somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

প্রগতি বিশ্বাস
জীবন ও সমাজ সম্পর্কে আমার ভাবনার ভিত্তি মূলত দর্শনশাস্ত্র, বিশেষত স্টোয়িক দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আমি বিশ্বাস করি, আত্মনিয়ন্ত্রণ, প্রজ্ঞা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তাই একজন মানুষের প্রকৃত শক্তির উৎস। আমি একজন সেকুলার মানুষ—যিনি যুক্তি, মানবিকতা এবং বৈজ্ঞানিক

ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষার মান ও ভবিষ্যৎ: এক নির্মোহ কিন্তু মানবিক মূল্যায়ন

২৬ শে আগস্ট, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনের ইতিহাস আর বর্তমান বাস্তবতা আজ এক কঠিন ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে। একদিকে রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অতীতের সোনালি অধ্যায়, অন্যদিকে আজকের করুণ এক দুঃস্বপ্ন। এই পরিস্থিতিতে আমাদের ভাবতে হবে: আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? আমাদের শিক্ষা ও তার চর্চার স্থানগুলো কি জ্ঞানের আলো ছড়াবে, নাকি অন্ধকারের আস্তানা হয়ে থাকবে?

ছাত্র রাজনীতির আদর্শ ও বিকৃত বাস্তবতা
একটু কল্পনার জগতে যাওয়া যাক : একটি আদর্শ ছাত্র রাজনীতির কথা, যা দাঁড়িয়ে থাকে তিনটি বিষয়ের উপর—

শিক্ষার পরিবেশ ও মান উন্নয়নে অক্লান্ত কাজ।

মত প্রকাশ ও সংগঠিত হওয়ার অবারিত স্বাধীনতা।

জাতীয় ইস্যুতে নীতিগত, অহিংস ও সৃজনশীল অংশগ্রহণ।




বাংলাদেশের ইতিহাস এই আদর্শের জ্বলন্ত প্রমাণ। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—প্রতিটি গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার মূখ্য চালিকাশক্তি ছিল এই দেশের ছাত্রসমাজ এছাড়াও ২৪ এর শেখ হাসিনা সরকারের উৎখাত।

কিন্তু আজ? সেই গৌরবান্বিত পথচলা যেন এক ভয়াবহ পথভ্রষ্টতার শিকার। গত এক দশক, এবং বিশেষ করে ২০২৪ সাল, আমাদের দেখালো কীভাবে ছাত্রসংগঠনগুলোর নামে চলছে দলীয় স্বার্থের লড়াই, ক্যাম্পাস দখলের হানাহানি, এবং সহিংসতার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

শিক্ষার মান: শুধু সংখ্যা নয়, এক করুণ গল্প :
শিক্ষার মান বুঝতে হলে শুধু পরীক্ষার ফলাফল পাশের সংখ্যা দেখলে হবে না, দেখতে হবে একটি শিশুর মুখে। বিশ্বব্যাংক ও ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য (এপ্রিল ২০২৪) বলছে, বাংলাদেশে ১০ বছর বয়সী প্রায় ৫১% শিশুই একটি সহজ গল্পও ঠিকমতো পড়তে ও বুঝতে পারে না। অর্থাৎ, প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেও দেশের অর্ধেকের বেশি শিশু মৌলিক দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। স্কুলে ভর্তির হার বাড়লেও ('অ্যাক্সেস';) প্রকৃত শেখার ফলাফল ('লার্নিং আউটকাম';) এখনও উদ্বেগজনকভাবে পিছিয়ে।

২০২৪ সালের দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এই সংকটকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। প্রতিটি বন্ধ দিন শুধু একটি ক্যালেন্ডারের দিন নয়, এটি ছিল একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ থেকে এক একটি চুরি করা দিন। ক্লাস না হওয়া, পরীক্ষা পেছানো এবং অনিশ্চয়তার এই পরিবেশ সরাসরি তাদের শেখার ধারাবাহিকতাকে ধ্বংস করেছে।


রাজনীতি কীভাবে শিক্ষাকে ক্ষতবিক্ষত করছে: এর প্রক্রিয়াটি খুবই সূক্ষ্ম এবং ক্ষতিকর:
শিক্ষার সময়ের অপমৃত্যু: প্রতিষ্ঠান বন্ধ, ক্লাস বাতিল, পরীক্ষা স্থগিত—এগুলো শুধু সময়ক্ষতি নয়, এটি শিক্ষার্থীদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়কে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

মনের উপর আঘাত: সহিংসতা, গ্রেপ্তার ও আতঙ্কের সংস্কৃতি একজন শিক্ষার্থীর মনোযোগ, সৃজনশীলতা এবং নিরাপত্তাবোধকে নষ্ট করে দেয়। একটি আতঙ্কিত মন কখনও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারে না।
প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি নড়বড়ে করা: দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান পদ্ধতি, পরীক্ষার ব্যবস্থা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে আস্থার বন্ধনকে ভেঙে দেয়। এটি শুধু একটি সেমিস্টার নষ্ট করে না, পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতকে নড়িয়ে দেয়।

২০২৪-২৫: সহিংসতা, প্রতিশোধ ও ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ লড়াই :
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের পর একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর যে সময় মানুষ ভাবে দেশের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন হবে, তখন দেখা গেলো ইতিবাচকতার পরিবের্তে আসে 'নিয়ন্ত্রণের লড়াই'। সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের পদত্যাগ, শিক্ষকদের অপসারণ এবং একধরনের 'প্রতিশোধের' সংস্কৃতি চোখে পড়ার মতো ঘটনা। ক্যাম্পাসে 'কে কত ক্ষমতাবান'—এই অদৃশ্য লড়াই প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা ও জ্ঞানচর্চার পরিবেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।


আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো 'মব এথিকস' বা গোষ্ঠীগত হিংসার স্বাভাবিকীকরণ। যখনই কোনো একটি গোষ্ঠী নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করে এবং আইন-কানুন নিজের হাতে তুলে নেয়, তখন সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কোনো স্থান থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয় টিকে থাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বৈচিত্র্য এবং নিরাপত্তার উপর। সেটি যখন হুমকির মুখে পড়ে, তখন সমাজের মেরুদণ্ডই ভেঙে পড়ে।

এখন কী করা urgent প্রয়োজন?
১. ক্যাম্পাসে শান্তি ও আইনের শাসন ফিরিয়ে আনো: ক্যাম্পাস সকল রাজনৈতিক সহিংসতা মুক্ত zone হওয়া উচিত। শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলে একটি 'আচরণবিধি (Code of Conduct)' তৈরি করতে হবে, যেখানে সুষ্ঠু তদন্ত এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।

২. ক্ষতি পূরণের একটি mission শুরু করা: হারানো সময় পুষিয়ে নিতে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা, পরীক্ষার সময়সূচি পুনর্বিন্যাস এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দিতে হবে। যে ৫০% শিশু পিছিয়ে আছে, তাদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে remedial কোর্স চালু করা urgent প্রয়োজন।



৩. ছাত্র রাজনীতিকে পুনরায় design করা: ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক-প্রাক্তন শিক্ষার্থী মিলে একটি 'ক্যাম্পাস রাজনৈতিক সনদ' তৈরি করা যেতে পারে। এর মূল ভিত্তি হবে, অহিংসতা, ন্যায্যতা এবং শিক্ষার উন্নতিতে focus করা।

৪. জাতীয় priority হিসাবে শিক্ষাকে স্থান দেওয়া: রাজনৈতিক বিতর্ক যাই থাকুক, শিক্ষা ও অর্থনীতির ক্ষতি মেরামত করাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। একটি অস্থিতিশীল ও ভয়ঙ্কর পরিব্শে কখনও টেকসই উন্নয়নের জন্ম দিতে পারে না।



স্বাধীনতা ছাত্ররাজনীতি হল এক মহান উত্তরাধিকার। মিলিশিয়া বা মব কালচার জন্য নয়। ২০২৪-২৫ আমাদের প্রশ্ন আছে যে সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার মারাত্মক পরিণতি রয়েছে— তারা আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ কেড়ে যুক্তি, এবং তারা আমাদের প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কেড়ে মেনে নিয়েছে।

আমাদের করণীয়:
আমরা কি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে জ্ঞান, যুক্তি এবং সংলাপের মরুদ্যানে পরিণত করব, নাকি আমরা তাদেরকে অন্ধকার, ভয় এবং সহিংসতার প্রশিক্ষণক্ষেত্রে পরিণত হতে দেব? আমাদের পছন্দ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রকৃতি নির্ধারণ করবে। যুক্তি, মানবতা এবং আইনের শাসনের জয়ের সময় এসেছে।


সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৫
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×