(তিন)
আমি আর শফিক হাইস্কুলে উঠলাম। ভর্তি হলাম একই স্কুলে। আমাদের এলাকায় দুটো হাই স্কুল ছিলো তার মধ্যে বাড়ি থেকে প্রায় দুই মাইল দুরে ছিলো পাদ্রী স্কুল, যেটা খ্রিষ্টান পাদ্রীরা চালাতো। বাড়ি থেকে স্কুলে যাবার রাস্তায় বর্ষাকালে রাস্তায় হাটু পর্যন্ত থকথকে কাদা থাকতো। অতোদুরে আমরা যেতে পারবনা তাই বাড়ি থেকে মাত্র আধ মাইল দূরে আমাদের বাড়ির কাছের হাইস্কুলে দেয়া হলো। এই স্কুলের লেখাপড়ার মান ছিলো অনেক খারাপ। প্রতি বছর দুই-একজনের বেশি কেউ মেট্রিক পরিক্ষায় পাশ করতো না। কোন কোন বছর কেউই পাশ করতো না। প্রায় সবাই শ্রমিক-মজুরদের ছেলেমেয়েরা পড়তো সেখানে।
আশপাশের অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এসে ক্লাশ সিক্সে ভর্তি হতো। ছেলে মেয়ে একসাথে একই বেঞ্চে বসেই আমরা ক্লাশ করতাম। সমারেশ, আনোয়ার, মাইকেল, মিজানুর, গীতা, মাহিনুর বিলকিস সহ আরো অনেক নতুন বন্ধু জুটলো।
শফিক আর আমি প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প অবাক হয়ে শুনতাম। যেমনঃ বাড়ি থেকে সুপারি-নারকেল চুরি করে নিমাইর দোকানে বিক্রি করে টাউনে গিয়ে সিনেমা দেখার গল্প, দুই গ্রাম পেরিয়ে ওয়াপদার রাস্তার ওপারে বড় গাঙের বড় জাহাজ দেখতে যাবার গল্প, এপাড়ার জব্বার মেম্বার ওপাড়ার নুরু মেম্বারের সাথে রামদাও নিয়ে মারামারির লোমহর্ষক গল্প সহ আরো কতো কি।
একদিন আমরা পরামর্শ করলাম মাইকেল'কে সাথে নিয়ে আমরা তিনজন টাউনে গিয়ে সিনেমা দেখবো। মাইকেলের সবকিছু চেনা জানা আছে। কিন্তু টাকা পাবো কোথায়? মাইকেল বলেছে সিনেমার সেকেন্ড ক্লাশ টিকিট চার টাকা। তবে দুই টাকায়ও দেখা যায়। সিনেমা শুরু হলে দুই চার মিনিট পর গেটম্যানকে দুই টাকা দেখালে হলে ঢুকতে দেয় এবং একদম সামনে নিয়ে বসিয়ে দেয়। তবে শুধু দু'টাকা নিলে চলে না। আসা যাওয়ার বাস ভাড়া আর ছবির বিরতির সময় চিনাবাদাম বা কুলফি মালাই খাওয়া লাগে। সে জন্য অতিরিক্ত আরো এক/দুই টাকা সাথে থাকা লাগে। তা না হলে সিনেমা দেখার মজা নাই।
শুরু হলো সিনেমা দেখার জন্য টাকা জমানোর প্রানপন চেষ্টা। কিন্তু কোনভাবেই তিন চার টাকা জমাতে পারছিনা। অনেক কষ্ট করে দুইজন মিলে মুরগির ডিম-সুপারি-নারকেল-নারকেল কতো কিছু কুড়ি-বাইশ দিন ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে জমালাম। তারপর নিমাইয়ের দোকানে নিয়ে বেচলাম মাত্র ছয় টাকায়। এই টাকা তো সব সিনেমার গেটম্যানকেই দিতে হবে। এখন উপায়?
তাছাড়া মাইকেল আমাদের নিয়ে যাবে তাই ওর সব খরচা আমাদের। এই কঠিন শর্ত আরোপ করা ছিলো আমাদের উপর। চিন্তায় পড়ে গেলাম। অন্ততঃ আরো চার টাকা না হলে তো যাওয়া যাবেনা। কারন গাড়ী ভাড়া তিন জনের পঞ্চাশ পয়শা করে দেড় টাকা। আসা যাওয়ায় তিন টাকা তো লাগবেই। বাকি এক টাকার চিনা বাদাম দিয়ে নাহয় বিরতির খাবার চালিয়ে নেয়া যাবে।
মায়ের কাছে, বড় চাচির কাছে, কিংবা ছোট ফুপির কাছে টাকা চাইলে ২৫ পয়শার একখান সিকি অথবা ৫০ পয়শার একখান আধুলির বেশি পেতাম না তাই দুইজনের বাকি চার টাকা জমাতে আরো একমাস লেগে গেলো।
অবশেষে এলো সেই কাঙ্খিত দিন..........
(চলবে........)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০২২ বিকাল ৫:২৩