গত কয়েক বছর যাবত ধারাবাহিকভাবে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, বাসাভাড়া বৃদ্ধি, পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, সন্তানের শিক্ষা ব্যয়বৃদ্ধি, আর নিত্য পণ্যের আকাশ ছোঁয়া উচ্চমূল্যের নিষ্পেষণে আমরা যারা চাকরি করি কিংবা যাদের সনাতনী মধ্যবিত্ত নামে আখ্যায়িত করা হয় তাদের প্রায় সবাইকে পরান যায় যায় অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন গুজার করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ০২ শতাংশ যা গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
আগে দেখতাম রোজার আগে দেশের নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের দাম নিয়ে সিন্ডিকেট বাণিজ্যে চাঙ্গা হতো। এখন প্রায় সারা বছর আচমকা, হঠাৎ হঠাৎ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই মহোৎসব মহাসমারোহে রীতিমতো উদযাপিত হচ্ছে ঐ সব অসাধু ব্যবসায়ীদের মহলে পুরোপুরি সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে গেছে দেশের ভোজ্যতেল, চাল, পিয়াজসহ নিত্য পণ্যের বাজার। ব্যবসায়ীরা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বাজার থেকে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। চেষ্টা করলেও কিছুতেই তা সরকার নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছে না। শুধু চাল তেল নয় মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, পিয়াজ সব কিছুর দাম এখন উর্দ্ধে। তাতে উচ্চবিত্তদের অবশ্য কোন সমস্যা নেই।
শুধু জনগণ নয় সরকারও এই সিন্ডিকেটের কাছে নতজানু। কারন আমরা দেখেছি এই সিন্ডিকেটের কথা বিভিন্ন সময়ে সরকারি মহল থেকেও স্বীকার করা হয়েছে।
তাহলে কি সিন্ডিকেটওয়ালারাই দেশ চালায়? তারা কি সরকারের চাইতেও পাওয়ারফুল?
এই দুর্বৃত্ত সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোন না কোন পণ্যের দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট নিয়ে যাচ্ছে। সরকারের একাধিক বাজার তদারকি সংস্থাও এটা নিয়ন্ত্রণে প্রায় অকার্যকর, যেমনঃ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি সেল, মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, বিএসটিআই, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, র্যাবসহ সরকারের অন্যসব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সরকার ব্যবসায়ীদের ব্যাংক সুদের হার কমিয়েছে, কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়েছে, স্বয়ংক্রিয় করা হয়েছে বন্দরের শুলকায়ন পদ্ধতি। তারপরও তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু পায়নি সরকারও জনগন। এই অত্যাচারের মহোৎসব যেন কিছুতেই থামাতেই পারছে না কেউ আর।
অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যানের মতে- "বাজারের মূল আকর্ষণ হলো ক্রেতার বেছে নেয়ার স্বাধীনতা"। এখন কেউ কেউ হয়তো বলবেন ক্রেতার এক দোকান পছন্দ না হলে অন্য দোকানে গিয়ে কেনার স্বাধীনতা তো রয়েছেই। আসলেই কি তাই? সিন্ডিকেট করে যখন প্রতিযোগিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির বদলে একে অন্যের সহযোগী হিসেবে তারা একত্রিত হয় এবং একক কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তখন ভোক্তার সেই বেছে নেয়ার স্বাধীনতা আর থাকে না। অর্থনীতির ভাষায় পুঁজির ধর্ম হলো মুনাফা সর্বোচ্চ করন। কিন্তু আমার দেখছি পুঁজির ধর্ম এখন সুযোগ পেলেই ডাকাতি করে ভোক্তাকে নাজেহাল করা।
বাজারের একচেটিয়া আগ্রাসন থেকে জনগণকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বাজারে প্রতিযোগিতা না থাকলে সরকারের সেটা নিশ্চিত করা জরুরী। বাজারকে প্রতিযোগিতামূলক করতে অবশ্যই বিকল্প বাড়াতে হবে। বাজারে যদি প্রবেশে কোন বাধা না থাকে তাহলে একচেটিয়া সিন্ডিকেটওয়ালারা ক্রেতার সাথে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে না।
সিন্ডিকেট শব্দটি এখন আমাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী একটি শব্দে পরিণত হয়েছে। যার দ্বারা প্রায় সারা বছর আমরা নিষ্পেষিত হচ্ছি। আমরা ভালো নেই। আমাদের মাসিক আয়ের ৬০ ভাগ চলে যায় বাড়িভাড়ায়, আর ২০ ভাগ খাবারে। দুই বাচ্চার পড়াশোনা আর স্কুলে যাতায়াতে খরচ হয় আয়ের ১০-১৫ ভাগ। তারপর রয়েছে চিকিৎসা।
বর্তমান সিন্ডিকেট বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে জনগণকে পরিত্রাণ দেওয়া সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ফান হাউজ বাংলাদেশ, সোনালি নিউজ ডক কম, অন্তর্জাল।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০২৩ রাত ৯:১৫