ি মায়ের কথা মনে পড়ে। তখনই মনটা কেমন করে ওঠে। স্মৃতিকাতর হয়ে তাঁর জন্যে একটা শাড়ি কিনি। সাদা শাড়ি, কালো পাড়। বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে অন্যান্য উপহারগুলির সঙ্গে বুড়ি মায়ের শাড়িটাও এগিয়ে দিই। তিনি কেমন আছেন জানতে চাই। মায়ের কন্ঠে ঝরে পড়ে দীর্ঘশ্বাস, ‘বহুদিন আসে না রে বাবা। বোধহয় মারা গেছে। সে দেখতে হুবহু তোর দাদির মতো ছিলো।’
নির্বাক আমার দুচোখ ছলছল করে ওঠে... []
::
স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক সকালের খবর
------------------------------------------------------------------------
:: গল্প ::
উচিত শিক্ষা
রুবেল কান্তি নাথ
নরপশুটি ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। সে ভয়ে সিঁটিয়ে যায় দেয়ালে। আত্মরক্ষার কোনো উপায় যে তার জানা নেই! যে তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্ষুধার্থ হায়েনার মতো এগিয়ে আসছে, সে তার মনিব। তাকে কীভাবে রুখবে সে?
নরপশুটি তাকে ঝাঁপটে ধরে মেঝেতে শুইয়ে দেয়। একটানে খুলে ফেলে তার পরনের শাড়িটা। জোরপূর্বক ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুষতে থাকে। মেয়েটি চিৎকার করতে পারে না। রক্তচক্ষুর সামনে চিৎকার করার শক্তি সে হারিয়ে ফেলে। শাড়ি খোলার পর, নরপশুটির হাত এবার তার ব্লাউজ খুলতে ব্যস্ত...
তারপর... তারপর অমানবিক-পাশবিক নির্যাতন চালাতে থাকে লোকটা মেয়েটার ওপর। সদ্য যৌবনে পা রাখা মেয়েটির জীবন মুহূর্তেই তছনছ করে দেয় পশুটা। আয়েশী যৌনক্ষুধা মেটায় নতুন কাজে যোগ দেওয়া কাজের মেয়েটিকে দিয়ে।
০২.
‘আম্মা, তোমার তো বয়স হইছে। তুমি যে বাড়িতে বুয়ার কাম করো, সেই বাড়িতে গিয়া কইবা- এহন থেইকা আমিই তোমার কাম করুম। তুমি বাসায় বইসা শুধু মা-মাইয়ার জন্য দুইডা ভাত রানবা।’
‘হ, মাছুমা। আমিও কয়দিন ধইরা সেইডাই ভাবতাছি। আমার এই বয়স্ক শরীরে আর পারতাছি না। পোলা দুইডা তো বিয়া কইরা আলাদা হইয়া গ্যাছে। আর তোর বাপ তো সেই কবেই আমাগো ছাইড়া আল্লার কাছে গ্যাছে-গা! এহন তই ছাড়া আমার তো কোনো ভরসা নাই রে, মা।’
‘মা, তুমি চিন্তা কইরো না। আমি ঠিক ঠিক তোমার আর আমার খাওয়নের ব্যবস্থা কইরা নিমু নে।’ মাছুমা মাকে সান্ত্বনা দেয়।
পরদিন থেকেই করিম সাহেবের বাড়িতে, মায়ের বদলে কাজে যোগ দেয় মাছুমা। কিশোরী থেকে যুবতীর ধাপে পা রেখেছিলো সে কিছুদিন হয়। যে কারণে, ওর ওপর কু-নজর পড়ে করিম সাহেবের। যার বাড়িতে রয়েছে একজন সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী স্ত্রী। যার রয়েছে দুটো সন্তান। বড় ছেলেটা আর কিছুদিন পরই উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। যার স্ত্রী কিনা একজন মানবাধিকার কর্মী। সেই করিম সাহেবের লোলুপ দৃষ্টি গিয়ে পড়ে কাজের মেয়ে মাছুমার ওপর।
একদিন সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়েও পড়েছিলো সে ক্ষুধার্ত বাঘ হয়ে চঞ্চলা হরিণীটির ওপর।
০৩.
মাছুমা কোনোমতেই ব্যাপারটি ওর মাকে বলতে পারছে না। যদি সব বলে দেয় সে; মা তো আর কোনোদিনই করিম সাহেবের বাড়িতে কাজ করতে দেবে না। কাজ যদি না-ইবা করে, তবে মাছুমারা খাবে কি?
করিম সাহেবের স্ত্রীকেও বলা যাবে না এ কথা। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না, পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোকটা এ ধরনের অপকর্ম করতে পারে। তিনি উল্টো মাছুমাকেই শাসাবেন। এমনকি, ওর এই একমাত্র কাজটাও চলে যেতে পারে। আর কাজটা বন্ধ হয়ে গেলে... মাছুমা এরচেয়ে বেশি ভাবতে পারে না।
ও সিদ্ধান্ত নেয়, ব্যাপারটা সে কাউকে বলবে না। এমনকি মাকেও না। ব্যাপারটা জানবে শুধু সে এবং বিধাতা।
সবকিছু ভুলে আবারো কাজে মন দিলো মাছুমা...
০৪.
‘ভাইজান, আসুম?’ করিম সাহেবের ছেলে হাসানের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে মাছুমা।
‘আয়।’
‘ধরেন আপনার কফি।’
‘মাছুমা, একটা জিনিস দেখবি?’ বলে হাসান।
‘কী ভাইজান, শাকিব খানের সিনেমা নাকি? আমি আবার ভাইজান, শাকিব খানরে বড়ই পছন্দ করি।’
‘আরে না। আচ্ছা শোন, মাম্মি কোথায় রে?’
‘খালাম্মা তো কিছুক্ষণ আগেই বাইর হইয়া গ্যাছে-গা। কইলো, ফিরতে দেরি হবে?’
‘আর তাসান কি স্কুলে গেছে?’
‘হ। উনি তো সকালেই স্কুলে গ্যাছে-গা। ক্যান ভাইজান, আইজ আফনে এতোসব জিগাইতাছেন ক্যান? আমার কেমন জানি লাগতাছে।’ দুরু দুরু বুকে হাসানকে এসব কথা বলে মাছুমা। ওর মন কু ডাকতে থাকে। আজ কেনো জানি হাসানকে তার বড় অচেনা লাগছে।
‘আরে এমনিই জিজ্ঞেস করেছি। আসলে তুই তো আমাদের কাজের মেয়ে, আর আমি মালিকের ছেলে। একসাথে দুজন সিনেমা দেখছি দেখলে, ড্যাডি-মাম্মি তো মাইন্ড করবে। তাই আর কি!’ কথা বলতে বলতে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দেয় হাসান।
‘ভাইজান, আমার ভয় ভয় করতাছে। আমি সিনেমা দেখুম না, ভাইজান!’ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলতে থাকে মাছুমা।
হাসানের ব্যক্তিগত কম্পিউটারের পর্দায়, ততোক্ষণে ভেসে ওঠে নর-নারীর সেই আদিম দৈহিক মিলন।
মাছুমা তড়িৎ আঁচল দিয়ে চোখ ঢাকে। ওর কানে ভেসে আসে শীৎকারের শব্দ।
মাছুমা নিজের চোখকে এসব না দেখা থেকে রক্ষা করতে পারলেও, নিজের দেহকে কিছুতেই রক্ষা করতে পারে না হাসানের কাছ থেকে। অর্থাৎ, মাছুমা দ্বিতীয়বারের মতো নির্যাতিত হলো আরেক নরপশুর হাতে।
০৫.
মুখ বুজে সব সহ্য করেই বিপদে পড়ে গেলো বেচারি মাছুমা। দিন দিন পশুদের চাহিদা বাড়তেই থাকলো।
এভাবে আর কতোদিন? ...ভাবে সে। ওরও তো একটা স্বপ্ন ছিলো; কাজ করে মা আর মেয়ে কোনোমতে খেয়ে-পরে বাঁচবে। কখনো যদি কোনো এক স্বপ্নপুরুষের সঙ্গে সংসার হয়, তাহলে সব ছেড়ে দিয়ে স্বামী-সন্তানকে নিয়েই সুখের সংসার সাজাবে। কিন্তু এই নরপশুগুলো যে এর আগেই ওর সবকিছু তাসের ঘরের মতো ভেঙে দিলো?
না। আর এভাবে হতে দেওয়া যায় না। একটা কিছু করতেই জবে মাছুমাকে। একটা কিছু করতেই হবে।
প্রতিশোধের নেশায় বারবার কথাটি মনের ভেতর আওড়াতে থাকে সে। এ সময়ই ওর মাথায় দারুণ একটা ভাবনা খেলে যায়! সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, যে করেই হোক, ভাবনাটাকে বাস্তবে রূপ দিতেই হবে।
০৬.
‘মাছুমা, অ্যাই মাছুমা! কোথায় গেলি তুই?’ করিম সাহেব চিৎকার করতেই থাকেন।
‘জ্বে, খালুজান! কী হইছে আপনের? কিছু লাগবো?’ ভেতর থেকে মাছুমা ছুটে এসে বলে।
‘না, তেমন কিছু না। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। একটু গা-টা ম্যাসাজ করে দে তো।’
‘জ্বে, খালুজান। দিতাছি।’ বলে করিম সাহেবের শরীরটা ম্যাসাজ করতে থাকেত মাছুমা।
মাছুমার কিছু বুঝতে আর বাকি থাকে না। নিশ্চয় কিছুক্ষণ পরই সুযোগ বুঝে নরপশুটা ওর শরীরে হাত দেবে। ওর কচি শরীরটা নিয়ে মেতে ওঠবে পাশবিক খেলায়। কিন্তু আজ ঘটনাটা অন্যদিকে মোড় নিতে পারে। কারণ, মাছুমা যে তার ভাবনাটাকে আজ দারুণভাবে কাজে লাগাবে বলে ঠিক করেছে!
করিম সাহেব যখন মাছুমার শরীর নিয়ে চূড়ান্তে পৌঁছে যেতে চাইলো, ঠিক তখনই সুযোগ বুঝে কাজটা করে ফেলে মাছুমা। করিম সাহেব তখন কুরবানির গরুর মতো ছুটফট করতে শুরু করেন।
দৃশ্যটা দেখতে বড়ই ভালো লাগছিলো মাছুমার! বড়ই ভালো!
০৭.
জীবনের চরম শিক্ষাটা সে দিয়েছে করিম সাহেবকে। সে আর কোনোদিন কোনো মেয়ের সবনার্শ করতে পারবে না। বাপের শিক্ষা দেখে যদি ছেলেটাও শিক্ষা পায়- তবে তো ভালো। নাহলে, অন্য কোনো মাছুমার হাতে করিম সাহেবের মতো শিক্ষাটা সেও পেয়ে যেতে পারে।
মাছামার সাথে শারীরিক মিলনে বিভোর থাকাবস্থায় মাছুমা সুযোগটা কাজে লাগায়। অনেকদিন ধরে সুযোগটা খুঁজছিলো সে। কোমরে সবসময় গুঁজে রাখতো তরি-তরকারি কাটার ধারালো ছোরাটা। যার ধারালো এক পোঁচে সে কেটে ফেলেছিলো নরপশুটার শিশ্ন!
মনে মনে এই ভেবে তৃপ্ত পেলো মাছুমা যে, ব্যাটাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে।
একেবারে উচিত শিক্ষা! []
::
দক্ষিণ কাট্টলী, চট্টগ্রাম
-----------------------------------------------------------------------------
:: বন্ধু দিবস ::
কিছু ভালোবাসা কি অবশিষ্ট ছিলো?
দেব গাঙ্গুলি
আমার সঙ্গে জনির বন্ধুত্ব হওয়ার অনেক আগেই ওর বাবা মারা যায়। আর, আমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হওয়ার কিছুদিন পর ওর মাও মারা যায়। বোনদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর, ভাইরা জনিকে ঘর থেকে বের করে দেয়। অবহেলা-অনাদর পেতে পেতে জনি কোনো কাজ-কাম করতো না; ঘুরে বেড়াতো আর পাড়ায় মাস্তানি করতো। মাস্তানি করলেও বন্ধুত্বটাকে অনেক মূল্য দিতো। ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হওয়ার পর, ওকে একটু মানুষ করার ইচ্ছে হয়। এতে ওরও প্রশ্রয় ছিলো।
সবার কাছে মাস্তান হলেও, আমার কাছে জনি একজন বন্ধুর মতো। ওর ভাইয়েরা ঘর থেকে বের করে দিলে; ও প্রথম কয়দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কাটায়। আমি যখন বিষয়টা জানলাম, ওকে আমার এলাকায় নিয়ে এলাম। এতিম এ ছেলেটার প্রতি আমার ছিলো গভীর মমতা। এক বন্ধুর বাড়িতে দোতলার একটা ঘর সবসময়ই খালি পড়ে থাকতো; সেখানে জনিকে রাখার মতো একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। ওকে বলে দিয়েছি, ‘যে কয়দিন থাকা যায়, এখানেই থাক।’
পরদিন রাতে জনির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ওর অবস্থা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে গিয়ে আমি অবাক হই। সারাদিন না খেয়ে আছে। আমার বাড়িওয়ালার বন্ধর ওপর ভরসা করেছিলাম। বলে যাওয়ার পরও সে জনির খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলো না, কিংবা করেনি। এবার নিজেকে অপরাধী মনে হলো। দৌড়ে বাসায় এলাম। এদিকে সবার রাতের খাওয়া শেষ। ভাত নেই; আছে খানিকটা বেগুন তরকারি। এখন কি করা যায়?
মাকে দুটো আটার রুটি বানিয়ে দিতে রাজি করালাম। কে খাবে- মায়ের এমন প্রশ্নের মুখে কোনো জবাব দিইনি। জনির মতো মাস্তান ছেলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে; এটা মা কোনোভাবেই মেনে নেবেন না। যাই হোক, রুটি-তরকারি আর এক বোতল পানি নিয়ে ফিরে এলাম জনির কাছে। পাশে বসে থেকে ওকে খেতে বললাম। জনির খাওয়ার দৃশ্যটা দেখে চোখের জল আর কোনোভাবেই আটকাতে পারিনি।
আমার মতো এক স্কুল পড়–য়া ছেলে, জনির জন্য এরচেয়ে বেশি কিই-বা করতে পারে?
০২.
জনি নিজের জীবিকার খোঁজে আলাদা হয়ে পড়ে। অনেকদিন ওর কোনো খোঁজ পাইনি।
সেদিন ছিলো ২৪ ডিসেম্বর, ২০০৪-এর ঘটনা- হঠাৎ করেই জনি আমার ফোনে কল করে বসলো! এ কথা, সে কথার পর ওর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত হয়। গেলাম।
এতোগুলো বছর পর জনিকে সামনে পেয়ে আবেগ হারিয়ে ফেলি। অনেকক্ষণ ওকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। অনেক কথা হয়। দুজনে খোলা আকাশের নিচে ঘাসের ওপর বসে আকাশ দেখি।
হঠাৎ করেই বললো, ‘তোর ফোনটা একটু দে তো?’
আমি কিছু না ভেবে পকেট থেকে ফোনটা বের করে দিয়ে দিলাম। দেখলাম, জনি ফোনটা বন্ধ করে আমার সিম কার্ডটা খুলে ফেলে। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, ‘এক বড় ভাইকে কল দিতে হবে। নম্বর মুখস্থ নেই। তাই তোর সিমটা ভরে আমার অন্য একটা সিম ভরছি।’
দেখলাম, জনি ওর মানিব্যাগ থেকে একটা সিম কার্ড বের করে ফোনে ভরে। ফোন চালু করে ওর বড় ভাইকে কল দেয়।
আমি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ওর পাশে বসে থেকে ভাবি- জনির অনেক উন্নতিই হয়েছে! স্বাস্থ্য সুঠাম, ফর্সা হয়ে গেছে গায়ের রঙ। মাথার চুলগুলো লম্বা হওয়াতে পেছনে মেয়েদের মতো রাবার পেঁচিয়ে রেখেছে।
হঠাৎ শুনতে পেলাম, জনি ওর বড় ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করছে, ‘হ্যাঁ, ভাই? প্যাকেটটা কোথায় রেখেছেন বললেন? দেওয়ালের পেছনে? ও আচ্ছা, আচ্ছা! ঠিক আছে, আমি দেখতেছি... রাখলাম।’
জনি কলটা কেটে দেয়।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমাকে বলে, ‘তুই বোস। আমি এই পেছন থেকে আসছি।’
দেখলাম, জনি মাঠের দেয়ালটা টপকে ওপাশে নেমে গেছে। আমি বসে আছি। ভাবছি, এভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে কিসের প্যাকেট খুঁজছে জনি? ও কি আগের মতোই খারাপ আছে? নাকি আরো নষ্ট হয়ে গেছে? ... নাহ! একজন সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে এভাবে ভাবা ঠিক হচ্ছে না। জনি নিশ্চয় পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে। নয়তো, এতোগুলো বছর পরও ও আমাকে ভুলে যায়নি; এটা অবশ্যই ছোটখাটো কোনো ব্যাপার নয়।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, প্রায় ছয় মিনিটের ওপর হতে চললো; অথচ জনির ফেরার কোনো নাম-গন্ধ নেই। এতো সময় কি করছে ও?
কৌতুহল চাপতে না পেরে আমিও উঠে গিয়ে দেয়াল টপকাই। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওকে দেখতে পেলাম না। বাজারের দিকে চলে যাওয়া রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, ওদিকে গেছে কি? গলা ফাটিয়ে কতোক্ষণ ডাকলাম, ‘জওওওনিইইই... জওওওনিইইইইই...’
ভীষণ ধাক্কা খেলাম।
জনি কি আমার মুঠোফোনটা নিয়ে পালিয়েছে? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো... আবার ফিরে এলাম মাঠে। প্রায় একঘণ্টার মতো বসে থাকলাম ওর অপেক্ষায়। হয়তো আশে-পাশে কোথাও গেছে। নিশ্চয় বেচারা ফিরে আসবে।
০৩.
সেদিন আর জনি ফেরিনি।
বাবার বাজেটের অনেক বাহিরের ছিলো মুঠোফোনের দামটা। তবু কিনে দিয়েছিলেন; ছেলে পরীক্ষায় ভালো করেছে- একটা ফোন পছন্দ করেছে, ভালো বাবা হিসেবে তিনি কিনে না দিয়ে পারলেনও না।
জনি সেই ফোনটা নিয়েই হওয়া হয়ে গেলো? এতোগুলো বছর পর, ও এমনই একটা প্রতারণার জন্য আমাকে ডেকে আনলো?
কিছুদিন পরই খবর পেলাম, জনি ফের এলাকায় ফিরেছে। এবার আর দেখা করতে যাইনি। যোগাযোগও করলাম না। চাইলে একটা চরম শিক্ষা দেওয়া যেতো। ইচ্ছে হয়নি।
তবে কি এতোসবের পরও, এই মনে ওর প্রতি কিছু ভালোবাসা অবশিষ্ট ছিলো?
::
লেখাটি পরিমার্জন করেছেন সাইফুল আমিন
------------------------------------------------------------------------------
:: কৌতুক ::
ডাক্তার সাহেব পিকনিক করতে যাবেন। তাই ডাক্তারখানা দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন তাঁর সহকারি হাবুলের ওপর।
পিকনিক সেরে দুদিন বাদে ডাক্তার সাহেব ফিরে এসে, হাবুলের কাছে জানতে চাইলেন, ‘রুগি-টুগি এসছিলো কিনা?’
‘জ্বি,’ হাবুল মাথা নেড়ে বলে। ‘তিনজন এসেছিলো। একজনের সর্দি হয়েছে; অন্যজনের মাথা ধরেছে- আমি ওষুধ দিয়ে দিলাম।’
এ ধরনের রোগের সঠিক ওষুধই দিয়েছে হাবুল, এ ব্যাপারে ডাক্তার সাহেবের আত্মবিশ্বাস আছে। তিনি আর বিস্তারিত জানতে না চেয়ে, বললেন, ‘আরেকজন রুগি?’
‘হ্যাঁ, একটা সুন্দরী মেয়ে এসেছিলো। হঠাৎ ছুটে এসেই হুট করে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে! বললো, “তিন বছর কোনো পুরুষের গন্ধ পাই না!” শুনে তো বারবার ভিমড়ি খাচ্ছিলাম...’
ডাক্তার সাহেব চমকে ওঠে নাকের ওপর নেমে আসা চশমাটা ঠিক করে নিলেন। ছোট্ট করে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কী করলে?’
হাবুল হেসে বললো, ‘কী আবার? গন্ধ নিতে পারছে না, নাকে সমস্যা ছিলো বোধহয়- ড্রপ দিয়ে দিলাম!’
::
সংগ্রহিত
----------------------------------------------------------------------------
আকাশলীনা]
ভাদ্র ১৪১৮ :: আগস্ট ২০১১ :: বর্ষ ০২ :: সংখ্যা ০২
কৃতজ্ঞতা :: হিমেল অনার্য
সম্পাদক :: নোমান ভূঁইয়া
সহযোগী ::
জাহীদ ইকবাল, সাবরিনা আহমেদ, শফিক হাসান, মাহবুব আলম
মাসউদ আহমাদ, সাফায়েত হোসাইন, মেহেদী ফেরদৌস
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও পষ্ঠাসজ্জা :: রঙছুট
শব্দ বিন্যাস ও সমন্বয় :: সৈয়দা সুধন্যা
সার্বিক ব্যবস্থাপক :: সাইফুল আমিন
যোগাযোগ ::
+88 011 95199280
+88 018 18731377
[email protected]
http://www.facebook.com/akashlina.mag
মূল্য :: ১০ টাকা
সম্পাদক ও প্রকাশক
নোমান ভূঁইয়া কর্তৃক সার্কুলার রোড, ধানমণ্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত;
এবং হাতিরপুল, ধানমণ্ডি, ঢাকা ১২০৫ থেকে মুদ্রিত।
================================================
আকাশলীনা] ১৪ :: ভিন্ন আয়োজনে অন্য সাময়িকী
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রোড জ্যাম ইন ভিয়েতনাম
আমার ধারনা ছিল জটিল জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই লাগে । কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিল । ভিয়েতনামে এরকম জটিলতর জ্যাম নিত্য দিনের ঘটনা । ছবিটি খেয়াল করলে দেখবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা
২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন
যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!
এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন
নিউ ইয়র্কের পথে.... ২
Almost at half distance, on flight CX830.
পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১
হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন
সামুতে আপনার হিট কত?
প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন